
নিজস্ব প্রতিবেদক: ঢাকার মতিঝিল শাপলা চত্বরে ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে গণহত্যার মাস্টারমাইন্ড ছিলেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বয়ং। তার সরাসরি নির্দেশেই সেদিনের গণহত্যার ছক তৈরি করেছিলেন তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার বেনজীর আহমেদ। গণহত্যা পরিকল্পনা চূড়ান্ত ও বাস্তবায়নে বেনজীর আহমেদের সঙ্গে মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন র্যাবের গোয়েন্দা শাখার তৎকালীন প্রধান লে. কর্নেল জিয়াউল আহসান এবং বিজিবির তৎকালীন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ।
এর সঙ্গে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির তৎকালীন উচ্চপদস্থ এক ডজনের বেশি কর্মকর্তাও জড়িত ছিলেন। গণহত্যা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মতিঝিল এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে গভীর অন্ধকারের মধ্যে সমাবেশের তিনদিক ঘিরে ফেলে রাষ্ট্রীয় তিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যৌথ অভিযান চালায়। পুলিশের ‘অপারেশন সিকিউর শাপলা’, র্যাবের ‘অপারেশন ফ্ল্যাশ আউট শাপলা’ এবং বিজিবির ‘অপারেশন ক্যাপচার শাপলা’ নাম দিয়ে চলে অভিযান। ওই অভিযানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাড়ে সাত হাজার সশস্ত্র সদস্য নিয়োজিত ছিল। যৌথ অভিযানে দেড় লক্ষাধিক গোলাবারুদ ব্যবহৃত হয়।
শাপলা চত্বর গণহত্যায় নিহতের সঠিক সংখ্যা কত তার হিসাব এখনো অজানা। তবে নৃশংস-নিষ্ঠুর ওই ঘটনার অনুসন্ধান করতে গিয়ে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, শহীদের সংখ্যা ৩০০-এর বেশি। এর মধ্যে পুলিশের গোপন রিপোর্টে এ সংখ্যা ১৯১ জন বলে একাধিক সূত্রে বলা হয়েছে। শাপলা চত্বর গণহত্যা নিয়ে মানবাধিকার সংগঠন অধিকার ২০১৩ সালের ১০ জুন প্রথম অনুসন্ধানমূলক রিপোর্ট প্রকাশ করে। তাদের প্রাথমিক তথ্যানুসন্ধান রিপোর্টে গুলিবিদ্ধ হয়ে হত্যার শিকার ৬১ জনের নাম-ঠিকানা প্রকাশ করা হয়। আর আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামের বেওয়ারিশ লাশ দাফনের রেকর্ড থেকে জানা যায়, ২০১৩ সালের মে মাসে অস্বাভাবিক ৩৬৭টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করা হয়, যা প্রতি মাসে গড় বেওয়ারিশ লাশ দাফনের চারগুণ বেশি ছিল।
অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, শাপলা চত্বর গণহত্যার পর ৬ মে ভোরের আলো ফোটার আগেই ফজরের আজানের সময় লাশগুলো গুম করে ফেলা হয়। লাশ গুমে নেতৃত্ব দেন র্যাব কর্মকর্তা লে. কর্নেল জিয়াউল আহসান। তিনি ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে থেকে অ্যাম্বুলেন্স ও সিটি করপোরেশনের গাড়িতে করে লাশ সরান। কর্মরত বেসরকারি একটি টিভি চ্যানেলের একজন ক্যামেরাম্যান তখনই বর্ণনা করেন, তিনি নিজের চোখে পাঁচ ট্রাক লাশ সরাতে দেখেছেন।
