ঠিকানা টিভি ডট প্রেস: রাজনৈতিক দলগুলোর গণশত্রুতে পরিণত হওয়া সাহসিকতা। আর সর্বদলীয় প্রশংসায় ভাসলে সেটা তেলবাজি। সংবাদমাধ্যমের বেলায় কথাটি শতভাগ খাঁটি। দেশের জনপ্রিয় দৈনিক প্রথম আলো তার বয়সকালে সব ক্ষমতাসীন দলেরই শত্রুতে পরিণত হয়েছে। ফলে রাজনীতির বাইনারি ট্যাগিং-এর ভেতরেও যুক্তির বিচারে দৈনিকটি ভালো ও সাহসী সাংবাদিকতা করে আসছে।
যেমন, ১৯৯৮ সালে প্রকাশের আলোয় আসতে না আসতেই পত্রিকাটিতে বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। ২০০০ সালে ক্ষমতায় এসে বিএনপিও একই হাল করে ছাড়ে। এক এগারোর সরকারের সময়ও বিপদে পড়তে হয়। ২০০৯-২০২৪ অবধি তো বিরোধীদলের ভূমিকা পালন করতে গিয়ে সরকারের নিষ্ঠুর কোপানলে পড়ে।শুধু বিজ্ঞাপন বন্ধই নয়, পত্রিকা বন্ধে উচ্চ পর্যায়ের ষড়যন্ত্রসহ কয়েক দফায় হামলাও করা হয়।
ভয়েস অব আমেরিকার এক প্রতিবেদন বলছে, ১৯৯৮-২০২৩ অবধি প্রথম আলো শতাধিক মামলার মুখোমুখি হয়েছে। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে বড় ভূমিকা রেখেও নতুন বিপদে পড়তে হয়। সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সাররা শেকড় ধরে টেনে অভিযোগ আনে, পত্রিকাটি নাকি দিল্লির বয়ানের ব্যাপারি।
এতদিন পত্রিকা নিয়ে শুধুই বাইনারি ট্যাগিং দেখা গেছে। এবারই প্রথম দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় পত্রিকাটি বয়ানের ফাঁদে পড়ে গেল। মবের আকারে জিয়াফতের জটিলতায় অস্তিত্বের হুমকিতে পড়তে হলো।ইতোমধ্যে ভারতের সঙ্গে বিএনপির আঁতাতের হাইপোথিসিস (ষড়যন্ত্রতত্ত্ব?) চাউর হয়েছে।যখন ‘সংস্কার না নির্বাচন’ ইস্যুতে গণঅভ্যুত্থানের নায়কদের গড়া রাজনৈতিক দলের (এনসিপি) সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব বিপজ্জনকভাবে বেড়েছে।
এমন পরিস্থিতির মধ্যেই এনসিপির তৃতীয় সাধারণ সভার সূত্র ধরে টগবটে নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহর নামে অসত্য তথ্য দিয়ে শিরোনাম করে হঠাৎ শত্রু বাড়িয়ে ফেলল প্রথম আলো। ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় হাসনাতের অভিযোগ, দিল্লি থেকে নিউজটি লিখে দেওয়া হয়েছে!যে প্রতিক্রিয়া নিয়ে আবার কালের কণ্ঠের শিরোনাম, ‘হাসনাতকে নিয়ে মিথ্যাচার: প্রথম আলোর অপসাংবাদিকতা রুখে দেওয়ার আহ্বান। ’
এই ঘটনার মধ্য দিয়ে শুধু প্রথম আলোই নয়, দেশের সব সংবাদমাধ্যমই পড়ল রাজনৈতিক বয়ানের ফাঁদে। এখন থেকে শুধু ট্যাগিং নয়, নিরীহ নিউজগুলোও বয়ানের লেন্সে পর্যবেক্ষণ হতে থাকবে। কারণ, সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী রাজনীতির বয়ান নিয়ে তরুণদের মধ্যে যে গভীর বিশ্লেষণ দেখা গেছে তা সত্যিই বিস্ময়কর। দল বা রাজনীতিকরা কীভাবে বয়ান তৈরি করে আমজনতার ধ্যানধারণা, ভাবনা, সম্মতি, নৈতিকতাকে নিয়ন্ত্রণ করে সেই রহস্যও উন্মুক্ত আলোচনায় আনছেন তারা।
এমন বাস্তবতায় বিপদে পড়তে যাচ্ছে দেশের রাজনীতিনির্ভর সংবাদমাধ্যমগুলো। আগের মতো রাজনৈতিক দলগুলোর বয়ান প্রমোট করার দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে। সাংবাদিক সংগঠনগুলোতে বিশেষ দলের পতাকা উড়িয়ে, নেতাদের সামনে মস্তক অবনত করে সুবিধা নেওয়ার সুযোগও মিলবে না বেশিদিন। কারণ নেতারা সংবাদমাধ্যমের মানহীন সার্ভিসকে অপ্রয়োজনীয়, বিপজ্জনক মনে করতে পারেন।
লিখতে চেয়েছিলাম, দেশীয় গণমাধ্যমের কোয়ালিটি কমে যাওয়া নিয়ে। কিন্তু রাত থেকে আলোচনার মোড় ঘুরে গেছে। তরুণ প্রজন্ম রাজনীতি নিয়ে যে এতটা সমৃদ্ধ, সচেতন তা অনেকের মানতে কষ্ট হলেও সত্য। এমনকি গ্রামের সাধারণ মানুষও এখন রাজনীতির ভণ্ডামি নিয়ে সবচেয়ে বেশি সচেতন। ফলে আগামী দিনে দল ও রাজনীতিকদের গোয়ার্তুমি যেমন বিপদের কারণ হবে তেমনি বয়ান প্রমোট করা গদিসাংবাদিকতাও পড়বে বাণিজ্যিক ঝুঁকিতে।