নিজস্ব প্রতিবেদক: শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যে বিতরণযোগ্য পাঠ্যপুস্তকের মান যাচাইয়ে নিয়োজিত পরিদর্শন এজেন্সিগুলোর মধ্যে চলছে এক অস্বাভাবিক প্রতিযোগিতা। সরকার যেখানে কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে বই ছাপার কাজ করছে, সেখানে মান যাচাইয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ নেওয়া হচ্ছে নামমাত্র মূল্যে। কেউ কেউ আবার বিনা পারিশ্রমিকে এই কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করছেন।
অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, মাত্র ৭৭ হাজার টাকার একটি কাজ পেতে এনসিটিবির এক সাবেক সচিবকে ঘুষ দেওয়া হয়েছে ১ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ ধরনের কাজ পাওয়া মানেই রাতারাতি সম্পদের পাহাড় গড়া। অনেকে একে তুলনা করছেন রূপকথার 'আলাদীনের চেরাগ' পাওয়ার সঙ্গে।
২০১৬ সালে প্রাথমিক স্তরের বইয়ের মান যাচাইয়ের কাজের বরাদ্দ ছিল প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকা। অথচ ২০২৪ সালে একই ধরনের কাজ দেওয়া হয়েছে মাত্র ২৯ লাখ টাকায়। সংশ্লিষ্টদের প্রশ্ন—জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ার এই সময়ে কাজের খরচ কমলো কীভাবে?
দরপত্র বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২৪ সালে মাধ্যমিকে প্রাক-সরবরাহ পরিদর্শনের (পিডিআই) জন্য ছয়টি প্রতিষ্ঠান দরপত্র জমা দেয়। সর্বনিম্ন দর ছিল ৩ লাখ ৯৯ হাজার টাকা, আর সর্বোচ্চ ৩২ লাখ। নিয়ম অনুযায়ী সর্বনিম্ন দরদাতাকে কাজ দেওয়ার বিধান থাকলেও এনসিটিবি ষষ্ঠ সর্বোচ্চ দরদাতাকে দায়িত্ব দেয়। পরবর্তী সময়ে অভিযোগ ওঠে, প্রতিষ্ঠানটি ছাপাখানা মালিকদের সঙ্গে যোগসাজশ করে নিম্নমানের কাগজেও ছাড়পত্র দিয়েছে।
প্রতিবেদন বলছে, গড়ে ৩০ শতাংশ বই নিম্নমানের হলেও তা উত্তীর্ণ দেখানো হয়েছে। এনসিটিবির ৩২টি পৃথক টিমের প্রতিবেদনেও এর প্রমাণ মেলে।
২০২৩ সালে মাধ্যমিকের পোস্ট-ডেলিভারি ইন্সপেকশনের (পিএলআই) জন্য মাত্র ৭৭ হাজার টাকায় একটি প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেওয়া হয়। অথচ প্রতিটি উপজেলা থেকে নমুনা বই সংগ্রহ করে তা পরীক্ষার মতো জটিল ও ব্যয়বহুল কাজ এত কম টাকায় কীভাবে সম্ভব, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
এ নিয়োগে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও এনসিটিবির সাবেক সচিব নাজমা আক্তারের বিরুদ্ধে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ জমা পড়ে। অভিযোগ রয়েছে, নাজমা আক্তার রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে তখন শাস্তি থেকে রক্ষা পান।
এছাড়া, পরিদর্শনের দায়িত্ব পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেরা কাজ না করে ছাপাখানা মালিকদের সঙ্গে ‘সমঝোতা’ করে নিম্নমানের বইকে ভালো বলে ছাড়পত্র দিয়েছে।
এনসিটিবির তথ্যমতে, বই ছাপার আগে ও পরে চার স্তরে পরিদর্শন করা হয়। প্রতিটি প্রেসে ২৪ ঘণ্টার তদারক কর্মকর্তা নিয়োগ, বিএসটিআই ল্যাবে মান যাচাই, উপজেলা পর্যায়ে বই সংগ্রহ ও পরীক্ষার ব্যয় মিলিয়ে কাজের প্রকৃত খরচ দাঁড়ায় ৭২-৭৫ লাখ টাকা। অথচ দরপত্র দেওয়া হয়েছে তার এক-তৃতীয়াংশ টাকায়।
এনসিটিবির চেয়ারম্যানের চলতি দায়িত্বে থাকা অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরী বলেন, “এই পরিদর্শনের কাজে কী এমন আছে, সেটি আমি নিজেও বুঝতে পারছি না। কেউ কেউ বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করতে চায়—এটা কোনো সাধারণ বিষয় নয়। এবারের তদন্তে কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। আমরা এবার কঠোর শর্ত আরোপ ও তদারকির আওতায় নিয়ে আসছি। পিএলআই পদ্ধতি বাতিলের চিন্তাও চলছে।”
অভিযোগ রয়েছে, ২০১০ সাল থেকে আজ পর্যন্ত কাজ করে যাচ্ছে মাত্র ৮-১০টি প্রতিষ্ঠান। এই 'সিন্ডিকেট'ই কাজ ভাগ করে নিচ্ছে এবং নতুন কেউ কাজ পেলেও টিকে থাকতে পারছে না।
গত বছর এনসিটিবির বিতরণ নিয়ন্ত্রক হাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে পিডিআই দরপত্রে অনিয়ম ও জালিয়াতির অভিযোগ ওঠে। তার বিরুদ্ধে একাধিক লিখিত অভিযোগও রয়েছে।
পর্যবেক্ষকদের মতে, পাঠ্যবইয়ের মান তদারকির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এমন অনিয়ম ও দুর্নীতি শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎকেই ঝুঁকির মুখে ফেলছে। এই অবস্থার অবসানে জরুরি ভিত্তিতে কঠোর তদন্ত ও কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন।
ইপেপার
Copyright © 2025 ThikanaTV.Press. All rights reserved.