
ঠিকানা টিভি ডট প্রেস: নিজ নিজ দলের নেতা, কর্মী, সমর্থক ও মতাদর্শগত সমমনাদেরই ‘জনগণ’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে রাজনৈতিক দলগুলো। বিপরীতে সংবাদমাধ্যমগুলোর কাছে সব ধর্ম, বর্ণ আর মতের নাগরিকই সমষ্টিগতভাবে ‘জনগণ’। রাজনীতিতে অগ্রাধিকার পেয়ে থাকেন প্রভাবশালী ও ক্ষমতাকাঠামোয় জড়িতরা। আর সংবাদমাধ্যমে সবার আগে থাকেন সমাজের বঞ্চিত ও নিপীড়িতরা। রাজনীতিকদের চোখ থাকে রাষ্ট্রকাঠামোয়। সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা থাকে সমাজ বদলে।
তবে ঐতিহ্যগত সত্য হচ্ছে, বিগত ৫ দশক ধরে দেশের সংবাদমাধ্যমগুলো পরিচালিত হয়ে আসছে রাজনৈতিক নেতা বা ভাবাদর্শীদের হাত ধরে। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে তাই জনআকাঙ্ক্ষা পূরণে রাজনৈতিক দলগুলোর কর্তৃত্ববাদি ও স্বৈরাচারী চরিত্র বদলানোর ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়নি বিভাজিত রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির সাংবাদিকতা।
বিপরীতে নব্বই দশকে সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি হয়ে যারা আজ সংবাদমাধ্যমের নীতিনির্ধারকের ভূমিকা পালন করে তারকা খ্যাতি পেয়েছেন তারা সবাই কোনো না কোনো দলের সংগঠক বা কর্মী হিসেবে রাজপথে অবদান রেখেছিলেন। ফলে তাদের চোখে জনগণ হচ্ছেন পছন্দের দলের কর্মী-সমর্থকরা। রাজনৈতিক এসব তারকা সাংবাদিক বরাবরই মেরুদণ্ড বেঁকে রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানের সামনে বসেছেন। প্রশ্ন নয়, প্রশংসায় ভাসিয়ে ফিরেছেন।
সংবাদমাধ্যমের রাজনৈতিক বিটেও বেছে বেছে তাদেরই নির্বাচন করা হয়, অতীতে যাদের রাজনীতির সংশ্লিষ্টতা ছিল। বিশেষ কোনো দলের হয়ে যারা কাজ করেছেন। কারণ, দলান্ধত্বকে এদেশে রাজনৈতিক সচেতনতা হিসেবে দেখা হয়। প্রতিবেদন লেখার কৌশলও এমনই হয়, যেন নিজের পছন্দের দল সুরক্ষা পায়। আর এসব কৌশল পরোক্ষভাবে শেখানো হয় রাজনৈতিক সরকারশাসিত পিআইবির মতো প্রতিষ্ঠান কিংবা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্যসব প্রশিক্ষণপ্রতিষ্ঠান থেকে। কলাম লেখকদেরও ভাড়া করা হয় মতাদর্শের ভিত্তিতে।
‘দলান্ধ সাংবাদিকতা’র এই প্রবণতা সমাজকে সময়ের উপযোগী করে বিনির্মাণ, জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাকাঠামো, তরুণ প্রজন্মের স্বপ্ন বাস্তবায়ন, আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির মানুষ তৈরির বদলে শুধু দলগুলোকে ‘দানবে’ পরিণত করে। প্রবীণ সাংবাদিক, লেখক, গবেষক আফসান চৌধুরী বলেছেন, “আমাদের সাংবাদিকতায় রাষ্ট্র আছে, সমাজের কথা নেই। আমরা কেবল রাজনৈতিক ইতিহাস পড়ি এবং এটাকেই শুধু গুরুত্ব দেই। তাই আমরা সমাজের মানুষকে বাদ দেই।”
একবিংশ শতকের চতুর্থভাগে এসেও আমরা ‘রাজনৈতিক সাংবাদিকতা’র কাঠামোতে বদল আনতে পারিনি। দলান্ধ হওয়ার কারণে আবেগবর্জিত নির্মোহ ইতিহাসও তৈরি করতে পারিনি। একাত্তর নিয়ে কয়েক দশক ধরে গবেষণায় আফসান চৌধুরী বলছেন, “আমাদের পক্ষে মুক্ত মন নিয়ে গবেষণা করা মনে হয় না সম্ভব। আর লোকজন এত রাজনীতি করে যে, একাত্তরের ইতিহাস চর্চার বিষয়টি রাজনৈতিক চর্চায় পরিণত হয়েছে, ইতিহাস চর্চা আর নেই।
গণঅভ্যুত্থানের পর সংবাদমাধ্যমের সংস্কার চেয়েছি আমরা। যার মধ্য দিয়ে রাজনীতির ‘অপসাংবাদিকতা’ বা ‘দলান্ধতা’ দূর হবে। নতুন রাজনীতির বয়ান তৈরির বদলে সাংবাদিকরা কাজ করবেন সর্বজনীন জনআকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে। তবে ইতোমধ্যে কিছু সংবাদমাধ্যমের পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছি, যারা অতীতের স্টাইলেই রাজনীতির বয়ান তৈরিতে উঠেপড়ে লেগেছেন। অনেকের ধারণা, ‘দলান্ধ তারকা সাংবাদিকরা’ অবসরে না যাওয়া অবধি বাংলাদেশে সাংবাদিকতার নতুন দিগন্তের দেখা মিলবে না।