নিজস্ব প্রতিবেদক: চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্য ছিল ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। তবে অর্থবছরের মাঝপথে এ লক্ষ্য সংশোধন করে নামিয়ে আনা হয় ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটিতে।
এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসে আদায় হয়েছে ২ লাখ ৭৮ হাজার ২৪২ কোটি টাকা। ফলে বাকি দুই মাসে লক্ষ্যমাত্রা পূরণে আদায় করতে হবে আরও ১ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা, যা সংশোধিত লক্ষ্যের প্রায় ৪০ শতাংশ। অর্থনীতিবিদদের মতে, বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় এ লক্ষ্য অর্জনের সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ।
এর মধ্যেই আসছে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে এনবিআরের জন্য রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা। সরকারের মোট রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে ৮৮ দশমিক ৪৪ শতাংশ আদায়ের দায়িত্ব এনবিআরের ওপরই বর্তাবে।
লক্ষ্যমাত্রা বাড়ছে, বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা
পূর্ববর্তী অর্থবছরগুলোর পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত এক যুগে কখনোই এনবিআর নির্ধারিত রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সক্ষম হয়নি। এমনকি লক্ষ্যমাত্রা কমিয়েও কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আদায় করা যায়নি।
এনবিআরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে তাদের প্রত্যক্ষ কোনো ভূমিকা নেই। মূলত সরকারের ব্যয় কাঠামোর ভিত্তিতে সম্ভাব্য রাজস্ব উৎসগুলো বিবেচনা করে একটি অনুমান নির্ধারণ করা হয়, যা পরে এনবিআরের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। এ প্রক্রিয়ায় তেমন কোনো গবেষণা বা তথ্যনির্ভর বিশ্লেষণ থাকে না।
কাঠামোগত দুর্বলতা ও চাপের রাজনীতি
রাজস্ব আদায়ে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি না হওয়ার পেছনে রাজনৈতিক চাপ, কর অব্যাহতির সংস্কৃতি, প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং দুর্নীতির দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
২০২১-২২ অর্থবছরে এনবিআরের পর্যালোচনায় দেখা গেছে, কর অব্যাহতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ২ দশমিক ৯ শতাংশের সমান। অর্থাৎ, সরকারের মোট সম্ভাব্য রাজস্ব আয়ের প্রায় এক-তৃতীয়াংশই কর অব্যাহতির কারণে হারিয়ে যাচ্ছে।
বিশেষ করে, রাজনৈতিক বিবেচনায় এবং প্রভাবশালী মহলের চাপে বিভিন্ন ব্যবসায়িক গোষ্ঠীকে দেওয়া কর ছাড়ের ফলে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য পূরণে বড় ধরনের ঘাটতি তৈরি হয়েছে।
এমন বাস্তবতায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) কর অব্যাহতির সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। এরই অংশ হিসেবে এনবিআর একটি নীতিমালা প্রণয়ন করেছে, যা আগামী ১ জুলাই থেকে কার্যকর হওয়ার কথা রয়েছে। নতুন নীতিমালায় কর অব্যাহতির বিষয়টি সংসদের অনুমোদনের আওতায় আনা হয়েছে।
চাপ বাড়ছে, দক্ষতা বাড়ছে না
প্রতি বছরই রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা বাড়ছে, কিন্তু এনবিআরের দক্ষতা ও অবকাঠামোগত সক্ষমতা সে অনুযায়ী বাড়ানো হয়নি। আধুনিক প্রযুক্তি, দক্ষ মানবসম্পদ ও প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের অভাবে কাঙ্ক্ষিত সংস্কার সম্ভব হচ্ছে না।
অন্যদিকে, রাজস্ব আদায় বাড়াতে গিয়ে পণ্যের ওপর শুল্ক ও ভ্যাট বাড়ানো হয়, যার ফলাফল পড়ে সরাসরি সাধারণ জনগণের ওপর। ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করছেন, একই করদাতার ওপর বারবার করের বোঝা চাপানো হচ্ছে।
এ ছাড়া এনবিআরের কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অনিয়ম এবং করদাতাদের হয়রানির অভিযোগও রয়েছে।
অর্থনীতিবিদদের সতর্কবার্তা
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “উচ্চাভিলাষী বাজেট প্রণয়ন করে এনবিআরের ওপর অতিরিক্ত রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফলে সংস্থাটি সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে, এবং এটি বারবার ঘটছে। অর্থনীতির আকার বাড়লেও রাজস্ব সংগ্রহ সে অনুপাতে বাড়ছে না।”
এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থতার পেছনে রয়েছে নীতিগত দুর্বলতা, বাস্তবতা বিবর্জিত লক্ষ্যমাত্রা, অব্যবস্থাপনা এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। ভবিষ্যতে এই অবস্থা কাটিয়ে উঠতে হলে প্রয়োজন:
বাস্তবসম্মত লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ
কর অব্যাহতি সংস্কারের কঠোর বাস্তবায়ন
এনবিআরের সক্ষমতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা
কর ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা