
নিজস্ব প্রতিবেদক: আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার পরিকল্পনা সরকারের নেই-প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের এই বক্তব্য ঘিরে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এই বক্তব্যের পক্ষে-বিপক্ষে বিভিন্ন দল ও মহলের অবস্থানে রাজনৈতিক অঙ্গনে হঠাৎ তোলপাড় শুরু হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশের মানুষের মধ্যেও উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। দেশ আবার সংঘাতময় হয়ে উঠে কি না, তা নিয়ে শঙ্কিত দেশের জনগণ।
প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের পর জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ অনেক রাজনৈতিক দলে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। তবে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী কৌশলী অবস্থান নিয়েছে। তারা আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে স্পষ্ট করে কিছু বলেনি। বরং তাদের বক্তব্যে মনে হয়েছে, কোনো বিশেষ কারণে দুই দলই সরকারকে রুষ্ট করতে চাইছে না।’
উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে গতকাল শুক্রবার বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান—দুজনই কৌশলে বলেছেন, তাঁরা দেশে আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন চান না।
অন্যদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিল করতে হবে এবং এই মাফিয়াগোষ্ঠীর রাজনীতিতে ফেরার যেকোনো প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করা হবে। আর এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেছেন, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের প্রশ্নে কোনো ধরনের আপস করার সুযোগ নেই। এনসিপির উত্তরাঞ্চলের সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেছেন, ‘লড়াইয়ের দ্বিতীয় অধ্যায়ের জন্য আমরা প্রস্তুত।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য দেশের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণের ইঙ্গিত দিচ্ছে। একদিকে সরকার আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ না করার প্রতিশ্রুতি দিলেও দলটির শীর্ষ নেতাদের বিচারের আওতায় আনার প্রক্রিয়াও শুরু করেছে। কারো মতে, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে সরকারের কার্যক্রম ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি বলে দেবে এই সিদ্ধান্ত দেশে স্থিতিশীলতা আনবে নাকি নতুন সংঘাতের জন্ম দেবে।
বিভিন্ন দলের উচ্চ পর্যায়ের সূত্রে জানা গেছে, পশ্চিমা প্রভাবশালী বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশগুলো কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার পক্ষে নয়। ওই দেশগুলোর এই অবস্থান বিএনপি, জামায়াতসহ রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর এক ধরনের চাপ।
যেহেতু এই দুই দলই ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি করে তাই তাদের পারিপার্শ্বিক অনেক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে চলতে হয়। তাই বিদেশিদের চাওয়া সব সময় তাদের উপেক্ষা করা সম্ভব হয় না।
বিভিন্ন মহলের ধারণা, প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের পর রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তেজনা আরো বাড়তে পারে। কারণ এই বছরের মধ্যে নির্বাচন করার পক্ষে-বিপক্ষে রাজনৈতিক দল ও মহল নিজেদের অবস্থান সুসংহত করার চেষ্টা করছে। এ ছাড়া জুলাই-আগস্টের ঘটনাগুলোর বিষয়ে জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদনেও কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ না করার সুপারিশ রয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের (আইসিজি) প্রেসিডেন্ট ড. কমফোর্ট ইরোর নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘সরকারের কোনো পরিকল্পনাই নেই আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার। তবে যেসব নেতার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে, তাঁদের বিচার চলবে এবং তাঁরা আইন অনুযায়ী শাস্তি পাবেন।’
প্রধান উপদেষ্টা আরো জানান, জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধানী মিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুলাইয়ের অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত সম্ভাব্য অপরাধের জন্য আওয়ামী লীগের কিছু নেতার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) মামলার বিষয়টি সরকার বিবেচনা করছে। তবে এটি এখনো আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে এবং এ বিষয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।
এই বক্তব্যের পর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ মিছিল করেছে তারা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে গতকাল সকাল থেকেই রাজধানীর সড়কগুলোতে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে যৌথ বাহিনীর সতর্ক অবস্থান দেখা গেছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেছেন, দেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগকে ফেরানোর ‘পরিকল্পনা’ চলছে। আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে ফেরাতে ‘আসন ভাগের’ প্রস্তাব দেওয়া হয় তাঁকে।
নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে কোন প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের পরিকল্পনা সাজানো হচ্ছে, তা তুলে ধরেছেন তিনি। আওয়ামী লীগকে ফেরানোর এই পরিকল্পনা ভারতের বলেও দাবি করেন হাসনাত।
এর আগে বিভিন্ন সময় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ অনেক জ্যেষ্ঠ নেতা বলেছেন, তাঁরা কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার পক্ষে নন।
তবে আওয়ামী লীগ নেতাদের পুনর্বাসন করা হচ্ছে বলে রাজনৈতিক দলগুলো একে অন্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে। সম্প্রতি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেছেন, ‘যাঁরা গণহত্যার সঙ্গে জড়িত এবং বিভিন্ন সময়ে বিগত ফ্যাসিবাদের সময়ে জনগণের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রমে জড়িত ছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগই এখন পলাতক অবস্থায় আছেন। গণহত্যার সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা আছে বিধায় তাঁরা পলাতক অথবা কারাগারে রয়েছেন।’
এরই মধ্যে নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘যাঁরা আওয়ামী লীগ করেছেন, কিন্তু কোনো প্রকার অন্যায় এবং গণহত্যা কিংবা অপরাধের সঙ্গে যুক্ত নন, তাঁরা ক্ষমা চেয়ে আবার মূল ধারায় (মেইনস্ট্রিম) স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারেন এবং সেই জায়গা থেকে যদি কেউ নির্বাচন করেন, তাতেও কোনো বাধা নেই। কিন্তু কেউ যদি সাজাপ্রাপ্ত হয়ে থাকেন, এই গণহত্যার সঙ্গে জড়িত থাকেন, তাহলে তো কোনোভাবেই নির্বাচনে আসতে পারবেন না।’
সংস্কারের কারণে নির্বাচন বিলম্বিত হোক-এটি চায় না বিএনপি। দলটি যত দ্রুত সম্ভব জাতীয় সংসদ নির্বাচন দাবি করে আসছে। জাতীয় নাগরিক পার্টি চায়, গণপরিষদ নির্বাচন।
এরই মধ্যে সংস্কার কমিশনগুলোর করা সুপারিশ চূড়ান্ত করতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সংলাপ শুরু করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের নেতারা মনে করছেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। আবার কেউ বলছেন, বিচারপ্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, প্রধান উপদেষ্টার সাম্প্রতিক বক্তব্য আসন্ন নির্বাচনের জন্য একটি কৌশল হতে পারে। সরকারের এই অবস্থান হয়তো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আশ্বস্ত করার জন্য। তারা চায় আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ না করেও রাজনৈতিক মেরুকরণ বজায় রাখতে।