নিজস্ব প্রতিবেদক: বাগেরহাটের রামপালে নির্মিত ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের মোট আয়ের ৬৪ শতাংশই এসেছে ক্যাপাসিটি চার্জ থেকে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের তুলনায় অস্বাভাবিক হারে ক্যাপাসিটি চার্জ ওঠায় প্রকল্পের কার্যকারিতা ও অর্থনৈতিক যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ-ভারত যৌথ উদ্যোগে গঠিত বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফপিসিএল) পরিচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৩ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ইউনিট (৩৪৫ কোটি ইউনিট) বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে। এ সময়ে কেন্দ্রটির মোট আয় ছিল ৫ হাজার ১৪০ কোটি টাকা, যার মধ্যে ৩ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা এসেছে ক্যাপাসিটি চার্জ থেকে। বাকি ২ হাজার ১৪২ কোটি টাকা এসেছে এনার্জি চার্জ তথা জ্বালানি ও আনুষঙ্গিক খাত থেকে।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, কেন্দ্রটি স্বাভাবিক উৎপাদনে থাকলে ক্যাপাসিটি চার্জ কোনোভাবেই আয়ের সিংহভাগ হওয়ার কথা নয়। প্রকল্পের আর্থিক কাঠামো, ব্যয় বৃদ্ধি ও উৎপাদন ঘাটতি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে।
ব্যাপক ব্যয়, কম উৎপাদন
বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অনুমোদিত ব্যয় ছিল ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা (তৎকালীন ডলার বিনিময় হার অনুযায়ী)। কিন্তু বিআইএফপিসিএলের সর্বশেষ হিসাব বলছে, প্রকল্পের মোট ব্যয় দাঁড়িয়েছে ২৩ হাজার ৭১৪ কোটি টাকা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেন্দ্রটি বছরে গড়ে ৯০০ কোটি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রাখলেও গত অর্থবছরে উৎপাদিত হয়েছে মাত্র ৩৪৫ কোটি ইউনিট। এর কারণ হিসেবে যান্ত্রিক ত্রুটি, কয়লা সংকট এবং কেন্দ্র বারবার বন্ধ হয়ে যাওয়া উল্লেখ করা হচ্ছে। ২০২৩ সালে কেন্দ্রটি অন্তত সাতবার বন্ধ ছিল বলে জানা গেছে।
পায়রা কেন্দ্রের তুলনায় অনেক পিছিয়ে
একই সক্ষমতার পটুয়াখালীর পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৭৫৫ কোটি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে। সেখানে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ বিক্রি থেকে আয় হয়েছে ১৩ টাকা ১৪ পয়সা, যার মধ্যে ক্যাপাসিটি চার্জ ৬ টাকা ৫৪ পয়সা। তুলনায় রামপালে প্রতি ইউনিট ক্যাপাসিটি চার্জ দাঁড়িয়েছে ৯ টাকা ৪৯ পয়সা, যা প্রায় ৫০ শতাংশ বেশি।
বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগ
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, ‘রামপাল প্রকল্পটি মূলত ভারতকে আর্থিক সুবিধা দিতেই নেয়া হয়েছে। এতে বিপিডিবিকে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কিনতে হচ্ছে, যা দেশের জন্য আর্থিক বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
অন্যদিকে, বুয়েটের অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, ‘বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি অনুযায়ী বছরে ৮৫ শতাংশ প্ল্যান্ট ফ্যাক্টরে কেন্দ্র চালানোর কথা। কিন্তু বারবার কেন্দ্র বন্ধ হওয়ায় ক্যাপাসিটি চার্জ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে।’
সরকার বলছে রিভিউ চলছে
বিদ্যুৎ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান জানান, রামপালের বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ অন্যান্য কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রের তুলনায় বেশি পড়ছে। মাতারবাড়ীতে যেখানে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৮ টাকা ৪৫ পয়সা, সেখানে রামপালে তা ১৩-১৪ টাকা। তিনি বলেন, ‘রামপালের ক্যাপাসিটি চার্জ ও অন্যান্য ব্যয় রিভিউ করা হচ্ছে। প্রয়োজনে সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হবে।’
বিদ্যুৎ খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা, ব্যয় এবং আর্থিক কাঠামো পুনর্ব্যবচ্ছেদ ছাড়া ক্যাপাসিটি চার্জের বোঝা আরও বাড়বে। এতে অর্থনীতি এবং বিদ্যুৎ খাতের ওপর নেতিবাচক চাপ সৃষ্টি হবে।
ইপেপার
Copyright © 2025 ThikanaTV.Press. All rights reserved.