
নিজস্ব প্রতিবেদক: হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারের ঘটনা। পুলিশের পক্ষ থেকে এর আগে বলা হয়েছিল, মামলা হলেই কাউকে গ্রেপ্তার করা হবে এমন নয়, গ্রেপ্তার করার আগে যাচাই-বাছাই করা হবে। কিন্তু বাস্তবে তা দেখা যাচ্ছে না। বরং গত কয়েক দিনে মামলা ও গ্রেপ্তারের হিড়িক পড়ে গেছে রাজধানীসহ সারা দেশে। গত দুই দিনে যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের অন্তত ৩০ নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গতকাল বুধবারও গ্রেপ্তার হয়েছেন রাজশাহী-৪ আসনের সাবেক এমপি ও আওয়ামী লীগ নেতা আবুল কালাম আজাদ, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী এবং সাবেক যুব ও ক্রীড়া সচিব মেজবাহ উদ্দীন আহমেদ।’
সারা দেশে একের পর এক গ্রেপ্তারের ঘটনা নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনাও দেখা দিয়েছে। গ্রেপ্তার আতঙ্কে ভুগছেন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত নেতাকর্মীরা। এমনকি যারা কোনো ধরনের অপরাধ, দুর্নীতি বা রাজনৈতিক সহিংসতার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না তারাও ভয়ে এলাকা ছাড়া হয়েছেন। ফলে এসব নেতাকর্মীর পরিবারের সদস্যরা সামাজিক, পারিবারিক এবং আর্থিক সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। তবে পুলিশ বলছে, গ্রেপ্তারের সংখ্যা বাড়লেও ঢালাও গ্রেপ্তারের অভিযোগ ঠিক নয়। প্রাথমিকভাবে পাওয়া অভিযোগ যাচাই-বাছাই করেই গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। ফলে যারা কোনো অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না তাদের অহেতুক আতঙ্কগ্রস্ত হওয়ার কিছু নেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র জানিয়েছে, সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ও আইজিপিসহ একটি বৈঠক হয়েছেÑ যেখানে আওয়ামী লীগের পদধারী বর্তমান ও সাবেক নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেওয়া হয়। এরপরই গ্রেপ্তার অভিযান জোরদার হয়েছে।
এদিকে কামাল আবদুল নাসের চৌধুরীকে গতকাল চার দিনের এবং মেজবাহ উদ্দীন আহমেদকে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। গত বছর ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশে যুবদল নেতা শামীম হত্যা মামলায় নাসের চৌধুরীর এবং দুই বছর আগে গুলিতে মকবুল নামে বিএনপির এক কর্মীর মৃত্যুর মামলায় এই রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।
উল্লেখ্য, গত বছর ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ হামলা চালায়। এতে বিএনপির শত শত নেতাকর্মী আহত হন। নিহত হন যুবদল নেতা শামীম। অন্যদিকে ২০২২ সালের ৭ ডিসেম্বর ডিবি পুলিশের হারুণ অর রশীদ, মেহেদী হাসান ও বিপ্লব কুমার বিএনপির নয়াপল্টন কার্যালয়ে অভিযান ও ভাঙচুর চালায়। ওই সময় কার্যালয়ের পাশে থাকা হাজার হাজার নেতাকর্মীর ওপর হামলা চালানো হয়। এতে মকবুল হোসেনের মৃত্যু হয়।
অপরদিকে সিরাজগঞ্জ-২ আসনের সাবেক এমপি ড. জান্নাত আরা হেনরী ও তার স্বামী সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শামীম তালুকদার লাবুকে গত সোমবার গ্রেপ্তার করা হয়। সিরাজগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হুমায়ুন কবীর বলেন, গতকাল তাদের সিরাজগঞ্জ আদালতে হাজির করে তিনটি হত্যা ও একটি অস্ত্র মামলায় সাত দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেওয়ার কয়েক দিন পর থেকেই মূলত শুরু হয়েছে মামলা ও গ্রেপ্তারের পালা। পুলিশ সদর দপ্তর বলছে, ৫ আগস্টের পর থেকে গতকাল পর্যন্ত প্রায় দুই হাজার মামলা হয়েছে। আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলা, হত্যা, ভাঙচুরসহ বিভিন্ন অভিযোগে দায়ের হওয়া মামলায় এখন পর্যন্ত ৩৯ জন নির্দেশদাতাসহ দেড় হাজার জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এরা সবাই আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী। এর বাইরেও পেশাদার ও ভাড়াটে সন্ত্রাসী অভিযোগেও অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
মামলা ও গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, যারা মামলা দিচ্ছে, তারা সাধারণ জনগণ। দীর্ঘদিনের ক্ষোভ আর বঞ্চনার শিকার হয়ে অনেকে মামলা দিচ্ছেন। মামলা করার অধিকারও সবার আছে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটা কমে যাবে। তা ছাড়া কেউ অন্যায় করলে তাকে আইনের মোকাবিলা করতেই হবে। তবে তদন্ত ছাড়া অযাচিতভাবে হয়রানির উদ্দেশ্যে কাউকে গ্রেপ্তার করা হবে না। পুলিশকে এ ব্যাপারে কঠোর নির্দেশ দেওয়া আছে।
পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) মো. ময়নুল ইসলাম গতকাল প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, সাবেক মন্ত্রী, এমপি বা ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে যে মামলা হচ্ছে পুলিশ সদর দপ্তর সেই মামলাগুলো ক্লোজ মনিটরিং করছে। যাদের গ্রেপ্তার করা প্রয়োজন শুধু তাদেরকেই গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এরপরও তদন্তে যদি দেখা যায়, তাদের বিরুদ্ধে এজাহারে আনা অভিযোগের প্রমাণ নেই, তাহলে চার্জশিট থেকে অবশ্যই তাদের নাম বাদ যাবে। অযথা কেউ হয়রানির শিকার হবেন না। শুধু অপরাধীরাই আইনের হাতে ধরা পড়বে। এ ব্যাপারে মাঠপর্যায়ে যারা কাজ করছেন তাদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।