অন্য একটি সূত্রে দাবি করা হয়, সে সময় মাতুয়াইল ও পিলখানার দিকে লাশভর্তি বেশ কয়েকটি গাড়ি যায়। জুরাইন কবরস্থান ও আজিমপুর কবরস্থানে বেওয়ারিশ লাশ দাফন হলেও রেকর্ড রাখতে দেওয়া হয়নি। শাপলা চত্বরের লাশ গুম করার পর দমকল বাহিনী ও ওয়াসা থেকে পানির গাড়ি আনিয়ে রক্তাক্ত শাপলা চত্বর ধুয়েমুছে পরিষ্কার করে সব আলামত নষ্ট করে দেওয়া হয়। গণহত্যার ওই ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য হেফাজত নেতাদের দেখে দেখে মামলা দেওয়া হয়। ঢাকায় এমন ৫৩টি এবং সারা দেশে ৮০টি মামলায় হেফাজতে ইসলামের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়। মাদরাসায় মাদরাসায় হানা দিয়ে বলে দেওয়া হয়, কোনোকিছু প্রকাশ করা হলে রেহাই দেওয়া হবে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আলেম-ওলামা ও মাদরাসার ছাত্রদের সম্পূর্ণ চুপ থাকতেও হুকুম দেয়।
শাপলা চত্বরে ২০১৩ সালের ৫ মে’র রাতটি ছিল রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক নৃশংস হত্যাযজ্ঞের এক ভয়ংকর রাত। ওই রাতে মতিঝিল এলাকায় বিদ্যুৎ বন্ধ করে দিয়ে ‘ভয়ংকর এক নৃশংস পরিকল্পনা’ বাস্তবায়ন করে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি যৌথ অভিযানের মাধ্যমে। অভিযানে গুলি, টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড দ্বারা আক্রমণ চালিয়ে হেফাজতে ইসলামের আলেম-ওলামা, মাদরাসা পড়ুয়া ছাত্র ও এতিম শিশুদের বিপুল সংখ্যায় নিষ্ঠুরভাবে হত্যা ও আহত করে বিভীষিকাময় অবস্থার সৃষ্টি করে, যা ছিল ইতিহাসের এক নজিরবিহীন ন্যক্কারজনক ঘটনা। ওই ঘটনা ঢাকায় একাত্তরের ২৫ মার্চের কালরাতে পাক হানাদার বাহিনীর সার্চলাইট অপারেশনের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।
শাপলা চত্বরে সমাবেশ ও গণহত্যার প্রেক্ষাপট যেভাবে তৈরি হয়
মুক্তমতের নামে মহান আল্লাহ, মহানবী হজরত মুহম্মদ (সা.) ও ইসলামের মৌলিক বিধিবিধানের বিরুদ্ধে এক শ্রেণির ব্লগার ব্লগে ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অশালীন ও কুরুচিপূর্ণ লেখালেখি একটানা চালাতে থাকে। ব্লগারদের এমন সাম্প্রদায়িক উসকানির ব্যাপারে তৎকালীন শেখ হাসিনার সরকার ছিল সম্পূর্ণ নিশ্চুপ। উল্টো ব্লগারদের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ জানালে জঙ্গি ও সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে নেমে আসত অত্যাচার, নির্যাতনের খড়গ। এমনই এক প্রেক্ষাপটে মুসলমানদের ঈমান-আকিদা রক্ষা এবং ইসলাম অবমাননার বিরুদ্ধে ২০১০ সালে ‘হেফাজতে ইসলাম’ নামে একটি অরাজনৈতিক সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। ইসলামবিদ্বেষী কথাবার্তা যখন ব্যাপকভাবে চলতে থাকে, তখন হেফাজতে ইসলাম বড় বড় সমাবেশ আয়োজন করে এর প্রতিবাদ জানাতে থাকে। শেখ হাসিনা ও তার আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতার মসনদ হারানোর ভয়ে হেফাজতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লাসহ অন্যদের ফাঁসি নিশ্চিতের দাবিতে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ গড়ে তোলা হয়। শেখ হাসিনার সরকার এর পৃষ্ঠপোষকতা করে। গণজাগরণ মঞ্চের নায়ক হিসেবে নির্বাচন করা হয় ডা. ইমরান এইচ সরকারকে। শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ অবস্থান নেয়। সেখানে ইমরান এইচ সরকার যা নির্দেশ দিতেন, সচিবালয়সহ সর্বত্র তা পালিত হতো। গণজাগরণ মঞ্চ থেকে আমার দেশ, সংগ্রাম, নয়া দিগন্তসহ বিভিন্ন পত্রিকা এবং ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশসহ বিভিন্ন ইসলামী ব্যাংক বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়।
