আপনার জানার ও বিনোদনের ঠিকানা

মহাকর্ষ তরঙ্গের ইতিকথা

ঠিকানা টিভি ডট প্রেস: মহাকর্ষ তরঙ্গ আবিষ্কারের জন্য ২০১৭ সালের পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার দেওয়াটা মোটেও হিসাবের বাইরে ছিল না। ২০১৬ সালে না দেওয়াটাই বরং আশ্চর্যজনক ছিল। এ পুরস্কারের মধ্য দিয়ে আইনস্টাইনের তত্ত্বের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভবিষ্যদ্বাণীর স্বীকৃতি দেওয়া হলো। এই তরঙ্গের ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল প্রায় শতবর্ষ আগে। সেটা পর্যবেক্ষণ করতে এত দিন লাগল, এটা অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। কারণ, এই তাত্ত্বিক ফলাফলটা ঠিক কি না, তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা সন্দিহান ছিলেন। খোদ আইনস্টাইন পর্যন্ত সংশয় প্রকাশ করেছিলন। আর তরঙ্গের অস্তিত্ব জানলেও এটা দেখতে কেমন তা নিয়ে এই ১০-১২ বছর আগেও বিজ্ঞানীরা একমত ছিলেন না। পাশাপাশি প্রকৌশল ও প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতাও অনেক দিন এ তরঙ্গ শনাক্তের পথে বাধা হয়ে ছিল। এই তরঙ্গের অস্তিত্ব আছে কি না, সেই বিতর্কেই তাত্ত্বিক বিজ্ঞানীরা প্রায় অর্ধশতাব্দী পার করে দিয়েছিলেন, এটা আরও বিস্ময়কর।

আইনস্টাইন সাধারণ আপেক্ষিকতা প্রণয়ন করতে গিয়েই মহাকর্ষ বলের সীমাবদ্ধতা নিয়ে প্রথমে কাজ শুরু করেননি। বরং স্থানকালে বিভিন্ন পর্যবেক্ষকের (Observer) ফলাফলের অভিন্নতা দাবি করতে গিয়েই মাহাকর্ষের সম্পূর্ণ নতুন বিবরণ দাঁড় করান। সেখানে মাধ্যাকর্ষণের প্রভাবকে স্থানকালের বক্রতা হিসেবে দেখানো হয়েছে।’

এখানে একটা মজার পর্যবেক্ষণ আছে। আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতার কারণে কাল্পনিক ইথার পদার্থবিজ্ঞানের জগৎ থেকে নির্বাসিত হয়। কিন্তু সাধারণ আপেক্ষিকতার হাত ধরে স্থানকাল বিন্দুগুলোর মাঝের দূরত্ব হিসেবে আবার চলে আসে। ইথারকে একটা মাধ্যম হিসেবে ঊনবিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানীরা চিন্তা করতেন। যেমন দৈনন্দিন জীবনে আমরা বায়ুকে শব্দের জন্য একটা মাধ্যম হিসেবে জানি। শব্দ যেমন বায়ুর আন্দোলন বই অন্য কিছু নয়, তেমনি ওই সময়ে প্রচলিত ধারণা ছিল যে আলোও অর্থাৎ তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গও এই ইথারের আন্দোলনের কারণে উদ্ভূত হয়। এখন আমরা জানি, এটা আদৌ সঠিক নয়। সাধারণ আপেক্ষিকতার ধারণায় স্থানকালের যেকোনো দুটো বিন্দুর মাঝের দূরত্ব পরিবর্তন হতে পারে, যেমনটা স্প্রিংয়ের সংকোচন-প্রসারণের ক্ষেত্রে ঘটে।

১৯১৯ সালের সাধারণ আপেক্ষিকতার বিখ্যাত মাধ্যাকর্ষণ ক্ষেত্রে আলোর বেঁকে যাওয়ার ঘটনাটি পর্যবেক্ষণ করেছিলেন স্যার আর্থার এডিংটন। এডিংটন ১৯২২ সালেই যুক্তি দেন, আইনস্টাইনের মহাকর্ষ তরঙ্গ আদতে স্থানাঙ্ক ব্যবস্থার তরঙ্গ।

