আপনার জানার ও বিনোদনের ঠিকানা

সূর্যকে হারিয়ে দেয় হাইড্রোজেন বোমা

ঠিকানা টিভি ডট প্রেস: এখন পর্যন্ত সবচেয়ে শক্তিশালী নিউক্লিয়ার বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। এই হাইড্রোজেন বোমাকে ডাকা হয় তেসার বোম্বা (Tsar Bomba) নামে। যদিও প্রচলিত বাংলায় এর নাম ‘জার বোমা’। এ বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয় ১৯৬১ সালের ৩১ অক্টোবর। এই আকারের একটি নিউক্লিয়ার বোমার বিস্ফোরণে কেন্দ্রে খুব ক্ষুদ্র সময়ের জন্য তাপমাত্রা পৌঁছায় এমনকি ২০-৩০ কোটি কেলভিনে। অথচ সূর্যের কেন্দ্রে তাপমাত্রা মাত্র দেড় কোটি কেলভিন। শক্তিশালী এই নিউক্লিয়ার বোমা ছিল একটি হাইড্রোজেন বোমা, অপর দিকে সূর্যেও ঘটে একই ধরনের হাইড্রোজেন ফিউশন। তাহলে সূর্যকে তাপমাত্রায় হারিয়ে দেয় কীভাবে মানুষের বানানো এমন একটি বোমা?

প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমরা প্রথমে দেখব, সূর্যে আসলে কী ঘটে? সূর্যের আকার, তাপমাত্রা, শক্তি ঘনত্ব, পদার্থের ঘনত্ব-এগুলো দেখে নেব শুরুতে। প্রথমেই দেখা যাক, সূর্যের অঞ্চলগুলো।

সূর্যের ব্যসার্ধ মোটামুটি সাত লাখ কিলোমিটার। পৃথিবীর তুলনায় একশ গুণ বড়। একটি ফুটবলকে ১০০ গুণ বড় করলে মোটামুটি একটি সাততলা বিল্ডিংয়ের সমান উঁচু হবে। বুঝতেই পারছেন, পৃথিবীর তুলনায় সূর্য কত বড়। সূর্যের কেন্দ্র থেকে ১ লাখ ৭৫ হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকায় ঘটে সূর্যের নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া। এই অংশেই উৎপন্ন হয় শক্তি। এরপর থেকে প্রায় ৫ লাখ কিলোমিটারে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া ঘটে না, শক্তিও উৎপন্ন হয় না। তবে এই অংশ থেকেই বিকিরণ ঘটে। এর পরের দুই লাখ কিলোমিটারে পদার্থের পরিচলনের মাধ্যমে তাপশক্তি পরিবাহিত হয়।

সূর্য কিসের তৈরি? আমাদের কাছে সূর্য দেখা দেয় একটি আগুনের গোলা হিসেবে। কিন্তু এর অধিকাংশই হাইড্রোজেন (৭১ শতাংশ) ও হিলিয়াম (২৭ শতাংশ)। বাকিটা অন্য ভারী মৌল। এদের মধ্যে হাইড্রোজেন নিয়মিত ফিউশন হয়ে অর্থাৎ হাইড্রোজেন জোড়া লেগে তৈরি হচ্ছে হিলিয়াম। হিলিয়াম তৈরির এই প্রক্রিয়াতেই উপজাত হিসেবে তৈরি হয় শক্তি, যে শক্তি আমরা পাই; সৌরজগতের অন্য সব জায়গাতেও ছড়িয়ে যায়।

ফিউশন প্রক্রিয়া হলো একধরনের নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া। এই বিক্রিয়ায় একাধিক মৌলের নিউক্লিয়াস একত্র হয়ে নতুন কোনো মৌলের নিউক্লিয়াস তৈরি করে। অন্য আরেক ধরনের নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ায় ভারী মৌলের নিউক্লিয়াস ভেঙে অল্প ভরের একাধিক নিউক্লিয়াস তৈরি হয়। ওই নিউক্লিয়ার বিক্রিয়াকে বলে ফিশন নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া।

