
নিজস্ব প্রতিবেদক: শেখ মুজিব ও তার কন্যা শেখ হাসিনা দুজনের হাতেই পতন ঘটেছে আওয়ামী লীগের। ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠনের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিব নিজেই আওয়ামী লীগকে বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। আর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রাণভয়ে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান।
এরপর ভারতে বসে অনলাইনে শেখ হাসিনা বিভিন্ন ধরনের উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে আসছেন। পাশাপাশি দেশে অবস্থানরত দলটির নেতাকর্মীরা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত রয়েছেন। এছাড়া চলমান বিচারকার্যে বাধা সৃষ্টির অপচেষ্টার জেরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গতকাল সোমবার আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।
শেখ হাসিনার প্রণীত সন্ত্রাস দমন আইনের অধীনেই দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়। আওয়ামী লীগ ছাড়াও দলটির সব অঙ্গসংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের কার্যক্রমও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারকার্য সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর থাকবে। এ সময় দলটির পক্ষে কোনো ধরনের প্রকাশনা, গণমাধ্যম, অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে কোনো ধরনের প্রচারণা, মিছিল, সভা-সমাবেশ, সম্মেলন আয়োজনসহ কোনো কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা যাবে না।
মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর হাত ধরে দেশের অন্যতম প্রাচীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন টিকাটুলীর কেএম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে প্রতিষ্ঠিত হয়। দলটির প্রথমে নাম ছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’। তখন দলটির সভাপতি নির্বাচিত হন মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ও সাধারণ সম্পাদক করা হয় শামসুল হককে। ওই সময় জেলে থাকা মুসলিম লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক করা হয়। ১৯৫২ সালে দলের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হককে ‘অসুস্থ’ দেখিয়ে শেখ মুজিবকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক করা হয়। পরের বছর ১৯৫৩ সালের সম্মেলনে শেখ মুজিবকে পরিপূর্ণ সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
১৯৫৫ সালে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’ নাম ধারণ করে। নাম পরিবর্তন নিয়ে ওই সময় দলের মধ্যে একটা বিরোধও তৈরি হয়। এদিকে পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তির প্রেক্ষাপটে সৃষ্ট বিরোধে ১৯৫৭ সালে দলটির সভাপতি মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করেন। এদিকে শেখ মুজিব ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
এর আগে ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হলে অন্যান্য দলের মতো আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধের আওতায় পড়ে। এটি ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত বলবৎ ছিল। এদিকে সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে ১৯৬৬ সালে সভাপতি নির্বাচিত হন শেখ মুজিব। এ দায়িত্বে থাকেন ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত। এ সময়ে দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী একই ব্যক্তি হবেন নাÑ এমন সিদ্ধান্ত হলে শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ ছেড়ে দেন। যার ফলে ১৯৭৪ সালে এএইচএস কামরুজ্জামান দলের সভাপতির দায়িত্ব পান।
মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী স্বাধীন দেশে নানা অনিয়ম-দুর্নীতি-দুর্ভিক্ষসহ বিভিন্ন কারণে শেখ মুজিব গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছেড়ে একদলীয় শাসন চালু করেন। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সব রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে একদলীয় শাসনব্যবস্থা চালু করেন শেখ মুজিব। ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ (বাকশাল) গঠন করে তিনি নিজেকে আজীবন দলটির সভাপতি ঘোষণা করেন। এ সময় শেখ মুজিবের হাতে অন্যান্য দলের সঙ্গে আওয়ামী লীগও বিলুপ্ত হয়। তার জীবদ্দশায় এর আগে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে পাকিস্তান সরকার।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর সামরিক আইনে বাকশালের কার্যক্রমসহ সব রাজনৈতিক তৎপরতা বন্ধ করা হয়। রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত মো. সায়েম ১৯৭৬ সালে রাজনৈতিক কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। পরে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চালু করেন। ওই সময় বাকশাল থেকে বেরিয়ে জোহরা তাজউদ্দীনসহ কয়েকজন সিনিয়র নেতা আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত করেন। তবে নেতৃত্বের বিরোধে আওয়ামী লীগ (মালেক) এবং আওয়ামী লীগ (মিজান) দুই ধারায় বিভক্ত হয়।
দ্বিধাবিভক্তি চলাকালে ১৯৮১ সালে বিদেশে নির্বাসনে থাকার পর হঠাৎ দলের সভাপতি নির্বাচিত হন শেখ মুজিবের কন্যা শেখ হাসিনা। ওই বছরই ১৭ মে দেশে ফিরে তিনি দলের দায়িত্বও নেন। এরপর থেকে টানা ৪৪ বছর তিনি একই পদে বহাল ছিলেন। শেখ হাসিনা টানা ১১ মেয়াদে সভাপতির দায়িত্ব পালনকালে ৬ জনকে দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে পেয়েছেন।
শেখ হাসিনার দলের দায়িত্বকালে ২১ বছর পর (১৯৯৬-২০০১ সালে)’ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। ২০০৯ সালে আবার দলটি ক্ষমতায় আসার পর ভোটারবিহীন নির্বাচন, রাতের ভোট ও ডামি ভোটের মাধ্যমে টানা ৪ মেয়াদে ক্ষমতাসীন হয়। এই সাড়ে ১৫ বছরের শাসনকালে দলটি ও তার নেতাকর্মীরা হত্যা, খুন, অর্থ পাচার, লুটপাট, ব্যাপক দুর্নীতিসহ নানা ধরনের অপকর্মে জড়িত হয়। পরে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান। বর্তমানে সেখানেই তিনি অবস্থান করছেন।
আদালতের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও শেখ হাসিনা ভারতে বসে প্রতিনিয়ত অনলাইনে যুক্ত হয়ে নানা উসকানিমূলক বক্তব্য দিচ্ছেন। সরকারকে নানা ধরনের হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন। পাশাপাশি বাংলাদেশে আত্মগোপনে থাকা দলটির নেতাকর্মীরা নানা ধরনের অপকর্মে লিপ্ত রয়েছেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলার বিচারে প্রতিবন্ধকতা তৈরি, জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি, বাংলাদেশের সংহতি, জননিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করার লক্ষ্যে গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী ছাত্র-জনতার ওপর হামলা, উসকানিমূলক মিছিল আয়োজন, রাষ্ট্রবিরোধী লিফলেট বিতরণ এবং ভিনদেশে পলাতক তাদের নেত্রীসহ অন্য নেতাকর্মী কর্তৃক সোশ্যাল মিডিয়ায় অপরাধমূলক বক্তব্য প্রদান, ব্যক্তি ও প্রজাতন্ত্রের সম্পত্তির ক্ষতিসাধনের অপচেষ্টাসহ আইনশৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত রয়েছে দলটি।
শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী কার্যক্রমের প্রেক্ষাপটে ছাত্র-জনতার দাবির মুখে অন্তর্বর্তী সরকার গতকাল সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলার বিচারিক কার্যক্রম চলাকালে আওয়ামী লীগের সব ধরনের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এর মাধ্যমে শেখ হাসিনার হাতেই আওয়ামী লীগ নামক দেশের অন্যতম পুরোনো দলটির পতন হলো।
এদিকে অপরাধী সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগকে বিচারের আওতায় আনতে গত রোববার সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধন করেছে। এর ফলে দলটি বিচারে দোষী সাব্যস্ত হলে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধের মুখোমুখি হতে পারে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক মাহাবুব উল্লাহ আমার দেশকে বলেন, আওয়ামী লীগ যে ফ্যাসিবাদী কর্মকাণ্ড গত সাড়ে ১৫ বছর পরিচালনা করেছে, তাতে দলটির ভবিষ্যৎ দেখছি না। স্বাভাবিকভাবেই দলটির পরিণতি মুসলিম লীগের মতো হতো। তবে সরকার দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধের যে উদ্যোগ নিয়েছে, এই পথ ধরে বিচারিক প্রক্রিয়ায় চূড়ান্ত পরিণতির পথে যাওয়া সম্ভব হবে।
অবশ্য দলটির পেছনে ভারত রয়েছেÑ এমন অভিযোগ তুলে তিনি শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, আপাতত পলাতক আওয়ামী লীগ অন্ধকারে বসে নানা ধরনের কুচক্রান্ত করছে। তারা এগুলো করার সাহস পাচ্ছে এবং ভবিষ্যতে আরো ভয়াবহভাবে করবে; কারণ তার পেছনে ভারতের সহযোগিতা রয়েছে। এটা মোকাবিলার জন্য জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার ওপর গুরুত্বারোপ করেন এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক।’