সাধারণ আপেক্ষিকতার কাঠামোয় ত্বরণবিশিষ্ট গতি আর মহাকর্ষের মাঝে কোনো পার্থক্য একজন পর্যবেক্ষক কোনো স্থানীয় পরীক্ষার মাধ্যমে করতে পারবেন না। তাই এ রকম স্থানকালের আন্দোলনকেই আমরা মহাকর্ষ তরঙ্গ হিসেবে দেখতে পাব। অবশ্য শুধু এ রকম কথার ফুলঝুরি দিয়েই আইনস্টাইন ক্ষান্ত হননি, তিনি তাঁর ক্ষেত্র সমীকরণগুলো বিশেষ অবস্থায় সাধারণ তরঙ্গের সমীকরণে পর্যবসিত হয়, তা ১৯১৬ সালেই দেখিয়ে দিলেন। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞান সমীকরণের সমাধানই শেষ কথা নয়, তার জন্য চাই হাতেনাতে করা পরীক্ষণলব্ধ প্রমাণ। কিন্তু মহাকর্ষ হচ্ছে আমাদের জানা সবচেয়ে দুর্বল বল। অতএব, তা তৈরি করার জন্য চাই বিশাল বিশাল ভরের উত্স। এটা পরিষ্কার, বিদ্যুত্চুম্বক তরঙ্গ তৈরি করতে আমাদের যেমন পড়ার টেবিলের সাইজের বা তার থেকেও ছোট সাইজের যন্ত্রপাতি লাগে।

কিন্তু আমরা মাপতে পারব এ রকম ক্ষমতার মহাকর্ষ তরঙ্গ তৈরি করার উত্স তো সারা পৃথিবীর পৃষ্ঠে আটতে পারবে না।

এটা তো গেল শুধু পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যাপার-তত্ত্ব নিয়ে গোল বাধালেন আইনস্টাইন নিজেই! ১৯৩৬ সালে তিনি তাঁর নিজের ১৯১৬ সালের বের করা ফলাফলটিকে ভুল রায় দিলেন। তবে এর জন্য আইনস্টাইনকে পুরোপুরি দোষও দেওয়া উচিত নয়।

১৯১৯ সালের সাধারণ আপেক্ষিকতার বিখ্যাত মাধ্যাকর্ষণ ক্ষেত্রে আলোর বেঁকে যাওয়ার ঘটনাটি পর্যবেক্ষণ করেছিলেন স্যার আর্থার এডিংটন। এডিংটন ১৯২২ সালেই যুক্তি দেন, আইনস্টাইনের মহাকর্ষ তরঙ্গ আদতে স্থানাঙ্ক ব্যবস্থার তরঙ্গ। অতএব এটা আমরা দেখতে পাব না অর্থাৎ এটা যন্ত্রে ধরা পড়বে না। আইনস্টাইন এই যুক্তিতে আদৌ প্রভাবিত হয়েছিলেন কি না তা আমাদের সঠিক জানা নেই। কিন্তু ১৯৩৬ সালে আইনস্টাইন তাঁর পোলিশ পোস্ট-ডক্টরাল ফেলো নাথান রোজেনের সঙ্গে একটি গবেষণায় দেখালেন, মহাকর্ষ তরঙ্গ তৈরি হলেও তা নিজস্ব মহাকর্ষের প্রভাবে দ্রুত একটি বিন্দুতে সংকুচিত হয়ে যাবে। তা আর তরঙ্গাকারে ছড়িয়ে পড়বে না। আইনস্টাইন এই ফলাফলে খুশি ছিলেন। কারণ, তিনি ভেবেছিলেন এর মাধ্যমে কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞানের তরঙ্গ-কণা দ্বৈততা নীতির ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে। আইনস্টাইন তাঁর বন্ধু ম্যাক্স বর্নকে লেখেন, ১৯১৬ সালের ফলাফলটি যে অনুমানে (Approximation) করা হয়েছিল তা বিশ্বাসযোগ্য নয়।

