সৌদি আরবে অপহরণকারীদের অপতৎপরতায় আতঙ্কিত প্রবাসীরা

অনলাইন ডেস্ক: সৌদি আরবে বাংলাদেশি প্রবাসীদের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে রাজধানী রিয়াদ ও আশপাশের এলাকায় একের পর এক অপহরণ ও নৃশংস নির্যাতনের অভিযোগ উঠে আসছে। গত তিন মাসে অন্তত ৪০ জনের বেশি প্রবাসী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসব ভয়াবহ ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। এসব ঘৃণিত অপরাধের সাথে বাংলাদেশি প্রবাসী কিছু দুষ্কৃতকারী নেতৃত্ত্ব রয়েছে বলে বিভিন্ন মাধ্যমে জানা গেছে।

সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে সম্প্রতি একাধিক প্রতারক চক্রকে ধরে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে ভুক্তভোগী প্রবাসীরা। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া বেশ কিছু ভিডিওতে দেখা যায়, প্রবাসীরা কৌশলে এসব চক্রের সদস্যদের অর্থ লেনদেনের কথা বলে নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে গিয়ে আটক করে। পরে উপস্থিত প্রবাসীরা তাদের মারধর করে এবং সৌদি পুলিশে সোপর্দ করে। ঘটনাগুলো প্রবাসী সমাজে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে এবং প্রতারক চক্রের বিরুদ্ধে সচেতনতার বার্তা ছড়িয়েছে।

ভুক্তভোগীদের ভাষ্যমতে, একটি সংঘবদ্ধ চক্র বাংলাদেশি প্রবাসীদের টার্গেট করে নানা কৌশলে ফাঁদে ফেলছে। কেউ কেউ ‘রাইড শেয়ারিং’ বা ‘ডেলিভারি অ্যাপ’-এর অর্ডারের ফাঁদে পড়ছেন, কেউবা আবার সরল বিশ্বাসে কাজের সুযোগ বা ব্যক্তিগত পরিচয়ের আড়ালে ডেকে নেওয়া ফাঁদে পা দিচ্ছেন। এরপর নির্জন বাসায় আটকে রেখে শুরু হয় নির্যাতনের নির্মম পর্ব। হাত-পা বেঁধে বেধড়ক মারধর করা হয় এবং সেই দৃশ্য ভিডিও কলে দেখিয়ে প্রবাসীদের স্বজনদের কাছে মোটা অংকের মুক্তিপণ দাবি করা হয়।

ভুক্তভোগীদের পরিবারের সদস্যদের বরাতে জানা গেছে, অপহরণকারীরা প্রথমেই ৫,০০০ থেকে ২০,০০০ সৌদি রিয়াল পর্যন্ত মুক্তিপণ দাবি করে থাকে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে টাকা না পাঠালে নির্যাতনের মাত্রা বাড়তে থাকে। অনেক সময় অপহৃতকে মুমূর্ষু অবস্থায় ফেলে রেখে ভয় দেখানো হয়। পরিবারের সদস্যরা জানান, প্রতিদিনই তারা আতঙ্কে দিন কাটান—“না দিলে মেরে ফেলবে” এমন হুমকি প্রায়ই শুনতে হয়।

এমন পরিস্থিতে এসে কেউ স্বর্ণ বিক্রি করছেন, কেউ ধার-দেনা করে টাকা জোগাড় করছেন। এই চক্র প্রবাসীদের এমনভাবে ভয় দেখায় যাতে তারা পুলিশে অভিযোগ করতে সাহস না পান। পরিস্থিতি নিজেদের অনুকূলের বাইরে থাকায় মুক্তিপণ সংগ্রহ করতে বাধ্য হচ্ছেন পরিবারগুলো।

সম্প্রতি আলোচিত কয়েকটি ঘটনার মধ্যে, রিয়াদের মানফুয়া এলাকা থেকে অপহৃত হন লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর উপজেলার চরপাতা গ্রামের বাসিন্দা আরিফ হোসেন। গত ২৯ মে, বুধবার রাত আনুমানিক ৩টার দিকে তাকে বাথা মানফুয়া থেকে অপহরণ করা হয়। তিনি একটি প্রাইভেট কার চালাতেন, যেটি ধার করে কেনা হয়েছিল এবং এখনো তার ঋণ শোধ হয়নি।

অপহরণকারীরা তাকে একটি বাসায় নিয়ে যায় এবং মারধরের ভিডিও কল পাঠিয়ে তার পরিবারের কাছে মুক্তিপণ দাবি করে। পরিবারের সদস্যরা নানা উপায়ে টাকা সংগ্রহ করে নির্ধারিত অ্যাকাউন্টে পাঠানোর পর, আরিফকে একটি ফাঁকা স্থানে রেখে চলে যায় চক্রটি।

এছাড়াও, মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার বাসিন্দা কামরুল ইসলাম দীর্ঘদিন ধরে সৌদি আরবের হারা এলাকায় বসবাস করে আসছিলেন। প্রতিদিনের মতো কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে রওনা দিলে পথিমধ্যে তাকে অপহরণ করা হয়। পরে অজ্ঞাত পরিচয়ের অপহরণকারীরা ফোন করে কামরুলের পরিবারের কাছে তিন লক্ষ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। ঘটনার পর থেকে পরিবার চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছে এবং দ্রুত কামরুলের মুক্তির দাবি জানিয়েছে।

সৌদি আরব প্রবাসীদের মতে, বাংলাদেশ সরকার এবং দায়িত্বশীলদের সুরক্ষাব্যবস্থা না থাকায় সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন প্রবাসী শ্রমিকরা, বিশেষ করে সৌদি আরবের বিভিন্ন স্থানে থাকা প্রান্তিক ও দুর্বল শ্রেণির শ্রমিকরা। অপরাধীচক্র যখন নিশ্চিত থাকে যে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, তখন তারা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এতে ন্যায়বিচার ধোঁয়াশায় পড়ে যায়, এবং নিরাপত্তাহীনতার শিকার হয় নিরীহ মানুষ। সঠিক তদন্ত ও আইনি সুরক্ষা না থাকায় ভুক্তভোগীরা হয়ে পড়েন অসহায়, আর অপরাধীরা পায় অদৃশ্য প্রভাব ও প্রশ্রয়ের ছায়া। এ অবস্থায় রাষ্ট্রীয় উদ্যোগই হতে পারে প্রবাসী শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার একমাত্র উপায়।

সৌদি প্রবাসী মোহাম্মদ নাঈম হোসেন জানান, অপহরণকারী চক্রটি তাদেরকেই মূলত টার্গেট করে থাকেন, যারা সহজেই প্রতারণার ফাঁদে পড়ে যান এবং আর্থিকভাবে দুর্বল হওয়ায় আত্মরক্ষার সুযোগ থাকে না। বিশেষ করে; উবার/ক্যারিম বা প্রাইভেট গাড়ি চালকরা, ফুড ডেলিভারি কর্মীরা, একা বা নির্জনে চলাফেরা করা প্রবাসী বাংলাদেশিরা, যারা নতুন এসেছেন বা ভাষা কম বোঝেন।

প্রায় প্রতিদিনই সৌদি আরবের কোথাও না কোথাও প্রবাসী বাংলাদেশিদের অপহরণের ঘটনা ঘটছে। এর পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে বাড়ছে গাড়ি চুরির মতো অপরাধও। এসব ঘটনায় স্থানীয় প্রবাসীদের মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। প্রবাসীরা বলছেন, নিরাপত্তাহীনতায় তারা দিন কাটাচ্ছেন। এ অবস্থায় দ্রুত প্রতিকার চেয়ে তারা বাংলাদেশ দূতাবাস ও সৌদি প্রশাসনের কাছে যৌথভাবে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জোর দাবি জানিয়েছেন।

সৌদি আরবে বৈধভাবে কাজ করতে আসা হাজার হাজার বাংলাদেশি প্রবাসীর নিরাপত্তা আজ চরম হুমকির মুখে। তারা শুধু শ্রম দিচ্ছেন না, প্রবাস থেকে পাঠানো রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে। সেই মানুষগুলো যদি অপহরণ, নির্যাতনের মতো ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হন, তাহলে তা শুধু মানবিক নয়, রাষ্ট্রীয়ভাবেও দুশ্চিন্তার বিষয়। দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ না নিলে এই সংকট আরও ভয়াবহ হতে পারে।

Facebook
Twitter
WhatsApp
Pinterest
Telegram

এই খবরও একই রকমের

ড. মাহফুজ রহমানকে ছেড়ে নতুন সংসারে ইভা রহমান

আবারও বিয়ে করেছেন কণ্ঠশিল্পী ইভা রহমান। বিয়ের তথ্য নিশ্চিত করেছেন শিল্পী নিজেই। তিনি জানান, গত ১৯ সেপ্টেম্বর ইভার গুলশানের বাসায় দুই পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতে বিয়ের

বরিশালে স্বেচ্ছাসেবক ও যুবদলের দুই নেতাকে হাতুড়িপেটা

ডেস্ক রিপোর্ট: হাট-বাজারের দরপত্র ক্রয় করাকে কেন্দ্র করে বরিশালের গৌরনদী উপজেলার বাটাজোর ইউনিয়নে স্বেচ্ছাসেবক ও যুবদলের দুই নেতাকে হাতুড়িপেটা করার অভিযোগ উঠেছে। বুধবার (১৯ মার্চ)

আমরা সাহসী জাতি, প্রতিটি রক্তবিন্দুর প্রতিশোধ নেওয়া হবে: পাক প্রধানমন্ত্রী

অনলাইন ডেস্ক: রাজনৈতিক নেতাদের একত্রিত হয়ে পাকিস্তানিদের ‘ঐক্যবদ্ধ জাতি’ হিসেবে গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ। তিনি বলেন, আমরা সাহসী জাতি, গত রাতে

বাংলাদেশি হত্যার দায়ে ৫ জনের মৃত্যুদণ্ড দিলো সৌদি’

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: প্রবাসী এক বাংলাদেশি নাগরিককে হত্যার দায়ে পাকিস্তানের পাঁচ নাগরিকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে সৌদি সরকার। স্থানীয় সময় মঙ্গলবার (৫ মার্চ) সৌদি আরবের মক্কা নগরীতে

সাবেক রেলমন্ত্রীকে ধরতে দুই লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা

ঠিকানা টিভি ডট প্রেস: সাবেক রেলপথমন্ত্রী মো. জিল্লুল হাকিমকে ধরতে দুই লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছেন ফ্রান্স প্রবাসী আশরাফুল ইসলাম। তিনি ফ্রান্স বঙ্গবন্ধু পরিষদের সেক্রেটারি।

রাতভর নাটকীয়তা শেষে সাবেক মেয়র আইভী গ্রেপ্তার

নিজস্ব প্রতিবেদক: অভিযান চালাতে গিয়ে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে বিক্ষোভে অবরুদ্ধসহ রাতভর নাটকীয়তা শেষে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীকে গ্রেপ্তার করেছে