আইজিপি আরও বলেন, সাবেক মন্ত্রী, এমপি বা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, পুলিশ অফিসারসহ যাদের আসামি করা হয়েছে, তাদের ব্যাপারে তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তথ্য ও ভিডিও ক্লিপের ভিত্তিতে নিশ্চিত হয়ে অপরাধীদের ধরা হচ্ছে।
সম্প্রতি পুলিশের গ্রেপ্তার তৎপরতা বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে পুলিশের একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, এখন যারা গ্রেপ্তার হচ্ছেন তারা অধিকাংশই পলাতক ছিলেন। তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ গ্রেপ্তারের আগেই কিছুটা মনিরটরিং করা হয়েছে। এর জন্য সময় লাগছে। আবার পলাতক থাকার কারণে তাদের সন্ধান পেতেও সময় লেগেছে। অনেকে বাইরের কোনো দেশে যাওয়ার জন্য যখন বের হচ্ছেন তখন তাদের সীমান্ত এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এসব কারণেই এখন গ্রেপ্তারের সংখ্যা বেশি বলে মনে হচ্ছে। এ ছাড়া ভিডিও ফুটেজ দেখে আসামি শনাক্ত করতেও পুলিশের কিছুটা সময় লেগেছে বা লাগছে।’
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, পুলিশের ট্রমা কাটিয়ে উঠতেও কিছুটা সময় লেগেছে। ধীরে ধীরে তারা স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরে এসেছে। ঢাকার বাইরের জেলা ও থানা পর্যায়ের পুলিশও নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করেছে।’
এখন পর্যন্ত যারা গ্রেপ্তার হয়েছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হচ্ছেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক জ্বালানি খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, সাবেক জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন, সাবেক রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন, একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির উপদেষ্টামণ্ডলীর সভাপতি শাহরিয়ার কবির, সাবেক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান, সাবেক আইজিপি আব্দুল্লাহ আল মামুন ও একেএম শহীদুল হক, সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, সাবেক ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু, সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ড. দীপু মনি, সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন ও হাসানুল হক ইনু, সাবেক এমপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, সাবেক মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী এবি তাজুল ইসলাম, সাবেক ক্রীড়া উপমন্ত্রী আরিফ খান জয়, টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার এনটিএমসির সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান, চট্টগ্রাম বন্দরের সাবেক চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল, ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত, একাত্তর টিভির সিইও মোজাম্মেল বাবু, ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দিলীপ কুমার আগরওয়ালা, জাতীয় সংসদের সাবেক হুইপ মাহবুব আরা বেগম গিনি, সাবেক এমপি আব্দুর রহমান বদি, সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন মানিক, সাবেক উপমন্ত্রী আব্দুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব, সাবেক এমপি হাজী সেলিম, আব্দুস সালাম মুর্শেদী, মোহাম্মদ একরামুল করিম চৌধুরী, আব্দুর রউফ ও এমএ লতিফ, নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার, সাবেক স্বরাষ্ট্র সচিব জাহাংগীর আলম প্রমুখ।’
মধ্যাঞ্চল প্রতিবেদক জানান, কিশোরগঞ্জে বৈষম্যমূলক ছাত্র আন্দোলনে হামলা, ভাঙচুরসহ খুনের ঘটনায় গতকাল স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা এমএ আফজল, এনায়েত করিম অমি, মাসুম খানসহ জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হন। এর ফলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। গতকাল সকালে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট এমএ আফজলসহ ছয়জন নেতা গ্রেপ্তার হওয়ার খবর জানাজানি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের কয়েকশ নেতাকর্মীসহ সমর্থকরা গা-ঢাকা দিয়েছেন।
গতকাল কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া থেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন উপজেলার হোসেন্দী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমিন হিমেল। গত দুই দিনে আওয়ামী লীগ নেতা গিয়াস উদ্দিন লাকি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আজিজুল হক মোতাহারকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গত মঙ্গলবার রাতে সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির অভিযোগে রাজবাড়ীর পাংশা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ছয়জনকে। গতকাল দুপুরে ময়মনসিংহ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে নেত্রকোণা জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি রবিউল আউয়াল শাওনকে।
গত দুই দিনে পৃথক অভিযান চালিয়ে জামালপুরের মাদারগঞ্জ এলাকা থেকে নাশকতার মামলায় আওয়ামী লীগের ১২ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।’