পারমাণবিক বা আণবিক প্রক্রিয়ায় যে শক্তি উৎপন্ন করা হয় বা বোমা বানানো হয়, তা আসলে এই নিউক্লিয়ার বিক্রিয়াই। আণবিক বা পারমাণবিক শক্তি, বোমা ইত্যাদি বিজ্ঞানীরা বলতে চান না, যদিও পৃথিবীজুড়ে এ-সংক্রান্ত প্রায় সব সংস্থার নামই পারমাণবিক বা আণবিক শক্তি কমিশন বা সংস্থা ইত্যাদি।

সূর্যের নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ায় কী ঘটে? সূর্যের নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া বুঝতে আমাদের শুরুতে দেখতে হবে নিউক্লিয়াসে কী থাকে? যেকোনো পরমাণুর সাধারণ কণা তিনটা-প্রোটন, নিউট্রন ও ইলেকট্রন। প্রোটন আর নিউট্রন থাকে নিউক্লিয়াসে, নিউক্লিয়াসের চারপাশজুড়ে বাইরে অবস্থান করে ইলেকট্রন। নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ায় ইলেকট্রনের ভূমিকা নেই, যা ঘটার নিউক্লিয়াসে ঘটে।’

নিউক্লিয়াসে কতটা প্রোটন আছে, এর ওপরেই নির্ভর করে পদার্থটা কী। যেমন নিউক্লিয়াসে যদি একটি প্রোটন থাকে, তবে তা হাইড্রোজেন, দুইটা থাকলে তা হিলিয়াম, এভাবে তিনটা থাকলে লিথিয়াম। অক্সিজেনে প্রোটন থাকে আটটা, ইউরেনিয়ামে প্রোটন থাকে ৯২টা। নিউক্লিয়াসে প্রোটনের প্রায় সমানসংখ্যক বা তার চাইতে একটু বেশিসংখ্যক থাকে নিউট্রন। যেমন সাধারণ অক্সিজেনে নিউট্রন থাকে আটটা। আবার ইউরেনিয়ামে নিউট্রন থাকে ১৪০-এর বেশি। নিউট্রনের সংখ্যা আবার নির্দিষ্ট নয়, কমবেশি হতে পারে। যেমন পৃথিবীর প্রাণের প্রধান মৌল কার্বন, এর নিউক্লিয়াসে প্রোটন আছে ছয়টা। কিন্তু নিউট্রন হতে পারে ছয়, সাত, এমনকি আটটিও। কিন্তু এটা যে কার্বন, এর নিশ্চয়তা পাওয়া যায় ভেতরে প্রোটন কয়টা আছে, তা থেকে।

তার মানে একটি পদার্থের নিউক্লিয়াসে যদি বুদ্ধি করে কোনোভাবে একটি প্রোটন ঢুকিয়ে দেওয়া যায় বা বের করা যায়, তাতেই ওই পদার্থ পরিবর্তন করে নতুন পদার্থ তৈরি করে ফেলা যাবে। যেমন ধরা যাক, কম দামি পদার্থ পারদ। পারদে প্রোটন থাকে ৮০টি। এখন এর মধ্য থেকে যদি কোনোভাবে ১টা প্রোটন সরিয়ে ফেলা যায়, তা হয়ে যাবে ৭৯ প্রোটনের স্বর্ণ! যদি আরও একটি প্রোটন সরাতে পারেন, তবে তা হবে আরও দামি, ৭৮ প্রোটনের প্লাটিনাম। কিন্তু প্রোটন যোগ করা বা সরিয়ে দেওয়া কোনো সহজ প্রক্রিয়া নয়। এ জন্যই নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া এত কঠিন।