তাদের ফ্যাসিবাদী ভূমিকা তুলে ধরে ‘শাহবাগে ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি’ শিরোনামে রিপোর্ট প্রকাশ করে। শাহবাগীদের ইসলামবিদ্বেষী অবস্থান ও ফ্যাসিবাদী আচরণের প্রতিবাদে হেফাজতে ইসলাম রাজধানীতে বিশাল সমাবেশ করে ১৩ দফা দাবি মেনে নেওয়ার জন্য সরকারকে ২০১৩ সালের ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত আল্টিমেটাম দেয়। দাবি মানা না হলে ৫ মে ২০১৩ ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করে হেফাজতে ইসলাম। কিন্তু ওই দাবি সরকার মানেনি। ফলে ৫ মে’র নির্ধারিত দিনে সারা দেশ থেকে লাখ লাখ ওলামা-মাশায়েখ ও তৌহিদী জনতা ঢাকা আসে। ঢাকা মহানগরীর ছয়টি প্রবেশমুখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অবস্থান নেয়। কিন্তু লাখো জনতার বাঁধভাঙা স্রোত আটকানো যায়নি। বেলা ১১টা থেকেই বিশাল বিশাল মিছিল শাপলা চত্বর অভিমুখে রওনা হয়। একপর্যায়ে মতিঝিলের শাপলা চত্বরসহ পুরো এলাকা স্মরণকালের বৃহত্তম সমাবেশে রূপ নেয়। কেঁপে ওঠে শেখ হাসিনার মসনদ। তৎক্ষণাৎ তিনি জরুরি বৈঠকে বসে সমাবেশ ভণ্ডুল করার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেন। পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির আস্থাভাজন কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্তটি জানিয়ে হেফাজত নির্মূলের নির্দেশ দেন। আওয়ামী লীগের তৎকালীন মহাসচিব সৈয়দ আশরাফ পুলিশ সদর দপ্তরে গিয়ে বিশেষ সভা করেন পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি কর্মকর্তাদের সঙ্গে। ডিএমপি কমিশনার আগে থেকেই ছক অনুযায়ী পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে রেখেছিলেন। রাতে সে পরিকল্পনা অতিনিষ্ঠুর কায়দায় বাস্তবায়ন করা হয়।
শাপলা চত্বর অভিযানে লোকবল ও গোলাবারুদ ব্যবহার
শাপলা চত্বরে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির যৌথ অভিযান রাত ১০টার পর থেকেই শুরু হয়। তিন দিক ঘিরে ফেলে আক্রমণ শুরু হয়। দক্ষিণে টিকাটুলির দিকটি সমাবেশের লোকজন চলে যাওয়ার জন্য খোলা রাখা হয়। রাত ১টা থেকে শাপলা চত্বর ও আশপাশের এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। বিদ্যুৎ না থাকায় সৃষ্টি হয় অন্ধকার-ভৌতিক পরিবেশের। রাত সোয়া ২টা থেকে অসহায় আলেম-ওলামা ও মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকদের ওপর শুরু হয় হত্যাযজ্ঞ।,
ওই অভিযান যে কত ভয়ংকর এবং লোমহর্ষক ছিল, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যবহৃত অস্ত্র ও গোলাবারুদের সরকারি হিসাব থেকেই তা বোঝা যায়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসাবে ৫ মে ২০১৩-এর অপারেশনে দেড় লক্ষাধিক গোলাবারুদ ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে ছিল ৮০ হাজার টিয়ারশেল, ৬০ হাজার রাবার বুলেট, পাঁচ হাজার শটগানের গুলি এবং ১২ হাজার সাউন্ড গ্রেনেড। পিস্তল ও রিভলবারজাতীয় ক্ষুদ্র অস্ত্র এবং এলএমজি, এসএমজি, চাইনিজ রাইফেলের ৩০০ রাউন্ড গুলিও ব্যবহৃত হয় ওই অপারেশনে। এর পাশাপাশি আওয়ামী ক্যাডারদের অস্ত্রবাজিও ছিল উল্লেখ করার মতো।