১৯৫৭ সাল থেকে বিজ্ঞানীরা মহাকর্ষ তরঙ্গ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করা শুরু করেন। ওই সালে যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলাইনার চ্যাপেল হিলে এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

কারণ মূল ক্ষেত্র সমীকরণগুলো রৈখিক নয়। যাহোক, আইনস্টাইন তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাস করছেন। তাই তিনি আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটির মুখ্য জার্নাল ফিজিক্যাল রিভিউতে এই ফলাফল নিয়ে একটা প্রবন্ধ ছাপাতে দিলেন। ওই সময় জার্মানির গবেষণা পত্রিকার সম্পাদকই ঠিক করতেন যে ফলাফল ঠিক আছে কি না। কিন্তু আমেরিকান এই জার্নালে রেফারিং সিস্টেম চালু ছিল। সে ক্ষেত্রে সম্পাদক ছাড়া অন্য একজন বিশেষজ্ঞ (যার পরিচয় গবেষণাপত্রের প্রবন্ধের লেখক জানবেন না’) মতামত দেবেন গবেষণাপত্রটি ছাপানো যাবে কি বা যাবে না। ফিজিক্যাল রিভিউয়ের রেফারি আইনস্টাইনের এই গবেষণাপত্রটিকে সরাসরি ভুল বলে রায় দিলেন। আর না ছাপানোর পক্ষে মতামত দিলেন। এতে আইনস্টাইন এই প্রতিক্রিয়ায় এতটাই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন, পরবর্তী আর কোনো তিনি ফিজিক্যাল রিভিউতে পাঠাননি।

পরে অবশ্য জানা যায় ফিজিক্যাল রিভিউয়ের সেই রেফারি ছিলেন ওয়াকার কসমোলজি খ্যাত বিজ্ঞানী হাওয়ার্ড বার্টসন। যিনি আইনস্টাইনের সঙ্গে প্রিন্সটনেই কর্মরত ছিলেন। যাহোক, আইনস্টাইন আরেক পত্রিকায় এই গবেষণাপত্রটা ছাপালেন। কিন্তু ইতিহাস বলে আইনস্টাইনের এই ফলাফল ভুল ছিল। তিনি যদি এই ভ্রান্তিটা না করতেন, আমরা আরও আগে মহাকর্ষ তরঙ্গ শনাক্ত করতে পারতাম কি না, সে ব্যাপারে আমার জোরালো সন্দেহ আছে। এবং আইনস্টাইন-সম্পর্কিত এই কাহিনি থেকে আমরা একটা অন্য রকম শিক্ষা পাই। সেটা হলো সবচেয়ে বড় বিজ্ঞানীও ভুল করতে পারেন এবং শুধু নামের জোরে কোনো ফলাফল বিজ্ঞানে সঠিক বলে প্রতিষ্ঠা পায় না।

১৯৫৭ সাল থেকে বিজ্ঞানীরা মহাকর্ষ তরঙ্গ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করা শুরু করেন। ওই সালে যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলাইনার চ্যাপেল হিলে এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান মহাকর্ষ তরঙ্গ আদৌ সত্য কি না তা প্রমাণে একটি সহজ কাল্পনিক পরীক্ষার কথা বলেন। সেটা স্টিকি বিড এক্সপেরিমেন্ট হিসেবে পরিচিত’।

