সৌদি আরবে ভিসা প্রতারণার ফাঁদে শত শত বাংলাদেশী

ঠিকানা টিভি ডট প্রেস: বাড়তি উপার্জনের আশায় ২০২২ সালের অক্টোবরে সৌদি আরব যান নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার মেহেরনগরের রিয়াজুল ইসলাম সোহাগ। নরসিংদী সরকারি কলেজ থেকে স্নাতক করা এ তরুণ বিদেশ যাওয়ার আগে সম্পন্ন করেন ফার্মাসিস্ট কোর্সও। তাকে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল, ১৫ মাসের আকামা বা ওয়ার্ক পারমিটের সঙ্গে ফার্মেসিতে কাজের সুযোগ দেয়া হবে। এ প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে দালালের হাতে ৪ লাখ টাকা তুলে দেন সোহাগ। কিন্তু সৌদি আরব যাওয়ার পর তাকে কাজ দেয়া হয় একটি রেস্তোরাঁয়, তা-ও আবার পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে। আর আকামার মেয়াদ ছিল মাত্র তিন মাস। ফলে তিন মাস পরই অবৈধ হয়ে যান সোহাগ। দুই বছর ধরে অবৈধ শ্রমিক হিসেবেই সৌদি আরব আছেন তিনি।

হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে বণিক বার্তার সঙ্গে কথা হয় সোহাগের। তিনি বলেন, এখানে এসে আটকে গেছি। দিনশেষে কোথাও যেতে পারছি না। রেস্তোরাঁ থেকে বাসা, বাসা থেকে রেস্তোরাঁ; বাইরে বের হলেই পুলিশ ধরবে, দেশে পাঠিয়ে দেবে। এদিকে এতদিন যে অবৈধভাবে আছি, সেজন্য সাড়ে ৪ লাখ টাকা জরিমানা দিতে হবে আমাকে। আর এক বছরের আকামা করার সুযোগ পেলে সে জন্যও লাগবে প্রায় দেড় লাখ টাকা। এসব কীভাবে করব তা জানি না। দালালরা আমাদের নিঃস্ব করেছে।’

সোহাগ জানান, মেহেরনগরের ইকবাল হোসেন, সাইফুল ইসলাম, রহমত উল্লাহ ও অলি উল্লাহর মতো অনেকেই প্রতারণার শিকার হয়েছেন। এ চারজনের মধ্যে সবচেয়ে বিপাকে পড়েছেন সাইফুল ইসলাম। সৌদি আরব যাওয়ার পর সাইফুলকে তায়েফে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কাজ দেয়ার কথা বলে রাখা হয় একটি সুরক্ষিত জায়গায়। প্রথমে বলা হয়েছিল, কাজ না পাওয়া পর্যন্ত থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা দালালরাই করবে। কিন্তু প্রথম ১৫ দিন তাকে খাবার দেয়া হতো এক বেলা। এরপর বলা হয় একটি ভালো কাজ আছে, কিন্তু সেজন্য ১ লাখ টাকা অতিরিক্ত দিতে হবে। এ টাকা দিতে রাজি না থাকায় সাইফুলকে কয়েক দিন খাবারই দেয়া হয়নি। এরপর দালালরা তাকে একটি রেস্তোরাঁয় কাজ দেয়। সাইফুল পরে জানতে পারেন, তাকে দুই হাজার রিয়ালে ওই রেস্তোরাঁর কাছে বিক্রি করা হয়েছে। তাকে ওই রেস্তোরাঁয় প্রতিদিন ১৬ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। বেতন দেয়া হয় সামান্য।

জানা গেছে, এ চক্রে বাংলাদেশের প্রধান দালাল হিসেবে কাজ করেন রায়পুরার আল-আমিন। তিনি নিয়মিত সৌদি আরবে যাতায়াত করেন। তার সহকারী হিসেবে কাজ করেন একই এলাকার রব মিয়া, যিনি বর্তমানে পলাতক। শুধু সোহাগ বা সাইফুল নন, এমন আরো শত শত প্রবাসী এ ধরনের চক্রের হাতে পড়ে সর্বস্ব হারিয়েছেন।

প্রবাসীদের একটি সূত্র জানিয়েছে, প্রতারণার শিকার কয়েকশ প্রবাসীকে মাস খানেক আগে তায়েফের একটি নির্জন পাহাড়ি এলাকায় একত্র করে দালালরা। এরপর ভালো কাজ পাইয়ে দেয়ার আশ্বাসে তাদের কাছে আবার টাকা দাবি করা হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক দালালের সঙ্গে কথা হয় বণিক বার্তার। তিনি বলেন, ‘দালালরা প্রথমে কৌশলে ভিসা সংগ্রহ করেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই টাকার প্রলোভনে কাজটি করেন। অনেক সৌদি নাগরিক আছেন, যারা অসৎ ও অর্থলোভী। মূলত তাদের কাজে লাগান দালালরা। এসব সৌদি নাগরিক নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের নামে ভিসা দেয়। এসব সস্তা ভিসা নিয়ে তা কয়েক গুণ টাকার বিনিময়ে বাংলাদেশীদের কাছে বিক্রি করেন দালালরা। বিক্রি করার সময় ভালো কাজ ও মোটা অংকের বেতনের প্রতিশ্রুতি দেন তারা। এরপর যখন বাংলাদেশীরা সৌদি আরবে যান, তখন না খুঁজে পান কোম্পানি, না খুঁজে পান কফিল তথা স্পন্সর। কারণ তারা অর্থ হাসিল করেই লাপাত্তা হয়ে যান। দালালরাও চম্পট দেন।’