আরেকটি জিনিস আমাদের জানা দরকার। নিউট্রন আর প্রোটনের সংখ্যার যোগফলকে ওই মৌলের ভরসংখ্যা বলা হয়। যেমন হিলিয়ামের সাধারণ ভরসংখ্যা ৪। হাইড্রোজেনের ১। কিন্তু হাইড্রোজেনের ভরসংখ্যা ১ কীভাবে হয়? নিউট্রন কোথায়? আসলে প্রায় কোনো হাইড্রোজেনেই নিউট্রন থাকে না। হাইড্রোজেন এই হিসেবে একদম ব্যতিক্রম। একটিমাত্র প্রোটন দিয়েই এর নিউক্লিয়াস।

যা-ই হোক, আমরা এবার আমাদের সূর্যের কেন্দ্রের দিকে ফিরতে পারি। সেখানে কী ঘটছে? সেখানে বিপুল পরিমাণে আছে হাইড্রোজেন। শুরুতে দুইটা ১ ভরের হাইড্রোজেন ফিউশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে একত্র হয়। এ সময় উৎপন্ন হয় ২ ভরের একটি হাইড্রোজেন। সাধারণভাবে দুই প্রোটনের একটি হিলিয়াম হওয়ার কথা, যেহেতু দুইটা প্রোটন যুক্ত হচ্ছে। কিন্তু তা ঘটে না। হাইড্রোজেনগুলো যুক্ত হওয়ার সময় একটি নিউট্রিনো আর একটি পজিট্রন উৎপন্ন হয়। নিউট্রিনো একটি মৌলিক কণা। আর পজিট্রন হলো ইলেকট্রনের প্রতিকণা। প্রথম ধাপ শেষে তাহলে আমরা পাই দুই ভরের একটি হাইড্রোজেন, একটি পজিট্রন আর একটি নিউট্রিনো।

এমন একটি দুই ভরের হাইড্রোজেন আবার বিক্রিয়া করে এক ভরের সাধারণ একটি হাইড্রোজেনের সঙ্গে। এতে উৎপন্ন হয় গামা রশ্মি, আর একটি তিন ভরের হিলিয়াম। অর্থাৎ আমরা পেয়ে গেছি হিলিয়াম নিউক্লিয়াস। কারণ এতে আছে এখন দুইটা প্রোটন ও একটি নিউট্রন। গামা রশ্মি হলো এক্সরের চেয়ে শক্তিশালী তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ। আমাদের দেখা আলোর সঙ্গে এর পার্থক্য শুধু তরঙ্গ কম্পাঙ্কে, তার দরুন শক্তিতেও।

দ্বিতীয় ধাপে আমরা হিলিয়াম পেয়ে গেলেও সমস্যা হলো তিন ভরের এই হিলিয়াম স্থায়ী নয়। তাই এমন দুটি হিলিয়াম যুক্ত হয় পরস্পরের সঙ্গে। যুক্ত হতে গিয়ে গিয়ে উৎপন্ন হয় দুটি এক ভরের হাইড্রোজেন, একটি চার ভরের হিলিয়াম। আর চার ভরের হিলিয়াম যথেষ্ট সুস্থিত।

এই নিউক্লিয়ার ফিউশন প্রক্রিয়ায় অংশ নেয় ৬টি হাইড্রোজেন, শেষে দুটি হাইড্রোজেন উৎপন্ন হয়, সঙ্গে উৎপন্ন হয় একটি হিলিয়াম। অর্থাৎ হাইড্রোজেন থেকে উৎপন্ন হচ্ছে একটি হিলিয়াম। সঙ্গে উৎপন্ন হয় বিপুল পরিমাণে শক্তি। আগেই বলা হয়েছে, এই শক্তিই আমাদের সূর্যের শক্তি।