কোনো সত্ত্বাকে যদি পদার্থবিজ্ঞানের জগতে বাস্তব হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে হয়, তবে তাকে অবশ্যই শক্তি বহন করতে হবে। এডিংটন এবং আরও অনেকেরই যুক্তি ছিল মহাকর্ষ তরঙ্গের কোনো শক্তি নেই। তাই এটা বাস্তব কিছু নয়। ফাইনম্যানের এই মহাকর্ষ তরঙ্গ শনাক্তকরণ যন্ত্রে একটি পেনসিলের ওপর দুটি প্লাস্টিকের রিং বসানো আছে। মহাকর্ষ তরঙ্গ যখন পেনসিলের দৈর্ঘ্য বরাবর অতিক্রম করবে তখন এই রিং দুটোর মাঝের দূরত্ব পর্যায়ক্রমিকভাবে বাড়বে-কমবে আর পেনসিলের সঙ্গে ঘর্ষণের কারণে তাপ উত্পন্ন হবে। এতেই বোঝা যায় মহাকর্ষ তরঙ্গের শক্তি তাপে রূপান্তরিত হয়েছে। অতএব, মহাকর্ষ তরঙ্গ শক্তি বহন করে।

ফাইনম্যানের এই যুক্তির পর থেকেই বিজ্ঞানীরা মহাকর্ষ তরঙ্গকে বাস্তব কিছু হিসেবে ধর্তব্যে নেওয়া শুরু করেন। মজার ব্যাপার, বর্তমান লাইগোর ডিজাইনে ফাইনম্যানের এই দোলকের ধারণাটাও যে ব্যবহৃত হচ্ছে। অনেকেই এটা খেয়াল করেন না।

Facebook
Twitter
WhatsApp
Pinterest
Telegram

এই খবরও একই রকমের

সিরাজগঞ্জ উল্লাপাড়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় একজনের মৃত্যু 

সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি: সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় রাস্তা পারাপার হতে গিয়ে ফরিদুল নামে একজনের মৃত্যু হয়েছে, সোমবার দুপুর সারে ১২ টার দিকে ঢাকা-বনপাড়া মহাসড়কের হাটিকুমরুল পুরাতন মাছের আড়তের

যশোরে বেড়েই চলেছে আলুর দাম, নিয়ন্ত্রণে ৭ ব্যবসায়ী

জেমস আব্দুর রহিম রানা: উৎপাদন মৌসুম শেষ হতে না হতেই এবার আলুর বাজার চড়া হতে শুরু করেছে। যশোরের বাজারে যে আলুর কেজি ছিল ৩০ টাকা,

ইউএনওর গোপন ভিডিও গার্ডের ফোনে, অতঃপর’

নিজস্ব প্রতিবেদক: নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) অনিমেষ বিশ্বাসের দেহরক্ষী আনসার সদস্যকে চাঁদাবাজির মামলায় গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। পরে আদালতের মাধ্যমে তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়।

এনায়েতপুরে প্রকাশ্যে রমরমা জুয়া ও মাদকের আসর, প্রশাসন নিরব 

জহুরুল ইসলাম, সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি: সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানার জালালপুরে প্রকাশ্যে চলছে লাখ লাখ টাকার জুয়া খেলা। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বহু জুয়ারি এসে কর্তাদের ম্যানেজ করেই এ

মালয়েশিয়ায় ৯৫ বাংলাদেশিসহ ৩ শতাধিক অভিবাসী আটক

মালয়েশিয়ায় অভিবাসন বিভাগের অভিযানে ৯৫ বাংলাদেশিসহ ৩২৬ অবৈধ অভিবাসীকে আটক করেছে দেশটির ইমিগ্রেশন পুলিশ। বৃহস্পতিবার (৩০ সেপ্টেম্বর) দিনগত রাতে দেশটির জালান ইকো ম্যাজেস্টিক ১/২ সি,

এল নিনোর কারণেই বাংলাদেশে এত গরম!

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ভয়াবহ তাপপ্রবাহ। গত কয়েকদিন ধরে অসহনীয় তাপমাত্রা সহ্য করতে পারছেন না মানুষ। ফলে হিটস্ট্রোকসহ অন্যান্য স্বাস্থগত ঝুঁকিতে পড়ছেন