‌একজন প্রবাসী কর্মীর অনেক কিছুর নিয়ন্ত্রণ থাকে কথিত স্পন্সরের হাতে। এমনও হয়, অনেক স্পন্সর প্রবাসী কর্মীর বিরুদ্ধে বানোয়াট অভিযোগ তোলেন। ফলে এসব শ্রমিকের ভাগ্যে প্রত্যাশিত কাজ তো মেলেই না, উল্টো তারা অপরাধী হিসেবে পরিগণিত হয়ে সৌদিতে থাকার অযোগ্য হয়ে পড়েন।

অভিযোগ আছে, অনেক দালাল ১৫ মাসের আকামা দেয়ার কথা বলে তিন মাসের ভ্রমণ ভিসায় প্রবাসীদের সৌদি আরবে নিয়ে যান। এরপর কোনো একটি অস্থায়ী কাজে যুক্ত করে সব যোগাযোগ বন্ধ করে দেন তারা। ফলে তিন মাস পর এসব শ্রমিক অবৈধ হয়ে পড়েন।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্যমতে, চলতি বছর আগস্ট পর্যন্ত সৌদি আরবে গেছেন ৩ লাখ ৩০ হাজার ১৩৪ কর্মী। ২০২০ সালে এ সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৬১ হাজার ৭২৬, ২০২১ সালে ৪ লাখ ৫৭ হাজার ২২৭, ২০২২ সালে ৬ লাখ ১২ হাজার ৪১৮ ও ২০২৩ সালে ৪ লাখ ৯৭ হাজার ৬৭৪।

মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরব। দেশটিতে সবচেয়ে বেশি কর্মী যাওয়ায় সৌদির অসৎ মালিকদের যোগসাজশে শত শত বাংলাদেশীকে ভুয়া ভিসার ফাঁদে ফেলছে দালাল চক্র। বণিক বার্তার সঙ্গে কথা হয় গাজীপুরের সাব্বীর হোসেন, চট্টগ্রামের আবদুল্লাহ ও নোয়াখালীর খলিলুর রহমানের। আবদুল্লাহ জানান, তিনি ফেনীর দালাল ইস্কান্দার আলীর মাধ্যমে সৌদি আরবে যান। তারা প্রতারণার শিকার হয়ে অবৈধ শ্রমিক হিসেবে এক বছর ধরে জেদ্দার একটি রেস্তারাঁয় কাজ করছেন।’

ভিসা প্রতারণার আরো অনেক ধরন রয়েছে। কোম্পানির পরিবর্তে ব্যক্তিগত ভিসায় যারা সৌদি যান, তাদেরও ভুগতে হয়। এসব ক্ষেত্রে দালালরা প্রথমে হাউজ ড্রাইভিং ও গৃহস্থালির কাজের জন্য ভিসা দেন। কিন্তু পরে দেখা যায়, যাদের বিপরীতে ভিসা নেয়া হয়, তাদের কোনো ড্রাইভার বা গৃহকর্মীর প্রয়োজনই নেই। ফলে এসব ভিসা নিয়ে যারা যান, তারা মূলত বেকার থাকেন। এ ভিসায় অন্য কোথাও কাজ করা আবার দণ্ডনীয় অপরাধ। তখন এ ধরনের প্রবাসী শ্রমিকদের মাধ্যমে নতুন প্রতারণা শুরু করে দালালরা। তারা এসব প্রবাসীকে নামমাত্র বেতনে কঠিন পরিশ্রমের কাজে বাধ্য করান।

বণিক বার্তার সঙ্গে কথা হয় ভুক্তভোগী আহমাদ নাকীবের। তিনি বর্তমানে তায়েফের মিক্কাত সেইল আল কাবিরে হকার হয়ে ওমরা সামগ্রী বিক্রি করছেন।

নাকীব সৌদি আরব যান লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার দালাল তামিনুল ইসলাম নাদিমের মাধ্যমে। নাকীব বলেন,অবৈধ হয়ে পড়া প্রবাসীরা তাদের পরিস্থিতির ব্যাপারে কথা বলতে গেলেই শুরু হয় দালালদের নির্যাতন। তারা গালাগালি করে, মারধর করার হুমকি দেয়। বাংলাদেশে থাকা স্বজনদের ফোন করে হুমকি দেয়া হয়।’