সূর্যে এই যে শক্তি, এর ফলেই উৎপন্ন হয় তাপ। তৈরি হয় বিপুল তাপমাত্রা। সূর্যের মূল অংশের তাপমাত্রা আমরা যদি দেখি,পরিচলন অংশের একদম বাইরের দিকে তাপমাত্রা কিন্তু খুব বেশি নয়। ৬ হাজার কেলভিনের কাছাকাছি। যারা কেলভিনের সঙ্গে পরিচিত নন, কেলভিন তাপমাত্রা পরিমাপের বৈজ্ঞানিক একক। ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতই। পার্থক্য হলো ডিগ্রি সেলসিয়াসের যেকোনো তাপমাত্রা কেলভিনে প্রকাশ করতে চাইলে এর সঙ্গে ২৭৩ যোগ করতে হয়।

ভেতরের দিকে যেতে থাকলে তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। বিকিরণ অঞ্চলের বাইরের অংশে তাপমাত্রা প্রায় ১৫ লাখ কেলভিন। আরও ভেতরে গেলে যে অংশ পর্যন্ত নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়া হয়, সেখানে তাপমাত্রা হয় প্রায় ৮০ লাখ কেলভিন। এরপর ভেতরে যেতে থাকলে তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। একদম কেন্দ্রে পৌঁছে গেলে তাপমাত্রা হয় দেড় কোটি কেলভিন। সূর্যের ভেতরে এটাই সর্বোচ্চ তাপমাত্রা।

এই যে নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়া হচ্ছে, এর জন্য দায়ী মূলত সূর্যের কেন্দ্রে বিপুল চাপে উৎপন্ন তাপমাত্রা। অনেক বেশি ঘনত্ব ও তাপমাত্রা না হলে নিউক্লিউয়ার ফিউশন বিক্রিয়াই হতে পারত না। আবার নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়া নিয়মিত হচ্ছে বলেই প্রচুর শক্তি উৎপন্ন হচ্ছে। ফলে যথেষ্ট তাপমাত্রাও থাকছে, নতুন করে ফিউশন বিক্রিয়া হতে পারছে।’

সূর্যের শক্তি এবং তাপমাত্রার উৎস মোটামুটি জানা হলো। এবার দেখা যাক, হাইড্রোজেন বোমার ভেতরে কী হয়। হাইড্রোজেন বোমাও আসলে নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়ার বোমা। অর্থাৎ ছোটখাটো একটি সূর্য। উভয় ঘটনার মধ্যেই অনেকগুলো মিল আছে। দুই ক্ষেত্রেই ফিউশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে প্রচুর শক্তি উৎপন্ন হচ্ছে। হালকা নিউক্লিয়াস যুক্ত হয়ে উৎপন্ন হচ্ছে ভারী নিউক্লিয়াস। শক্তির উৎপাদনও একই রকম। শক্তিটা উৎপন্ন হয় আইনস্টাইনের বিখ্যাত সমীকরণ মেনে। কীভাবে?

হালকা নিউক্লিয়াস আর ভারী নিউক্লিয়াস যুক্ত হওয়ার সময় কিছুটা ভর হারিয়ে যায়। অর্থাৎ দুটি নিউক্লিয়াস যুক্ত হওয়ার পর ভারী নিউক্লিয়াসের ভর দেখা যায় হালকা নিউক্লিয়াসগুলোর ভরের চেয়ে একটু কম। এই হারানো ভরটিই আইনস্টাইনের বিখ্যাত সমীকরণ E=mc2 থেকে পাওয়া যায়। হারানো ভরকে (m) আলোর বেগের বর্গ (c2) দিয়ে গুণ করলেই বের হবে কতটুকু শক্তি (E) পাওয়া যাবে, তা।

আমরা আগেই বলেছি, নিউক্লিয়ার ফিউশনের জন্য যে তাপ ও চাপ দরকার, তা সূর্যে আছে। কিন্তু নিউক্লিয়ার ফিউশনে তা আসে কোত্থেকে’?

