আপনার জানার ও বিনোদনের ঠিকানা

মণিরামপুরের মশিয়াহাটীতে গ্রামীণ ঐতিহ্য ভাটি পুজো অনুষ্ঠিত

জেমস আব্দুর রহিম রানা: যশোরের মণিরামপুরের মশিয়াহাটীতে অনুষ্ঠিত হয়েছে গ্রামীণ লেকজ উৎসব ভাটি পূজো। মঙ্গলবার সকালে শুরু হয়ে নানা আনুষ্ঠানিকতায় শেষ হয়েছে আজ বৃহস্পতিবার। ভাটি পূজো একটি স্থানীয় লোকজ উৎসব। এটি আসলে একটি সনাতনী লৌকিক পূজো। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল এলাকায় কৃষিজীবী সনাতন ধর্মাবলম্বীরা এ পুজোর আয়োজন করে থাকেন। এই অঞ্চলের গার্হস্থ্য মানুষেরা তাদের গৃহপালিত পশুর বালাই এবং ঘা-পাঁচড়া হতে মুক্তির জন্য এই পূজাপদ্ধতি পালন করে। তারই ধারাবাহিকতায় মশিয়াহাটীতে বংশ পরম্পরায় চলে আসছে এই পূজো। এখানে ভক্তবৃন্দের আগমন ঘটেছে প্রচুর।

বাংলাদেশের বৃহত্তর যশোর-খুলনা, বরিশাল-ফরিদপুর অঞ্চলের মানুষ ভাটি পুজো করে। মূলত ভাটি অঞ্চলের পুজো বলেই একে ভাটি পুজো বলা হয়। ভাটি অঞ্চলের কৃষিজীবী নমঃশূদ্র, কাপালি, পুণ্ড্রক্ষত্রিয়, মুন্ডা, ঋষি, বাগদী প্রভৃতি কৃষিজীবী জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই পূজোর প্রচলন আছে। এছাড়া বাইতি, বাওয়ালি, মাওয়াল, মাঝি, ঘোষ, কর্মকার, কুমার, ছুতার, নরসুন্দর প্রভৃতি পেশাজীবী মানুষের মধ্যেও ভাটি পূজা হতে দেখা যায়। বর্তমানে বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে যারা শাস্ত্রীয় ধর্মের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছে তাদের মধ্যে এই পূজা পদ্ধতি পালন করার রেওয়াজ কমে গেছে।

এটি একটি মাতৃতান্ত্রিক সমাজের পুজো। এর উপাস্য একজন দেবী, যিনি গৃহপালিত জন্তু এবং মানুষকে ঘা-পাঁচড়ার রোগ থেকে রক্ষা করে। এই দেবীর কোনো বিগ্রহ নেই। কোনো প্রকার মূর্তিও তার কল্পনা করা হয় না। এই পুজা সাধারণতঃ গ্রামের বারোয়ারি তলায় হয়। গ্রামের থান বা গ্রামের বাইরে কোনো গাছতলায় এই পুজোর স্থান নির্ধারিত থাকে। বট, পাকুড়, জিয়ল, নীম, কেওড়া প্রভৃতি গাছের নিচে পুজো অনুষ্ঠিত হয়। এসব গাছই ভাটি দেবীর আশ্রয় বলে স্বীকার করা হয়। পুজোর সময়ে পূজারীরা তাঁকে নানা প্রকার গালাগাল দেয়। তাদের ধারণা দেবীকে তুষ্ট করতে না পারলে তাকে ভর্ৎসনার মাধ্যমে তার রোষ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। এর পূজারী সাধারণত নারী এবং শিশু। পূজায় তথাকথিত কোনও পুরোহিত লাগে না। কোথাও কোথাও এটি হ্যাঁচড়া পুজো নামেও প্রচলিত।

ভোরবেলা গ্রামের শিশুরা কুলোয় পুজোর বিভিন্ন উপাচার সাজিয়ে নিয়ে যায়। প্রথম দু’দিন উপাচারের মধ্যে থাকে কেবল নানা প্রকার ফুল। যেমন, ভাঁটফুল, মান্দার ফুল, নীলকণ্ঠ, কল্কে, কাঠ গোলাপ, শিয়াল কাঁটা ইত্যাদি। কুলোর ওপর বুয়ো (পুঁই) গাছের পাতা বিছিয়ে তার উপর ফুল সাজিয়ে নেওয়া হয়। এর পর থানের গাছকে ঘিরে সকলে তাদের কুলো বৃত্তাকারে সাজিয়ে রাখে। মহিলারা একে একে শুরু করেন গান।

হ্যাঁচড়া মাগীরে তোর ফ্যাচড়া চুল, তাইতি দেবো আমরা ভাটির ফুল ॥ ভাটির ফুলি যদি না লাগে তোর মন তাইতি দেবো আমরা মান্দার ফুল ॥ মান্দার ফুলি যদি না লাগে মন তাইতি দেবো আমারা নীলকন্ঠ ফুল ॥ যদি না শুনিস আমার বোল ছেড়বো আমি তোর মাথার চুল ॥ করবো তোরে ভাতার ছাড়া ন্যাড়া মাথায় ঘুরবি পাড়া ॥ জ্বালবো আগুন তোর ঘরে ঘা পাচড়া তুই নিবি পরে ॥

সমবেতভাবে কয়েকটি গান পরিবেশিত হয়। এরপর একে একে কুলার ফুল গাছের গোড়ায় ঢেলে দেওয়া হয়। ফুল নিবেদনের পর শিশু-কিশোরেরা তাদের কুলো একটি লাঠি দিয়ে তালে তালে বাজাতে বাজাতে ঘরে ফেরে। ঠিক পরের দিন ভোরে ফুল তোলার নিমন্ত্রণ দিয়ে তারা ঘরে ফেরে। পরের সকালে আবার যথা নিয়মে আবার পুজো শুরু হয়। পুজোর শেষ অনুষ্ঠানিকতা হয় তৃতীয় দিনে। এদিন যে সকল আচার পালন করা হয় তা অভিনব।

কুলোর উল্টা পিঠে সব উপাচার সাজানো হয়। কুলোর মাথার দুই দিকে কিছুটা গোবর দিয়ে তার উপর দুটো মরা শামুক বসানো হয়। শামুকের মধ্যে দেওয়া হয় মেয়েদের মাথার কিছু ছেড়া চুল, দুটি ডেলা, ভাঁটফুলের পাতা, তেল, সিঁদুর, জল ইত্যাদি। বাড়ি যে কয়টি গরু থাকে সেই কয়টি ভাঁট পাতা নিয়ে যাওয়া হয়।

গাছ তলায় বসে গাছের গোড়ায় প্রথমে তেল দেয়া হয়। এর পর জল, সিঁদুর দেয়া হয়। প্রসাদ দেয়া হয়। প্রসাদ হিসেবে খেঁজুর গুড়ের চিনি, বাতাসা, নাড়ু, নারকেল, খৈ দেয়া হয়। নৈবেদ্য দেয়ার পর ভাট পাতাগুলো নিয়ে আসা হয়। এর পর গরুকে পুকুরে নিয়ে গা ধোওয়ানো হয়। এক একটি ভাঁট পাতা দিয়ে এক একটি গরুর শরীরকে পরিষ্কার করা হয়। বাড়ি ফিরে পরিবারের সবাইকে স্নান করতে হয়। এরপর সন্ধ্যায় পাড়ার সবাই মিলে মাঙন করা চাল-ডাল-সব্জী দিয়ে খিচুড়ি রেঁধে খাওয়া হয়। এভাবেই শেষ হয় ভাটি পুজো উৎসব।

 

Facebook
Twitter
WhatsApp
Pinterest
Telegram

এই খবরও একই রকমের

পাকিস্তানের মূল ক্ষমতার ছড়ি সেনাবাহিনীর হাতেই

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: পাকিস্তানের স্বাধীনতার পর ৭৫ বছরের ইতিহাসে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে সরাসরি দেশ শাসন করেছে সেনাবাহিনী। যখন বেসামরিক সরকার দেশের শাসন ক্ষমতায় এসেছে,

খালেদা-ফখরুলের কী কথা হল’

নিজস্ব প্রতিবেদক: কারামুক্তির পর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকালই প্রথম দেখা করলেন বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সাথে। গতকাল রাত ৮ টার দিকে

২১৭ বার করোনার টিকা নিয়েছেন যে ব্যক্তি’

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: জার্মানির ৬২ বছর বয়সী এক ব্যক্তি ২১৭ বার করোনা ভাইরাস প্রতিরোধী টিকা নিয়েছেন। গত আড়াই বছরে তিনি নিজ উদ্যোগে এসব টিকা নেন। তবে

ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশের দিন আজ’

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: প্রতি বছর রমজান মাসের শেষ শুক্রবার আল-কুদস দিবস দিবস পালন করেন মুসলিম ধর্মবলম্বীরা। প্রথম কেবলা পবিত্র বায়তুল মুকাদ্দাস দখলমুক্ত করার আন্দোলনের প্রতীকী দিন

৩৯০ টাকা দরে গরুর মাংস পেল ৫০০ পরিবার

জেমস আব্দুর রহিম রানা: যশোরের বাজারে গরুর মাংসের কেজি ৭৫০ টাকা। এই দামে মাংস কিনে খাওয়ার সামর্থ্য নেই জেলা শহরের খড়কি এলাকার বাসিন্দা খন্দকার জাহাঙ্গীরের

‘অগ্নিসন্ত্রাসের কারণে বিএনপি শাস্তি এড়াতে পারে না: কাদের’

নিজস্ব প্রতিবেদক: আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপির অগ্নিসন্ত্রাসের নির্যাতনের যে চিত্র, সেই কারণে তারা শাস্তির বাইরে যেতে