
নিজস্ব প্রতিবেদক: গণঅভ্যুত্থানের সময় ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় হেলিকপ্টার থেকে ৪৫ হাজারের বেশি গুলি ছোড়া হয়েছে বলে ট্রাইব্যুনালকে জানিয়েছেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন শেখ হাসিনা। আন্দোলনের সময় ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, সুনামগঞ্জ, গাইবান্ধা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, রংপুর, নরসিংদীসহ বিভিন্ন জায়গায় র্যাবের হেলিকপ্টার ৩৬ বার উড্ডয়ন করেছে।,
গণঅভ্যুত্থানের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের যুক্তি উপস্থাপনের চতুর্থ দিনে গতকাল বুধবার এ তথ্য জানান তাজুল ইসলাম। এদিন তিনি আন্দোলন চলাকালে হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালানোর তথ্য তুলে ধরেন। বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে দুই সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ পাঁচটি অভিযোগের মধ্যে এদিন দুটির যুক্তি উপস্থাপন শেষ হয়। আজ বৃহস্পতিবার ফের যুক্তি উপস্থাপন করা হবে।
চিফ প্রসিকিউটর বলেন, তিন ব্যক্তির সঙ্গে শেখ হাসিনার কথোপকথন থেকে নিশ্চিত হওয়া গেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তিনি প্রাণঘাতী অস্ত্র (লেথাল উইপন) ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের হত্যার সরাসরি নির্দেশ দিয়েছেন। শেখ হাসিনা ড্রোন ব্যবহার করে অবস্থান শনাক্ত করে হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে হত্যারও নির্দেশ দিয়েছেন। হাসানুল হক ইনুকে (জাসদ নেতা) তিনি নিশ্চিত করেছেন যে নারায়ণগঞ্জে হেলিকপ্টার থেকে ছত্রীসেনা নামানো হবে এবং ওপর থেকে ‘বম্বিং’ করা হবে, প্যারাট্রুপার নামানো হবে। এ সমস্ত কথোপকথন থেকে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করার অর্থাৎ সারাদেশে ‘ওয়াইডস্প্রেড’ এবং ‘সিস্টেম্যাটিক’ হামলা সংঘটনের জন্য শেখ হাসিনার সরাসরি নির্দেশ প্রমাণিত হয়েছে। শেখ হাসিনার সঙ্গে কথোপকথনের যে অডিও ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করা হয়েছে, এতে তাঁর কণ্ঠ সঠিক, নাকি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দিয়ে তৈরি করা হয়েছে এ প্রশ্নে তাজুল ইসলাম বলেন, সিআইডি ফরেনসিক পরীক্ষা করে বলেছে এই কণ্ঠস্বর শেখ হাসিনার। তাঁর সঙ্গে কথা হয়েছে শেখ ফজলে নূর তাপস, হাসানুল হক ইনু ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভিসি মাকসুদ কামালের। তাদের কণ্ঠ ফরেনসিক পরীক্ষায় সিআইডি নিশ্চিত করেছে।
তাজুল ইসলাম আরও বলেন, বিবিসি তাদের একটি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে এই কণ্ঠস্বর পরীক্ষা করেছে। তারা নিশ্চিত করেছে এটি শেখ হাসিনার কণ্ঠ, এআই দিয়ে করা নয়। হত্যার নির্দেশনার ব্যাপারে তিনি বলেন, নির্দেশটা যে সত্যিকার অর্থে শেখ হাসিনা দিয়েছিলেন পুলিশ বাহিনীর সাবেক প্রধান সরাসরি আদালতে সাক্ষ্য দিয়ে বলেছেন। প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করা, হেলিকপ্টার ব্যবহার করার নির্দেশনা শীর্ষ মহল থেকে তিনি পেয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলেছিলেন। এর পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পুলিশপ্রধানকে টেলিফোন করে জানান প্রধানমন্ত্রী তাঁকে এ নির্দেশ দিয়েছেন। পুলিশপ্রধান তখন এ নির্দেশটি তাঁর অধস্তন কর্মকর্তাদের জানান। অধস্তন কর্মকর্তারা অর্থাৎ ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান হাবিব, প্রলয় জোয়ার্দার কমান্ড সেক্টরের মাধ্যমে, ওয়্যারলেস মেসেজের মাধ্যমে বিভিন্ন কমান্ড পোস্ট, বিভিন্ন জায়গায় যে সমস্ত বাহিনীকে নিয়োগ করা হয়েছে, তাদের কাছে পৌঁছে দেন। জাতিসংঘের প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, মিলিটারি রাইফেলে করা গুলিতে ৬৬% মানুষ মারা গেছে।,
হেলিকপ্টার থেকে গুলির বিষয়ে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, হেলিকপ্টার থেকে যে গুলি করা হয়েছে এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট বাহিনীগুলোর কাছ থেকে ‘ডিটেইলড ফ্লাইট চার্টার’ আমরা সংগ্রহ করেছি। এছাড়া কী কী অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে, তোলা হয়েছে তার তালিকা এবং কত রাউন্ড গুলি করা হয়েছে তার তালিকাও দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন–এসএমজি, লাইট মেশিনগান, শটগান, রাইফেল, সাউন্ড গ্রেনেড সবকিছুর হিসাব তালিকায় আছে। ভিডিও ফুটেজ, আহতদের গুলিবিদ্ধ হওয়া, শহীদ এবং আহতদের শরীর থেকে যে বুলেটগুলো বের করা হয়েছে তাও আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে।
কাদেরের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দাখিল পেছাল
গণঅভ্যুত্থানের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৫ আসামির বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল ফের পিছিয়ে ৮ ডিসেম্বর দিন ধার্য করা হয়েছে। তদন্ত সংস্থার সময় আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে ট্রাইব্যুনাল-১ গতকাল বুধবার এই আদেশ দেন। এই মামলায় ৪৫ আসামির মধ্যে ১৭ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। এর মধ্যে ১৬ আসামিকে গতকাল ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। তারা হলেন–সাবেক মন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, আমির হোসেন আমু, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, ড. আব্দুর রাজ্জাক, কামরুল ইসলাম, শাজাহান খান, ডা. দীপু মনি, গোলাম দস্তগীর গাজী, কামাল আহমেদ মজুমদার, জুনাইদ আহ্মেদ পলক, সাবেক এমপি সোলায়মান মোহাম্মদ সেলিম, সাবেক সচিব মো. জাহাংগীর আলম ও সাবেক বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। মুহম্মদ ফারুক খান হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকায় তাঁকে হাজির করা হয়নি।,