হাইড্রোজেন বোমা আসলে দুই বা তিন স্তরের হয়। এর মধ্যে সাধারণ রাসায়নিক বিস্ফোরণ ঘটে, নিউক্লিয়ার ফিশন ঘটে, তারপর নিউক্লিয়ার ফিউশন ঘটে। প্রথমে একটি চেম্বারে রাখা রাসায়নিক বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এই বিস্ফোরণে বেশ খানিকটা চাপ ও তাপ উৎপন্ন হয়। এই পর্যায়ে কিন্তু অন্য সাধারণ একটি বোমার মতোই ঘটনা ঘটে, কোনো নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া হয় না। উৎপন্ন তাপ ও চাপে এর ভেতর রাখা ইউরেনিয়ামের মাধ্যমে নিউক্লিয়ার ফিশনের চেইন বিক্রিয়া শুরু হয়। মনে রাখতে হবে, এটা কিন্তু ফিউশন বিক্রিয়া নয়, বড় নিউক্লিয়াস ভাঙার মাধ্যমে নিউক্লিয়ার ফিশন বিক্রিয়া। এই বিক্রিয়ার নিউট্রন উৎপন্ন হয়, শক্তি উৎপন্ন হয়। নিউট্রনগুলো চেইন বিক্রিয়ার মাধ্যমে আরও নিউট্রন উৎপন্ন করে, আরও শক্তি উৎপন্ন হয়। ওই শক্তি মূলত এক্স-রে আকারে বিকিরিত হয়। পুরো ঘটনা ঘটে বিশেষভাবে নির্মিত একটি কন্টেইনারের মধ্যে। ওই কন্টেইনারের মধ্যেই থাকে হাইড্রোজেন। সাধারণত দুই ভরের হাইড্রোজেন রাখা হয়, যা মূলত ডিউটেরিয়াম নামে পরিচিত। তো কন্টেইনার এমনভাবে বানানো হয়, যাতে এক্স-রে প্রতিফলিত হয়ে ওই হাইড্রোজেনের ওপরে গিয়ে পরে। এতে তৈরি হয় প্রচণ্ড রকম তাপমাত্রা ও চাপ। ফলে শুরু হয় নিউক্লিয়ার ফিশন বিক্রিয়া, হাইড্রোজেনগুলো যুক্ত হয়ে পরিণত হতে থাকে হিলিয়ামে।

হিলিয়ামে পরিণত হওয়ার সময় প্রায় শূন্য দশমিক ৬১ শতাংশ ভর হারিয়ে যায়। হারানো ভর থেকে তৈরি হয় শক্তি। এভাবেই তৈরি হয় মানুষের তৈরি সূর্যের। আর এই পুরো ঘটনা ঘটে সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মধ্যে। একসঙ্গে এত পরিমাণ শক্তি বিশাল বিস্ফোরণ ঘটায়। চারপাশ ছেয়ে দেয় ধ্বংসের অন্ধকারে।

এবার একটু দেখা যাক, শক্তিশালী একটি হাইড্রোজেন বোমা থেকে কী পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন হতে পারে। এখন পর্যন্ত টেস্ট করা সবচেয়ে শক্তিশালী বোমার কথা শুরুতেই বলা হয়েছে। জার বোমায় উৎপন্ন শক্তি ছিল ৫০ মেগাটন টিএনটির বিস্ফোরণের সমান। এক মেগাটন মানে ১০ লাখ টন। আর এক টন প্রায় এক হাজার কেজির সমান। অর্থাৎ ৫০ মেগাটন মানে ৫ হাজার কোটি কেজি টিএনটির সমান। এত বিপুল শক্তি থাকে খুব অল্প জায়গায়। এই জার বোমার দৈর্ঘ্য ৮ মিটার এবং ব্যাস ২.১ মিটার। মোটামুটি ছয় হাত চওড়া দুইতলা বিল্ডিংয়ের সমান উঁচু। এত অল্প জায়গায় এত বিপুল শক্তি, তা-ও ঘটছে মুহূর্তের মধ্যে, এ জন্যই আসলে বিপুল তাপমাত্রা তৈরি হয় হাইড্রোজেন বোমায়।