অভিযানে পুলিশের পাঁচ হাজার ৭১২ জন, র্যাবের এক হাজার ৩০০ জন এবং বিজিবির ৫৭৬ সদস্য অংশ নেয়। এর বাইরে বিজিবির ১০ প্লাটুন সদস্য ছাড়াও এপিবিএন এবং র্যাব-পুলিশের বিপুলসংখ্যক সদস্যকে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে রাখা হয়।
অভিযানের দায়িত্বে যারা ছিলেন
শেখ হাসিনার নির্দেশে শাপলা চত্বর ক্লিয়ার করার জন্য বেনজীর আহমেদ, জিয়াউল আহসান এবং আজিজ আহমেদ ছাড়াও দায়িত্বে ছিলেন পুলিশের সাবেক আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার, অতিরিক্ত আইজিপি শহীদুল ইসলাম, র্যাবের ডিজি মোখলেসুর রহমান, ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদ, র্যাব-১০-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল ইমরান, র্যাব-৩-এর অধিনায়ক মেজর সাব্বির, র্যাব-১-এর পরিচালক লে. কর্নেল কিসমত হায়াত, র্যাব-৪-এর পরিচালক কামরুল হাসান, বিজিবির কর্নেল এহিয়া আজম খানসহ পাঁচ কমান্ড অফিসার, হাইওয়ে রেঞ্জের ডিআইজি আসাদুজ্জামান মিয়া, এসবির অতিরিক্ত ডিআইজি মাহবুব হোসেন, মতিঝিল বিভাগের এডিসি এসএম মেহেদী হাসান, ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার আবদুল জলিল মণ্ডল, যুগ্ম কমিশনার শেখ মারুফ হাসান, উপকমিশনার আনোয়ার হোসেন, এডিসি আসাদুজ্জামান, এডিসি মোহাম্মদ মাইনুর হাসান, রমনা বিভাগের এডিসি মঞ্জুর রহমান, ডিবির অতিরিক্ত উপকমিশনার মশিউর রহমান, ডিবি দক্ষিণের এডিসি নাসির উদ্দিন খান, লালবাগের তৎকালীন ডিসি হারুনুর রশীদ ও উপকমিশনার খান মোহাম্মদ রেজওয়ান।
শাপলা সমাবেশ গুঁড়িয়ে দেওয়ার ‘বীরত্ব’ দেখানোর জন্য এদের অনেককেই পুরস্কৃত করা হয়। বেনজীর আহমেদ পুলিশের আইজি হন, লে. কর্নেল জিয়াউল আহসানকে একের পর এক পদোন্নতি ও দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাকে লে. জেনারেল পদে উন্নীত করা হয়। হাসান মাহমুদ খন্দকারকে বিদেশে রাষ্ট্রদূত করা হয়। জেনারেল আজিজ আহমদকে সেনাবাহিনীর প্রধান করা হয়। হেফাজতের সমাবেশ দমনে বিশেষ কৃতিত্বের জন্য পুলিশের পদক দেওয়া হয় অনেককে। এর মধ্যে ডিবি হারুন ছিলেন অন্যতম। এই ডিবি হারুনই লালবাগ মাদরাসায় হেফাজতের প্রধান আল্লামা শফিসহ অন্যদের অবরুদ্ধ করে সমাবেশ সমাপ্ত ঘোষণার জন্য চাপ দিতে থাকেন। কিন্তু তারা এ ব্যাপারে অস্বীকৃতি জানালে ডিবি হারুন আল্লামা শফিকে বিমানবন্দরে নিয়ে যান এবং নিজের টাকায় টিকিট কিনে বিমানে তুলে তাকে হাটহাজারী পাঠিয়ে দেন। হেফাজত নেতাকর্মীদের শায়েস্তা করতে তিনি শক্ত হাতে দমন অভিযানও চালান।
শাপলা চত্বর গণহত্যায় নিহত-আহতদের সংখ্যা
