নিজস্ব প্রতিবেদক: উপজেলা নির্বাচন শেষ হয়েছে। চার ধাপে অনুষ্ঠিত এই উপজেলা নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, আওয়ামী লীগের মধ্যে এই উপজেলা নির্বাচনে এক নীরব যুদ্ধ হয়েছে। এই যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত তৃণমূল জয়যুক্ত হয়েছে বলেই রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন।
এবার উপজেলা নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ দলগতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, দলীয় প্রতীক নির্বাচনে ব্যবহার করা হবে না। আওয়ামী লীগ দলগতভাবে উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে কাউকে মনোনয়ন দেয়নি। এর প্রধান লক্ষ্য ছিল যে, উপজেলা নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ করা এবং দলের ভিতর যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে তাকে সামাল দেওয়া। কিন্তু উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কোন্দল হানাহানি আরও বেড়েছে। পাশাপাশি দলীয় মনোনয়ন না দেওয়ার কারণে উপজেলা নির্বাচনের মাধ্যমে চর দখলের মতো এলাকা দখলের প্রতিযোগিতা শুরু হয় মন্ত্রী-এমপিদের মধ্যে। এ সময় আওয়ামী লীগ সিদ্ধান্ত নেয়, যারা মন্ত্রী-এমপিদের স্বজন রয়েছেন, তারা যেন উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের একাধিকবার এই বক্তব্য দিয়ে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার কথা কেউ শোনেনি।
আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপিরা এলাকায় কর্তৃত্ব অব্যাহত রাখার জন্য তাদের আত্মীয়-স্বজন এবং মাই ম্যানদেরকে প্রার্থী করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত উপজেলা নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে যে, উপজেলা নির্বাচনে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনরা ধরাশায়ী হয়েছেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই উপজেলা নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক উপজেলা নির্বাচনে স্বজনদের প্রার্থী না হওয়ার জন্য বার বার বললেও নিজের স্বজনকেই তিনি আটকে রাখতে পারেননি।
এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকের খালাত ও মামাতো ভাই উভয়ে পরাজিত হয়েছিল। আব্দুর রাজ্জাকের খালাত ভাই এবং মামাতো ভাই যেন প্রার্থী না হন, সে জন্য তৃণমূলের পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে অনুরোধ জানানো হয়েছিল। কিন্তু ড. রাজ্জাক তৃণমূলের দাবির প্রতি সম্মান না দেখিয়ে তার নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রাখার জন্য খালাত এবং মামাতো ভাইকে প্রার্থী করেন। শেষ পর্যন্ত তৃণমূল আওয়ামী লীগ তাকে প্রতিহত করেছেন।’
সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের ছোট ভাই এ উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিল। আ হ ম মুস্তফা কামাল তার একজন মাই ম্যানকে প্রার্থী করেছিলেন অন্য একটি উপজেলায়। তারা দুজনেই পরাজিত হয়েছেন উপজেলা নির্বাচনে। তৃণমূল তাদের বিরুদ্ধে এককাট্টা হয়ে লড়াই করে।
সাবেক নৌ পরিবহন মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শাজাহান খানের চাচাতো ভাই পাভেলুর রহমান উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন। শাজাহান খানের ছেলেও উপজেলা নির্বাচনের প্রার্থী হন। ছেলে শেষ পর্যন্ত পাশ করলেও শাজাহান খানের ভাই পাভেলুর রহমান পাশ করতে পারেননি।
উপজেলা নির্বাচনে জাতীয় সংসদ এর ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকুর ছোট ভাই ও ভাতিজাকেও প্রার্থী করা হয়েছিল। এলাকার দখল নিরঙ্কুশ করার জন্যই ডেপুটি স্পিকার তার নিজস্ব ব্যক্তিকে প্রার্থী দিয়েছিলেন দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করেই। কিন্তু এরা দুজনেই তৃণমূলের কাছে ধরাশায়ী হয়েছে।’
সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. জাহিদ মালেকের ফুপাতো ভাই উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন তৃণমূলের মতামতের বিরুদ্ধে। কিন্তু তৃণমূল তাকে প্রতিহত করেছে। ওই উপজেলা নির্বাচনে জাহিদ মালেকের ফুপাতো ভাই শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছে।
হুইপ সাইমুম সরওয়ার কমলের ভাই উপজেলা নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন। পরাজিত হয়েছেন সুনামগঞ্জ-৪ আসনের এমপি মোহাম্মদ সাদিকের ভাগ্নে। বগুড়া-২ আসনের সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম জিন্নার শালা উপজেলা নির্বাচনে তৃণমূলের কাছে ধরাশায়ী হয়েছেন। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ও শরীয়তপুর-১ আসনের এমপি ইকবাল হোসেন অপুর চাচাতো ভাইকেও প্রার্থী করা হয়েছিল এবং তৃণমূল এই প্রার্থীতার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অপুর চাচাতো ভাই উপজেলা নির্বাচনে তৃণমূলের কাছে হেরে যান।
লালমনিরহাট-২ আসনের এমপি, সাবেক মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদের ভাই উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে জিততে পারেননি তৃণমূলের প্রতিরোধের মুখে। একই অবস্থা হয়েছে, হবিগঞ্জ-৩ আসনের এমপি মোহাম্মদ আবু জাহির এর সম্বন্ধীর। হবিগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরীর ভাই এবং মৌলভীবাজার-১ আসনের এমপি শাহাব উদ্দিনের ভাগ্নের। উপজেলা নির্বাচনে তৃণমূলের এই প্রতিরোধ আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে একটি নতুন মেরুকরণ বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।’