আবার যদি আমরা সূর্যের কেন্দ্রের দিকে দেখি, সূর্যের কেন্দ্রের ঘনত্ব প্রায় ১৫০ গ্রাম প্রতি ঘনসেন্টিমিটারে। পানির ঘনত্ব ১ গ্রাম প্রতি ঘনসেন্টিমিটারে। অর্থাৎ সূর্যের কেন্দ্র পানির চাইতে ১৫০ গুণ ভারী। অন্যভাবে বলা যায়, একটি লুডুর ছক্কার আকারের সূর্যের কেন্দ্রের পদার্থের ভর মোটামুটি এক কাপ চায়ের সমান। লুডুর ছক্কার সমান জায়গায় প্রতিসেকেন্ডে সূর্যে নিউক্লিয়ার ফিশনের মাধ্যমে শক্তি উৎপন্ন হয় ৩০০ জুল। একজন সুস্থ সবল মানুষ এতটুকু শক্তি উৎপন্ন করে প্রতি সেকেন্ডে। এই শক্তি দিয়ে ৩০০ ওয়াটের একটি বাল্ব জ্বালানো যাবে।’

নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, আমাদের হাইড্রোজেন বোমা এক ঘনসেন্টিমিটারে এর চাইতেও বেশি শক্তি উৎপন্ন করে। আসলে পুরো হাইড্রোজেন বোমাকে যদি আমরা নিই, তাহলে প্রতি ঘনসেন্টিমিটারে হাইড্রোজেন বোমায় শক্তি উৎপন্ন হয় সাড়ে চারশ কেজি টিএনটির সমান। কিন্তু আগেই দেখানো হয়েছে, হাইড্রোজেন বোমার পুরোটা জুড়ে নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়া হয় না। অন্য অনেক প্রক্রিয়াই থাকে। তার মানে, এই বোমায় প্রতি ঘনসেন্টিমিটারে শক্তি থাকে আরও বেশি। সূর্যের কেন্দ্রের তুলনায় অনেক বেশি। তবে? হাইড্রোজেন বোমা তো পৃথিবীকেই ধ্বংস করে ফেলার কথা!

আসলে তা হয় না পরিমাণের জন্য। আমরা প্রতি ঘনসেন্টিমিটারের হিসাব করছিলাম। একটি হাইড্রোজেন বোমা বড়জোর দুইতলা বিল্ডিংয়ের সমান। এমন কত কোটি বিল্ডিং যে পৃথিবীর বুকে বানানো যাবে! আর পুরো পৃথিবীই তো সূর্যের আকারের তুলনায় নস্যি। এখানেই আসলে সূর্যের সঙ্গে হাইড্রোজেন বোমা হেরে যায়।

সূর্যের আকার, পরিমাণ এত বিপুল যে তুলনা করতে যাওয়াই বৃথা। সূর্যের শক্তি ঘনত্ব প্রতি ঘনসেন্টিমিটারে মাত্র ৩০০ ওয়াট হলেও সূর্যের আকার তো বিশাল। আরেকটা হলো সূর্যের কনসিস্টেন্সি। সূর্যের মধ্যকার চাপের জন্য সেখানে সব সময় ওই দেড় কোটি কেলভিন তাপমাত্রা থাকছে। তাই হাইড্রোজেনের ফিউশন বিক্রিয়া বন্ধ হচ্ছে না, সব সময় শক্তি উৎপন্ন করেই চলেছে এবং সেই শক্তি চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে।

হাইড্রোজেন বোমায় কী হচ্ছে’? খুব অল্প সময়ের মধ্যে খুব অল্প জায়গায় বিপুল শক্তি উৎপন্ন হচ্ছে। সূর্যের চেয়ে শক্তি ঘনত্বে তা অবশ্যই অনেক বেশি। কিন্তু ঘটনাটা ঘটছে সেকেন্ডের ভগ্নাংশের জন্য। ফলে তাপমাত্রাও উঠে যাচ্ছে অনেক বেশি ওপরে। কত বেশি? সূর্যের কেন্দ্রের চেয়েও ১০-১৫ গুণ বেশি। ২০-৩০ কোটি কেলভিন পর্যন্ত।

