
নিজস্ব প্রতিবেদক: চলতি বাজেট প্রণয়নের সময় গত বছর বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম ছিল ঊর্ধ্বমুখী। ফলে এর আমদানি বাবদ বাজেটে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) জন্য বেশি অর্থ বরাদ্দ রাখতে হয়েছিল।
চলতি বাজেট প্রণয়নের সময় গত বছর বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম ছিল ঊর্ধ্বমুখী। ফলে এর আমদানি বাবদ বাজেটে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) জন্য বেশি অর্থ বরাদ্দ রাখতে হয়েছিল। তবে এরই মধ্যে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমে এসেছে। তাই সংশোধিত বাজেটে পণ্যটির আমদানি বাবদ বরাদ্দও সে হিসেবে কমেছে। এতে চলতি অর্থবছরে জ্বালানি তেল আমদানিতে বিপিসির সাশ্রয় হবে ২৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
বিপিসির চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট সম্প্রতি অনুমোদন করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এতে সংস্থাটির জন্য জ্বালানি তেল আমদানি বাবদ মূল বাজেটে বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ কমিয়ে আনা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে জ্বালানি তেল আমদানি বাবদ বিপিসির জন্য বরাদ্দ ছিল ৯৯ হাজার ২৪৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৮২ হাজার ৬০৪ কোটি টাকা পরিশোধিত ও ১৬ হাজার ৬৪৫ কোটি টাকা অপরিশোধিত জ্বালানি তেল (ক্রুড অয়েল) আমদানির জন্য বরাদ্দ ছিল। সংশোধিত বাজেটে সংস্থাটির জ্বালানি তেল আমদানি বাবদ বরাদ্দ কমে ৭৫ হাজার ৯৮২ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানির জন্য ৬১ হাজার ৭২৬ কোটি ও অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানির জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১৪ হাজার ২৫৬ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে জ্বালানি তেল আমদানি বাবদ বিপিসির বাজেট বরাদ্দ ২৩ হাজার ২৬৭ কোটি টাকা কমেছে।
জ্বালানি তেল বাবদ বরাদ্দ কমার কারণ হিসেবে বিপিসির কর্মকর্তারা বলছেন, শুরুতে বাজেট করার সময় বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের দাম বেশি ছিল। ফলে সে সময় বাড়তি অর্থ বরাদ্দ রাখতে হয়েছে। কিন্তু এরই মধ্যে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম পড়ে যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই সংশোধিত বাজেটে এ বাবদ বরাদ্দ কমে এসেছে।
বিপিসির মহাব্যবস্থাপক (অর্থ) মুহাম্মদ মোরশেদ হোসাইন আজাদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘প্রিমিয়াম যখন কমে তখন আনুপাতিক হারে আমদানি ব্যয়ও কমে আসে। প্রথমে প্রতি ব্যারেলে প্রিমিয়াম ধরা হয়েছিল ৭ দশমিক ১৭ ডলার, যা পরবর্তী সময়ে কমে ৫ দশমিক ১৬ ডলারে দাঁড়িয়েছে। আমরা দরকষাকষির মাধ্যমে এটি কমিয়ে নিয়ে এসেছি। এতে চলতি অর্থবছরে জ্বালানি তেল আমদানি বাবদ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ব্যয় সাশ্রয় হবে।’
অয়েল প্রাইস ডটকমের তথ্যানুসারে, গত বছরের ৪ জুলাই আরব লাইট ক্রুড অয়েলের দাম ছিল ব্যারেলপ্রতি ৮৮ দশমিক ৫০ ডলার। সর্বশেষ গতকাল এর দাম কমে ৬৬ দশমিক ৩০ ডলারে দাঁড়িয়েছে। একইভাবে মারবান ক্রুড অয়েলের দাম গত বছরের ৪ জুলাই ছিল ৮৭ দশমিক ৪৪ ডলার, যা কমে গতকাল ৬৪ দশমিক ৮৮ ডলারে দাঁড়িয়েছে। এর পাশাপাশি বৈশ্বিক বাজারে পরিশোধিত জ্বালানি তেলের দামও নিম্নমুখী।
দেশে জ্বালানি তেলের চাহিদার মাত্র ৮ শতাংশ পূরণ হয় স্থানীয় উৎস থেকে। বাকি চাহিদা আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হয়। বিপিসি অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করে সৌদি আরবভিত্তিক সৌরি অ্যারাবিয়ান অয়েল কোম্পানি (সৌদি আরামকো) এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) আবুধাবি ন্যাশনাল অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের (অ্যাডনক) কাছ থেকে। এর বাইরে আটটি দেশ থেকে জিটুজি চুক্তি ও আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে বিপিসি পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করে।
