
নিজস্ব প্রতিবেদক: যুক্তরাষ্ট্রের রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ (পাল্টা শুল্ক) আরোপের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত (আরএমজি) চরম অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। দেশটির সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের আলোচনায় ইতিবাচক অগ্রগতি না হওয়ায় তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের আশঙ্কা, যুক্তরাষ্ট্রে ৩৫ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হলে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। এতে করে দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের সহস্রাধিক পোশাক কারখানায় অন্তত ১০ লাখ শ্রমিক কর্মহীন হওয়ার আশঙ্কা করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
রপ্তানিকারক ও বিশ্লেষকরা বলছেন, অতিরিক্ত শুল্ক চাপ সামাল দিতে না পেরে ক্ষুদ্র ও মাঝারি কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যেতে পারে। বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ-এর শীর্ষ নেতৃবৃন্দ একমত যে, এই শুল্ক পরিস্থিতি দ্রুত রাজনৈতিকভাবে সমাধান না হলে অর্ডার হারাবে উদ্যোক্তারা, আর শ্রমিকদের জন্য তৈরি হবে বিপর্যয়কর পরিস্থিতি।
যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পাল্টা শুল্কারোপের কারণে ইতোমধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে দর-কষাকষির জন্য লবিইস্ট নিয়োগের পরামর্শ দিয়েছেন। তবে সরকারি পর্যায়ে এখনো লবিইস্ট নিয়োগে অগ্রগতি নেই। আগামী সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তৃতীয় দফার বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।
বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, আলোচনার বিষয় শুধুমাত্র শুল্ক নয়, বরং রাজনৈতিক সিদ্ধান্তও গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে বিজিএমইএর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ইনামুল হক খান বলেন, ১ আগস্ট থেকে যুক্তরাষ্ট্র ৩৫ শতাংশ শুল্ক কার্যকর করলে বাংলাদেশ ওই বাজারে প্রতিযোগিতা হারাবে। তিনি বলেন, “এই মুহূর্তে ক্রেতারা নেতিবাচক বার্তা না দিলেও, শিগগিরই পরিস্থিতি পরিবর্তিত হতে পারে।”
সাবেক পরিচালক আশিকুর রহমান তুহিন বলেন, দর-কষাকষির মাধ্যমে যদি বাড়তি শুল্ক কমানো সম্ভব হয়, তবে মার্কিন বাজারে নতুন রপ্তানি সম্ভাবনার দ্বারও খুলে যেতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি ২৮ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৫২ কোটি ৩২ লাখ ডলারে, যা এপ্রিল মাসে ছিল ৭২ কোটি ৬৮ লাখ ডলার। ১ আগস্ট থেকে ৩৫ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হলে এই পতন আরও তীব্র হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
১০ লাখ শ্রমিকের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তায়
বিজিএমইএ সূত্র অনুযায়ী, ক্ষুদ্র ও মাঝারি মিলিয়ে দেশে এমন অন্তত ১১০০টি কারখানা রয়েছে, যেখানে প্রায় ১০ লাখ শ্রমিক কাজ করেন। ছোট কারখানাগুলো বছরে ৫ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত রপ্তানি করে, যেখানে প্রতি কারখানায় গড়ে ৭০০ জন শ্রমিক নিয়োজিত। মাঝারি কারখানাগুলোর রপ্তানি ৫ থেকে ২০ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত, যেখানে গড়ে এক হাজার শ্রমিক কর্মরত। এদের বড় একটি অংশই নারী শ্রমিক।
উদ্যোক্তারা বলছেন, বাড়তি শুল্কের কারণে এদের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে, ফলে তারা অর্ডার হারাবে এবং ধীরে ধীরে কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। এতে শ্রমিকদের বেতন বন্ধ, ছাঁটাই ও ব্যাপক কর্মহীনতার মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
সরকারের করণীয়
সরকার কূটনৈতিক আলোচনার পাশাপাশি কিছু কৌশলগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরকারিভাবে (G2G) তিন লাখ টন গম আমদানিতে সম্মতি, যা অন্যান্য উৎসের তুলনায় বেশি দামে কিনতে হতে পারে। এছাড়া বোয়িং বিমান ক্রয়, তুলা, গ্যাস টারবাইন, সেমিকন্ডাক্টর ও চিকিৎসা সরঞ্জামের আমদানি ইস্যুতে শুল্ক সমন্বয়ের চিন্তাভাবনা চলছে।
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানি বিশ্ব বাজারের মাত্র ০.২৫ শতাংশ হলেও, দেশটিকে ৩৫ শতাংশ শুল্কের আওতায় আনা হয়েছে—যা ১৪টি লক্ষ্যভুক্ত দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ। অথচ বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ৮০ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে এবং প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক এই খাতের ওপর নির্ভরশীল। দেশের একক বৃহত্তম রপ্তানি বাজার যুক্তরাষ্ট্রেই প্রতিবছর প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলারের পোশাক পাঠানো হয়।
খাতসংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, সময়োপযোগী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছাড়া এই সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। সরকারকে অনতিবিলম্বে পদক্ষেপ নিতে হবে, না হলে দেশের রপ্তানি ও শ্রমবাজার একসঙ্গে বড় ধাক্কার মুখে পড়বে।