কিন্তু এত তাপমাত্রায় যে চাপ উৎপন্ন হবে, তা ধরে রাখার সামর্থ্য আছে কোন পদার্থের? আমাদের তো তেমন কোনো পাত্র নেই। তাই ওই পাত্র বিস্ফোরিত হচ্ছে। এবং চারপাশে ছড়িয়ে পরছে শক্তি। খুব অল্প সময়ে অনেক বেশি শক্তি উৎপন্ন হলে এবং নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে ছড়িয়ে পড়াকেই আমরা বলি বিস্ফোরণ। বিস্ফোরণ হলে আবার খুব দ্রুত তাপমাত্রা পড়ে যেতে থাকে। কিন্তু ওই মুহূর্তের জন্য হাইড্রোজেন বোমা ছাড়িয়ে যায় সূর্যকে, সূর্যের কেন্দ্রের তাপমাত্রাকে।

অর্থাৎ মানুষ তৈরি করতে পারে সূর্যের কেন্দ্রের চেয়েও বেশি তাপমাত্রা। সঙ্গে অবশ্য তৈরি হয় অকল্পনীয় ধ্বংসযজ্ঞও।’

লেখক: একাডেমিক কাউন্সেলর, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি

সূত্র: কোয়ান্টা ম্যাগাজিন, সায়েন্টেফিক আমেরিকান

Facebook
Twitter
WhatsApp
Pinterest
Telegram

এই খবরও একই রকমের

সিরাজগঞ্জের যুবকসহ ভারতীয় সেই গৃহবধূ গ্রেপ্তার।

সাব্বির মির্জা সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি প্রেমের টানে স্বামী-সন্তান রেখে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় ছুটে এসে বিয়ে করা ভারতীয় নারী নার্গিসা বেগম (৩০) ও তার বাংলাদেশি স্বামী জুয়েল সরকারকে

সিরাজগঞ্জে ১২ কেজি গাঁজাসহ  এক মাদক ব্যবসায়ী আটক

সেলিম রেজা সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি সিরাজগঞ্জে ১২ কেজি গাঁজাসহ আসাদ মিয়া (৪৮) নামের ওক মাদক কারবারীকে গ্রেফতার করেছে জেলার থানা পুলিশ। জানা যায়, পুলিশ সুপার আরিফুর

আগামী ১৭ জুলাই সিরাজগঞ্জ তাড়াশ পৌরসভা নির্বাচন সুষ্ঠু করার লক্ষ্যে র‌্যাব-১২ প্রেস ব্রিফিং

সেলিম রেজা সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি বাংলাদেশ আমার অহংকার” এই স্লোগানে নিয়ে র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব-১২) দেশের সার্বিক আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে সব ধরণের অপরাধীকে

সিরিয়ায় ইরানের দূতাবাসে বিমান হামলা, শীর্ষ কমান্ডার নিহত

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: সিরিয়ায় ইরানের দূতাবাসে বিমান হামলা হয়েছে। এতে ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি’) এক কমান্ডার নিহত হয়েছেন। সোমবার (০১ এপ্রিল) বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক

‘ইসরায়েলি বর্বরতার ১০০ দিন, গাজায় নিহত ছাড়াল ২৪ হাজার’

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: রোববার গাজায় ইসরায়েলি হামলার ১০০ দিন পূর্ণ হয়েছে। এদিন রাতেও গাজায় দুটি হাসপাতাল, একটি বালিকা বিদ্যালয় এবং বেশ কয়েকটি বাড়িতে হামলা চালানো হয়।

আইসিইউতে মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী

ঠিকানা টিভি ডট প্রেস: অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার এবং নাট্য নির্মাতা মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী। বর্তমানে তিনি আইসিইউতে রয়েছেন। মোস্তফা সরওয়ার ফারুকীর