বছর পাঁচেক আগেও বড় অংকের পুঞ্জীভূত লোকসানে ছিল বিপিসি। তবে দেশের বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ফলে ২০২০ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটির মুনাফা পুঞ্জীভূত হতে থাকে। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষে বিপিসির সংরক্ষিত আয় (রিটেইনড আর্নিংস) দাঁড়িয়েছে ৩১ হাজার ৮৬৭ কোটি টাকায়। জ্বালানি তেল আমদানি বাবদ ব্যয় কমার কারণে চলতি অর্থবছরে বিপিসি মুনাফায় থাকবে বলে সংশোধিত বাজেটে প্রাক্কলন করা হয়েছে। এক্ষেত্রে অর্থবছর শেষে সংস্থাটির উদ্বৃত্ত দাঁড়াতে পারে ২ হাজার ৭৬৭ কোটি টাকায়। মূল বাজেটে যেখানে বিপিসির ৪ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা ঘাটতি থাকার প্রাক্কলন করা হয়েছিল। এর আগের ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সংস্থাটির উদ্বৃত্তের পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ৪১১ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে জ্বালানি তেল আমদানি বাবদ ব্যয় এর আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় কমেছে। এর মধ্যে চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে ক্রুড অয়েল আমদানি হয়েছে ৫১ কোটি ৫৬ লাখ ডলারের, যেখানে আগের অর্থবছরের একই সময়ে আমদানি হয়েছিল ৭২ কোটি ৫২ লাখ ডলারের। এদিকে চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে পরিশোধিত জ্বালানি তেলসহ পেট্রোলিয়াম পণ্য আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৩৫৭ কোটি ২৬ লাখ ডলার, যেখানে আগের অর্থবছরের একই সময়ে ৩৬০ কোটি ১৮ লাখ ডলার ব্যয় হয়েছিল।
এদিকে চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, এ সময়ে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানিতে ঋণপত্র (এলসি) খোলা ও নিষ্পত্তির হার বাড়লেও পরিশোধিত তেলের ক্ষেত্রে কমেছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে অপরিশোধিত তেল আমদানির ক্ষেত্রে ঋণপত্র খোলার পরিমাণ আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৪২ শতাংশ বেড়ে ৮৭ কোটি ৪৯ লাখ ডলারে দাঁড়িয়েছে। আর এ সময়ে ঋণপত্র নিষ্পত্তির পরিমাণ প্রায় ৩২ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮০ কোটি ২৫ লাখ ডলারে। অন্যদিকে পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানির ঋণপত্র খোলার পরিমাণ আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৩২ শতাংশ কমে ২৭০ কোটি ৯৫ লাখ ডলার এবং ঋণপত্র নিষ্পত্তির পরিমাণ ২১ শতাংশ কমে ২৯৪ কোটি ৩৫ লাখ ডলারে দাঁড়িয়েছে।
জানতে চাইলে বিপিসির চেয়ারম্যান আমিন উল আহসান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মূলত বৈশ্বিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমে যাওয়ার কারণেই আমাদের ব্যয় সাশ্রয় হয়েছে। আমরা আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে বাজেট প্রণয়ন করেছি। এছাড়া সরকার বিশেষত জ্বালানি উপদেষ্টার পরামর্শে প্রতিযোগিতামূলক টেন্ডার এবং জিটুজির মাধ্যমে আমদানির ফলে জ্বালানি তেলের পরিবহন খরচ উল্লেখযোগ্য হারে কমানো সম্ভব হয়েছে, যার প্রভাব বাজেটে দেখা গেছে। জ্বালানি তেল আমদানিতে দরপত্র ও জিটুজি চুক্তি আগের চেয়ে প্রতিযোগিতামূলক হওয়ায় ব্যয় কমার ক্ষেত্রে কাজ করেছে।’
বিপিসির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জ্বালানি তেল আমদানি হয় ৬৩ লাখ ৭১ হাজার ৫৭৩ টন। এতে বিপিসির ব্যয় হয় ৫৫ হাজার ৬৬৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে পরিশোধিত তেল ডিজেল, পেট্রল, অকটেন, জেট ফুয়েল আমদানিতে ব্যয় করা হয় ৪২ হাজার ৬৭ কোটি টাকা। ফার্নেস অয়েল আমদানিতে ৪ হাজার ১০৩ কোটি ও মেরিন ফুয়েল আমদানিতে ১০৭ কোটি টাকা ব্যয় হয়। আর অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানিতে ব্যয় হয় মোট ৯ হাজার ৩৮৬ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের জন্য ৫৯ লাখ ১০ হাজার টন পরিশোধিত এবং ১৪ লাখ টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে।’