২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বর গণহত্যায় নিহত-আহতদের প্রকৃত সংখ্যা এখনো অজানা। তবে বিভিন্ন সূত্রের তথ্য অনুযায়ী এ সংখ্যা ৩০০-এর কম নয়। সেদিন হেফাজতসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে দুই হাজার ৫০০ লোক হত্যার শিকার ও দশ হাজারের বেশি গুরুতর আহত হওয়ার কথা বলা হয়। ৫ মে রাতে যৌথ অভিযানের আগেই সন্ধ্যা নাগাদ রাজধানীতে আওয়ামী লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, শ্রমিক লীগ, যুবলীগ-ছাত্রলীগের হামলা ও সংঘর্ষে হেফাজতের কর্মীসহ ২২ জন মারা যান। গণহত্যার পর ডিএমপি কমিশনার বেনজীর আহমদ দাবি করেন, যৌথ অভিযানে একজনও মারা যায়নি, শান্তিপূর্ণভাবে অভিযান সম্পন্ন হয়েছে। পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের পক্ষ থেকে বলা হয়, ১৩ জন নিহত হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২৮ জন নিহতের একটি তালিকা তৈরি করলেও নাম-ঠিকানা প্রকাশ করেনি। ঘটনা তদন্তের জন্য বিচারপতি সৈয়দ আমীরুল ইসলামের নেতৃত্বে সরকার একটি গণতদন্ত কমিশন গঠন করে। এর সদস্য সচিব ছিলেন ঘাদানিক নেতা শাহরিয়ার কবির। তড়িঘড়ি করে তারা একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করে। এতে হেফাজতের তাণ্ডবে ৩৯ জন নিহত হয় উল্লেখ করে বলা হয়, নিহতের কেউই শাপলা চত্বরের মূল অভিযানে মারা যায়নি।
শাপলা চত্বর গণহত্যা নিয়ে প্রথম অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রকাশ করে মানবাধিকার সংগঠন অধিকার। ২০১৩ সালের ১০ জুন তাদের এ-সম্পর্কিত প্রাথমিক তথ্যানুসন্ধান রিপোর্টে বলা হয়, শাপলা চত্বরে গুলিতে ৬১ জন হত্যার শিকার হয়েছে। রিপোর্টে তাদের নাম-ঠিকানা বিস্তারিতভাবে প্রকাশ করা হয়। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর রিপোর্টে বলা হয়, শাপলা চত্বরে ৫৮ জন নিহত হয়েছে। আলজাজিরার খবরেও ৫৪ জন নিহত হওয়ার কথা বলা হয়।
২০১৩ সালের ৫ মে’র ঘটনায় অনেক লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়। বেওয়ারিশ লাশ দাফন করে থাকে আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম। সংগঠনটির ২০১৪ সালের ৯ অক্টোবর তৎকালীন সহকারী পরিচালক আ. হালিম স্বাক্ষরিত একটি নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৩ সালের মে মাসে ৩৬৭টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন হয়েছে।
২০১০ সালের জুলাই থেকে ২০১৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত মোট ৫২ মাসের তথ্য রয়েছে ওই নথিতে। লাশ দাফন কলামে প্রতি মাসে কত বেওয়ারিশ লাশ দাফন করা হয় তার হিসাব দেওয়া আছে। ওই নথিতে দেখা যায়, কেবল ২০১৩ সালের মে মাসের সংখ্যাটি বাদ দিয়ে অন্য ৫১ মাসের মধ্যে ২০১০ সালের জুলাই মাসে সর্বনিম্ন ৫০টি এবং ২০১২ সালের নভেম্বর মাসে সর্বোচ্চ ১৪৫টি লাশ দাফন করে আঞ্জুমান। ২০১৩ সালের মে মাসে অস্বাভাবিক ৩৬৭টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন হয়েছে। এ সংখ্যা থেকে ২০১২ সালের সর্বোচ্চ ১৪৫টি লাশ বাদ দিলেও দেখা যায়, ওই মাসে ২২২টি অতিরিক্ত লাশ দাফন হয়েছে। ৫১ মাসে এক হাজার ৬৩টি লাশ দাফন হয়। গড় করলে প্রতি মাসে ৯৭টি লাশ দাফন হয়েছে। বেওয়ারিশ লাশের সংখ্যা ও পরিচয় পাওয়া হেফাজতে ইসলামের তালিকা এবং অধিকারের তালিকা যোগ করলে ৫ মে’র ঘটনায় ৩০০-এর অধিক হত্যার চিত্র পাওয়া যায়।
হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব আল্লামা সাজিদুর রহমান জানান, ৫ মে শাপলা চত্বরের ঘটনায় শহীদের সংখ্যা তালিকাভুক্ত করার জন্য উদ্যোগ নিয়েছেন তারা। এ বিষয়ে সংগঠনের যুগ্ম মহাসচিব ফজলুল করিম কাশেমীর নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তিনি জানান, হেফাজতের ওপর রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর নিয়ন্ত্রণের কারণে তারা কাজটি করতে পারেননি। তবে প্রাথমিক হিসাবে তাদের কাছে ৭০ থেকে ৮০ জন হত্যার শিকার ব্যক্তির তথ্য রয়েছে।
সংসদে শেখ হাসিনার উপহাস
শাপলা চত্বর গণহত্যার পর সংসদে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনা উপহাস করে বলেছিলেন- ‘শাপলা চত্বরে হেফাজতিরা গায়ে লাল রঙ লাগিয়ে রাস্তায় পড়েছিল। পুলিশ ডাক দিলেই উঠে দিত দৌড়। লাশ দৌড় দেয় আর কী!’
সেদিন এভাবেই তিনি নৃশংস ওই গণহত্যার বিষয়টি পাশ কাটিয়ে যান। অথচ শত শত হেফাজত নেতাকর্মী গুলিতে হত্যার শিকার হন। কাতরাচ্ছিলেন আহত হয়ে। জঙ্গলের হিংস্র জীব-জানোয়ারের প্রতিও দয়া দেখানো হয় কিন্তু সেদিন অসহায়-নির্যাতিত মানুষগুলোর প্রতি কোনো ধরনের সহানুভূতি দেখানো হয়নি।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ ও মামলা দায়ের
শাপলা চত্বর গণহত্যার ঘটনায় হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের হত্যা-নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা ও অভিযোগ দায়ের হয়েছে। হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে ওই গণহত্যার জন্য ৫০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম জানান, ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনাসহ ৩৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছে। মামলাটিয় তদন্ত শুরু হয়েছে। তদন্তের পর প্রকৃত দোষীদের চিহ্নিত করে বিচারের সম্মুখীন করা হবে।
অধিকার-এর বক্তব্য
মানবাধিকার সংস্থা অধিকার-এর পরিচালক এএসএম নাসিরউদ্দিন এলান জানান, শাপলা চত্বরের সমাবেশকে কেন্দ্র করে নিরাপত্তা বাহিনীর বিচারবহির্ভূত হত্যার বিষয়ে অধিকার দেশব্যাপী তথ্যানুসন্ধান শুরু করে। ভিকটিমদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্যানুসন্ধান করা হয়। আমরা অনুসন্ধানের মাধ্যমে ৬১ জনের তালিকা পাই নাম-ঠিকানাসহ, যাদের গুলিতে হত্যা করা হয়। তালিকাটি প্রকাশের পর শেখ হাসিনা ক্ষিপ্ত হন।
সরকার চাপ দিতে থাকে তাদের তালিকার বিস্তারিত জানানোর জন্য। কিন্তু আমরা ভুক্তভোগী পরিবারগুলো সরকারের রোষানলে পড়তে পারে- এ আশঙ্কায় তালিকা দেইনি। আমরা সরকারকে জানাই, অবসরপ্রাপ্ত একজন বিচারপতির নেতৃত্বে বিচার বিভাগীয় কমিশন হলে তাদের কাছে তালিকা দেওয়া হবে। এতে সরকার আরো ক্ষিপ্ত হয়ে অধিকারপ্রধান আদিলুর রহমান খান শুভ্র এবং আমাকে গ্রেপ্তার করে। আমাদের দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। নাসিরউদ্দিন এলান বলেন, একটি কমিউনিটিকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য ওই গণহত্যা চালানো হয়েছিল। এত অল্প সময়ে এত মানুষের হত্যার ঘটনা পাকহানাদার বাহিনীর নৃশংসতাকেও ছাপিয়ে গেছে।’