নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশের অন্যতম বৃহৎ জ্বালানি প্রকল্প মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে দেখা দিয়েছে বড় ধরনের প্রযুক্তিগত বিপর্যয়। বয়লারে ছাই জমে উৎপাদন অর্ধেকে নেমে আসায় জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎসরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে। দীর্ঘদিনের এই ত্রুটিতে ইতোমধ্যে আর্থিক ক্ষতি ছাড়িয়েছে হাজার কোটি টাকা, আর কে নেবে এই দায়—তা নিয়ে শুরু হয়েছে রশি টানাটানি।
দেশের শক্তি খাতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চলতি বছরজুড়ে বড় ধরনের উৎপাদন সংকটে ভুগছে। কেন্দ্রটির বয়লারে ছাই জমে দুই ইউনিটেই বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। এতে ব্যাহত হচ্ছে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ এবং ক্ষতির অঙ্ক ক্রমেই বেড়ে চলেছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, মাতারবাড়ী কেন্দ্র থেকে কমপক্ষে ৯০ শতাংশ উৎপাদন হওয়ার কথা থাকলেও চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রকৃত উৎপাদন হয়েছে গড়ে মাত্র ৫০ শতাংশ। এতে ঘণ্টাপ্রতি মোট উৎপাদন ক্ষতি দাঁড়িয়েছে ৪৮ লাখ ৪০ হাজার মেগাওয়াট। শুধু ক্যাপাসিটি পেমেন্ট হিসেবেই ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৯৫ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১ হাজার ১৬৯ কোটি টাকার বেশি।
বয়লারের এই দীর্ঘস্থায়ী সমস্যার মূল কারণ এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। যান্ত্রিক ত্রুটি নাকি ডিজাইনজনিত সমস্যা—কোনো পক্ষই স্পষ্ট করে দায় স্বীকার করতে রাজি নয়। প্রকল্পের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান বলছে, চুক্তিতে এই ধরনের ক্ষতির দায় তাদের ওপর নেই; তাই তারা দায়িত্ব নেবে না। অন্যদিকে প্রকল্প মালিক কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিপিজিসিবিএল) জানাচ্ছে, যান্ত্রিক ত্রুটিতেই উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে।
বড় প্রকল্পে এমন প্রযুক্তিগত বিপর্যয় শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদনেই নয়, দেশের অর্থনীতিতেও ধাক্কা দিচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। তবে ত্রুটির আসল কারণ, দায়ী পক্ষ এবং সমাধান—সবই এখনো অন্ধকারে।
জানা গেছে, ত্রুটির কারণ অনুসন্ধানের জন্য গঠিত মাতারবাড়ী যৌথ পরামর্শক দল (এমজেভিসি) এখনো চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়নি। এতে প্রকল্প পরিচালনায় স্থবিরতা তৈরি হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, ত্রুটি শনাক্তের নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে (ডিফেক্ট নোটিফিকেশন পিরিয়ড) সমস্যার সমাধান না হলে দায়ভার ঠিকাদারকেই নিতে হবে। কিন্তু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এসটিআইসি সেই দায় নিতে নারাজ। তাদের দাবি, ইঞ্জিনিয়ারিং, ক্রয় ও নির্মাণ চুক্তিতে (ইপিসি) এমন দায়ভার নেওয়ার কোনো ধারা নেই।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিদ্যুৎকেন্দ্রটির ত্রুটি মেরামতের জন্য ১৩৫ কোটি টাকার সংস্কার পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। তবে পুরো কাজ শেষ করতে সময় লাগবে প্রায় ২১ মাস। অন্যদিকে, প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সংস্কারের এ খরচ বহনে অস্বীকৃতি জানিয়ে উল্টো ৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকার মূল্যবৃদ্ধির দাবি তুলেছে।
সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে (