জামায়াত আমিরের প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানও

ঠিকানা টিভি ডট প্রেস: সিলেট উইমেন্স মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল। এর প্রতিষ্ঠাতা জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান। স্বাভাবিক দৃষ্টিকোণ থেকে তার এ প্রতিষ্ঠানে সুযোগ পাওয়ার কথা শুধু নিজ দল বা ধর্মের লোকদের। কিন্তু সিলেট উইমেন্স মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের চিত্র ভিন্ন। তার এ প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরাও। জামায়াত নেতার প্রতিষ্ঠানে সব ধর্মের এমন সহাবস্থান কীভাবে সম্ভব? তা সরেজমিনে গিয়ে দেখেছেন প্রতিবেদক। সিলেট থেকে মিঠু দাস জয়ের পাঠানো প্রতিবেদনে তার প্রকৃত দৃশ্য উঠে এসেছে।’

সালটা ২০২১ এপ্রিল, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির মকবুল আহমেদের মৃত্যুর পর থেকে দলের হাল ধরেন ডা. শফিকুর রহমান। নিজ এলাকার সিলেট ওসমানি মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাসের পর চিকিৎসাসেবায় আত্মনিয়োগ করেন তিনি। জামায়াতের রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার পাশাপাশি তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন একটি হাসপাতালও। সিলেট উইমেন্স মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল নামের এ প্রতিষ্ঠান যেন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি।

দেশের বৃহত্তম ধর্মীয় রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর আমিরের হাসপাতালে কাজ করছেন অন্যান্য ধর্মের মানুষও। চিকিৎসক থেকে শুরু করে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী-সব স্তরেই আছেন তারা।

প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে জামায়াত আমিরের প্রতিক্রিয়া

প্রতিষ্ঠানটিতে আয়া হিসেবে দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে কাজ করছেন হেলেন রানী দাস। তিনি জানান কতটা সুযোগ-সুবিধা নিয়ে কাজ করছেন হাসপাতালটিতে। তথ্য বলছে, জামায়াত নেতার হাসপাতালে কর্মকর্তা-কর্মচারী বর্তমানে ১ হাজার ৪৫০ জন। যার মধ্যে ভিন্ন ধর্মের রয়েছেন আড়াই শতাধিক। ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ পেয়েছেন তারা।

সিলেট উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সিকিউরিটি চিফ প্রজেশ দাস বলেন, আমি হিন্দু ধর্মের একজন মানুষ হিসেবে শতভাগ বিশ্বাস নিয়ে বলতে পারি এ হাসপাতালে কোনো ধরনের বৈষম্য নেই। বেতন-ভাতা, চলাফেরা-এসব বৈষম্য কোনো কিছু এখানে নেই। এখানে সবাই সমান। এখানকার ম্যানেজমেন্ট থেকে শুরু করে সবার সঙ্গে আমাদের সুন্দর সম্পর্ক রয়েছে। এ হাসপাতালে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবাই কাজ করছি। আমাদের পরিচালক স্যারদের থেকে শুরু করে সবার সঙ্গে আমাদের একটি সুন্দর সম্পর্ক আছে, তা এই সিলেটের বিভিন্ন হাসপাতাল ও প্রতিষ্ঠান থেকে আলাদা বিরল দৃষ্টান্ত।’

সিলেট উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি ও শিশু বিভাগের সিনিয়র স্টাফ নার্স তুলিকা দেবি বলেন, আমি এখানে কোনো ধরনের বৈষম্যের স্বীকার হইনি। কোনো দিন ধর্ম নিয়ে হেনস্তাও হইনি। এখানকার নিয়োগ স্বচ্ছভাবে হয়। এখানে টাকা দিয়ে কোনো নিয়োগ হয় না। আমি এই মেডিকেলে চাকরি করতে পেরে গর্ববোধ করছি।

সিলেট উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এনআইসিওতে কর্মরত নার্স সুমি রানী দে বলেন, আমি এক বছর হলো এ হাসপাতালে চাকরি করছি৷ এখানে কোনো ধরনের বৈষম্য নেই। আমরা সবাই মিলেমিশে কাজ করছি। আমাদের বেতন-ভাতা নিয়মিত দেওয়া হয়। এখানে নিয়োগ প্রক্রিয়া খুব স্বচ্ছ। এখানকার পরিচালক স্যার থেকে শুরু করে সবার সহযোগিতা পাই। এখানে কাজ করে ভালো লাগছে। আশা করি ভবিষ্যতে আরও ভালো কাজ করব।

সিলেট উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অ্যাকাউন্টেট কর্মরত সুস্মিতা দাস বলেন, অনেক দিন ধরে এ হাসপাতালে কাজ করছি। আমরা সবাই মিলে সুন্দরভাবে কাজ করছি। আমার কাছে মনে হয়- আমরা সবাই একই পরিবারের। এখানে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান কোনো ভেদাভেদ নেই৷ এখানে পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে পরীক্ষার মাধ্যমে যারা উত্তীর্ণ হয় তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়। এখানে ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাই একত্রে মিলেমিশে কাজ করে যাচ্ছি।

সিলেট উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইলেকট্রিক বিভাগে কর্মরত হিমেল দাস বলেন, আমি হাসপাতালে ইলেকট্রনিক বিভাগে চাকরি করছি৷ এখানে কোনো ধরনের বৈষম্য নেই। ধর্ম নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। এখানে চাকরি পেতে কোনো টাকা-পয়সা লাগে না। ইন্টারভিউর মাধ্যমে চাকরি পেয়েছি। এখানে কোনো ধরনের দলীয় সমস্যা নেই।

সিলেট উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সিকিউরিটি গার্ড অপু দাস বলেন, আমি ৫ বছর ধরে এখানে চাকরি করছি। এখানে কোনো ধরনের বৈষম্য নেই। পত্রিকার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে সিভি জমা দিয়েছিলাম। আমি আগে থেকে জানতাম এটা জামায়াতের প্রতিষ্ঠান। কিন্তু ইন্টারভিউর মাধ্যমে চাকরি পেতে কোনো সমস্যা হয়নি৷এখন সুন্দরভাবে চাকরি করছি।

সিলেট উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চতুর্থ তলার এ ব্লকের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী আয়া হেলন রানী দাস বলেন, আমি ১৫ বছর ধরে কর্মচারী হিসেবে এখানে স্বচ্ছ নিয়োগের মাধ্যমে পরীক্ষা দিয়ে চাকরি করছি। এখানে কোনো ধরনের বৈষম্য নেই৷ নার্স, ব্রাদার সবাইকে নিয়ে মিলেমিশে ডাক্তারের সঙ্গে ডিউটি করছি।

সিলেট উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৭ম তলার এ ব্লকের শিশু বিভাগে কর্মরত নার্স শুভ চন্দ শীল বলেন, আমি উইমেন্স নার্সিং কলেজের শিক্ষার্থী ছিলাম৷ যোগ্যতার ভিত্তিতে পরীক্ষা দিয়ে এ হাসপাতালে চাকরি পেয়েছি। আমি আগে থেকে জানতাম এটি জামায়াতের প্রতিষ্ঠান। কিন্তু স্বচ্ছ নিয়োগের মাধ্যমে পরীক্ষা দিয়ে চাকরি পেয়েছি। কোনো টাকা দিয়ে এখানে চাকরি দেওয়া হয় বলে কখনো শুনিনি। আর আশাকরি এখানে এরকম হবে না কোনো দিন। এখানে ধর্ম, বর্ণ কোনো বৈষম্য নেই।

সিলেট উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার হুমায়ূন রশিদ সানি বলেন, আমি প্রায় ২ বছর ধরে এখানে চাকরি করছি। এখানে ধর্ম নিয়ে কোনো ভেদাভেদ নেই। সবাই মিলেমিশে চাকরি করছি। এখানে স্বচ্ছ নিয়োগের মাধ্যমে চাকরি হয়ে থাকে। হাসপাতালে কোনো রাজনৈতিক দলীয় সমস্যা নেই।

সিলেট উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক ও কমিউনিটি মেডিসিনের সহকারী অধ্যাপক ডা. তাফহীম আহমদ রিফাত বলেন, এ হাসপাতাল ও কলেজে ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাই যোগ্যতার ভিত্তিতে কাজ করে যাচ্ছেন। আমি দায়িত্বে থাকা অবস্থায় কখনো এমন কোনো অভিযোগ পাইনি যে, কাউকে ধর্ম, বর্ণ নিয়ে হেনস্তা, অপমান বা অভিযোগ করা হয়েছে। এ হাসপাতাল ও কলেজে ১ হাজার ৪৫০ স্টাফ আছে, তার মধ্যে ২৭০ স্টাফ ব্যতীত বাকি সবাই অন্য ধর্মাবলম্বী। এখানে ডাক্তার, লেকচারারসহ ৩২০ জনের মধ্যে ৭০ জন, নার্স ২৮৩ জনের মধ্যে ৯০ জন, আয়া ১৩৬ জনের মধ্যে ২৬ জন, ওয়ার্ড বয় ১২০ জনের মধ্যে ১৬ জন, সিকিউরিটি ৯০ জনের মধ্যে ২০ জন আছেন অন্যান্য ধর্মাবলম্বী।

তিনি বলেন, এখানে ধর্ম, বর্ণ কোনো কিছুর ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয় না। এখানে স্বচ্ছ ও যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়। আমি দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি, এখানে টাকা দিয়ে কোনো নিয়োগ হয় না। এখানে শতভাগ স্বতন্ত্র কমিটির মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হয়। নিয়োগ কমিটির প্রধান হিসেবে সিলেটের স্বনামধন্য শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. এনাম উদ্দিনকে প্রধান করে ৮ সদস্যের কমিটি গঠন করে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে আমরা সবাই মিলে এ হাসপাতাল ও কলেজকে এগিয়ে নিতে বদ্ধপরিকর’।

সম্প্রতি এক বক্তব্যে নিজ হাতে প্রতিষ্ঠা করা হাসপাতাল প্রসঙ্গে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে আগামীর দায়িত্ব পালন করবে এ দেশের তরুণ সমাজ। এখানেও আমরা কোনো ধরনের ব্যবধান বরদাশত করব না। আমি সরকারের কোনো দায়িত্বে কখনো ছিলাম না। কিন্তু আমার নিজের গড়া কিছু প্রতিষ্ঠান আছে। একটা মেডিকেল কলেজ আছে। সেখানে সাড়ে সাতশ কর্মকর্তা-কর্মচারী আছে। আমার এই মেডিকেল কলেজে যেমন মুসলমান আছে, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় হিন্দু ও খ্রিস্টান ভাইবোনেরা আছে। দু-একটি জায়গায় বৌদ্ধ ভাইবোনেরাও আছে। আমরা এখানে কোনো বেশকম করিনি। আমরা দেখেছি কার যোগ্যতা আছে আমার এ জায়গাটিকে সার্ভিস দেওয়ার- তাকেই বেছে নিয়েছি।

তিনি বলেন, আমি জামায়াতে ইসলামীর আমির। অনেকে বলে আপনার প্রতিষ্ঠানে আসলেই কি এ রকম। আমি বলি, গিয়ে একটু দেখে আসুন। আমার মুখের কথা আপনার বিশ্বাস করার প্রয়োজন নেই। আপনি ওখানে যান। ওখানে গিয়ে আপনি দেখে আসুন। বাস্তবে কী আছে? এর মাধ্যমে আমি আমার মেডিকেল কলেজটাকে একটা ছোট বাংলাদেশ বানানোর চেষ্টা করেছি। এ রকম হবে বাংলাদেশ।’

Facebook
Twitter
WhatsApp
Pinterest
Telegram

এই খবরও একই রকমের

র‌্যাব ১২ এর অভিযানে ফেন্সিডিলসহ ২ জন মাদক ব্যবসায়ী আটক

মাসুদ রানা সিরাজগঞ্জ: সিরাজগঞ্জে র‌্যাব-১২ এর একটি সফল অভিযানে ৯৪ বোতল ফেন্সিডিলসহ দুই মাদক ব্যবসায়ী গ্রেফতার হয়েছে। গত ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে দুপুরে র‌্যাব-১২, সদর

‘অবস্থার অবনতি, আইসিইউতে জনপ্রিয় বক্তা মাওলানা লুৎফর রহমান’

নিজস্ব প্রতিবেদক: ব্রেনস্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছেন বাংলাদেশ মাজলিসুল মুফাসসিরিনের কেন্দ্রীয় সভাপতি, জনপ্রিয় ইসলামি আলোচক ও বক্তা মাওলানা লুৎফর রহমান। বর্তমানে তিনি রাজধানীর ইবনে সিনা হাসপাতালে অধ্যাপক

আতঙ্কে সেই পুলিশ কর্তারা

ঠিকানা টিভি ডট প্রেস: শেখ হাসিনা সরকারের আমলে টানা ১৫ বছর পুলিশ বাহিনীতে মহাক্ষমতায় থাকা অতি-দলবাজ হিসেবে চিহ্নিত কর্মকর্তাদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। চাকরি হারানো

অর্থপাচার মামলায় তারেক রহমান ও মামুনের সাজা বাতিল আপিল বিভাগে

নিজস্ব প্রতিবেদক: অর্থপাচার মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও ব্যবসায়ী গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের সাজা বাতিলের আদেশ দিয়েছেন আপিল বিভাগ। বৃহস্পতিবার সকালে এই আদেশ দেন

এনায়েতপুরে যুবদলের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালন

মুক্তার হাসান,চৌহালী (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধিঃ সিরাজগঞ্জ জেলার এনায়েতপুর থানা যুবদলের ৪৬তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালন। সোমবার সকালে এনায়েতপুর থানা যুবদলের কার্যালয়ে যুবদলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে দোয়া ও আলোচনা

অবৈধ গরু-ছাগলেই ‘সাদিক অ্যাগ্রো’র করপোরেট বাণিজ্য, কোটি টাকার ব্যবসা

নিজস্ব প্রতিবেদক: এ যেন দিনেদুপুরে ডাকাতি। সরকারি নীতিমালাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অবৈধ গরু-ছাগল দিয়ে কোটি টাকার ব্যবসা করছে মোহাম্মদপুরের সাদিক অ্যাগ্রো।’ দীর্ঘদিন ধরে গবাদিপশু নিয়ে মিথ্যা