নাকীব জানান, তার ক্ষেত্রে এমন পরিস্থিতিও হয়েছে যে তার পরিবারকে দালাল ফোন করে বলেছে যে আজ রাতের মধ্যে তাকে চুরির অপবাদে পুলিশে দেয়া হবে, যেন জেল থেকে বের হতে না পারে।’

বণিক বার্তার সঙ্গে কথা হয় রিক্রুটিং এজেন্সি উজ্জল এভিয়েশনের। এ এজেন্সির মাধ্যমেই কাগজপত্র তৈরি করেন প্রতারণার শিকার হওয়া সোহাগ। এ এজেন্সির কর্মী সুমন জানান, তারা শুধু কাগজপত্র প্রস্তুত করে দেন। কোন ভিসায় গেল, গিয়ে কী কাজ পেল, তা তাদের দেখার বিষয় নয়। এটার সমাধান করতে হলে মূল যিনি ভিসি দেন, তাকে ধরতে হবে।

অভিবাসন ও শরণার্থী বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দূতাবাস সহায়তা করুক বা না করুক, প্রবাসীদের উচিত সেখানে অভিযোগ জানানো। সম্ভব হলে বিএমইটিতেও করতে হবে। একটি হেল্প লাইন আছে সেটাতেও চেষ্টা করা উচিত। যদিও আমরা শুনি এগুলো খুব বেশি কাজে দেয় না।’

তিনি বলেন, ‘এসব ঘটনার ক্ষেত্রে বিএমইটির তদন্ত করা উচিত। দূতাবাসেরও তদন্ত করা উচিত। এ ঘটনার সঙ্গে কারা জড়িত, সৌদিতে কারা জড়িত, দেশে কারা জড়িত, এগুলো বের করা উচিত। এক্ষেত্রে গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতাও জরুরি।’

আসিফ মুনীর মনে করেন, প্রতারণা কমাতে ভবিষ্যতের জন্য পুরো প্রক্রিয়াই অনলাইনের অধীনে আনা দরকার। অনেকে দেশেই তা হচ্ছে। অনলাইনভিত্তিক হলে যেখানেই গলদ থাকুক না কেন, তা শনাক্ত করা যায়।’

Facebook
Twitter
WhatsApp
Pinterest
Telegram

এই খবরও একই রকমের

ঢামেকের জরুরী বিভাগে হা’ম’লা, আটক ৪

নিজস্ব প্রতিবেদক: ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ভিতরে ধারালো অস্ত্র নিয়ে এক গ্রুপের ওপর আরেক গ্রুপের হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসময় চিকিৎসকদের ওপর সন্ত্রাসী হামলার

অহংকার পরিত্যাগ করুন – মোল্লা নাজিম উদ্দিন

অহংকার হলো রঙিন চশমা, খুলে ফেলুন দেখবেন সৃষ্টির তুলনায় আপনি কত নগন্য। ইসলামে গর্ব ও অহংকারকে হারাম করা হয়েছে, অহংকারীর পতন অনিবার্য। আল্লাহ্ সুবহানাহু তা’আলা

জাপানি গাড়ির অকশন শিট যাচাইয়ের সহজ পদ্ধতি: কীভাবে নিশ্চিত করবেন গাড়ির সঠিক তথ্য

জাপানি গাড়ি বিশ্বজুড়ে একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। তাদের নির্মাণের গুণগত মান, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা এবং নির্ভরযোগ্যতার জন্য এই গাড়িগুলি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। জাপান, যাকে

আজ চালু হচ্ছে মেট্রোরেলের মিরপুর-১০ স্টেশন

নিজস্ব প্রতিবেদক: মিরপুর–১০ স্টেশন থেকেও এখন স্বাভাবিকভাবে যাত্রী ওঠা–নামা করতে পারবেন। দীর্ঘ ২ মাস ২৭ দিন পর আজ মঙ্গলবার (১৫ অক্টোবর) চালু হচ্ছে মেট্রোরেলের মিরপুর-১০

পাকিস্তানে ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, সর্বাত্মক যুদ্ধের আশঙ্কা

পাকিস্তানে নিহত অন্তত ৩১, পাল্টা হামলায় কাশ্মীরে ১৫ ভারতীয়র মৃত্যু ঠিকানা টিভি ডট প্রেস: ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় পাকিস্তান ও পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরে ৩১ জন নিহত হয়েছে।

পরকীয়ার জেরে ইমামকে ডেকে নিয়ে কুপিয়ে জখম, জানা গেলো চাঞ্চল্যকর তথ্য

নিজস্ব প্রতিবেদক: যশোরের মণিরামপুরে পরকীয়ার জেরে এক মসজিদের ইমামকে কুপিয়ে জখম করা হয়েছে। রোববার (১২ মে:) দিবাগত রাত ১০টার দিকে উপজেলার রাজগঞ্জ জামতলা মোড়ে এ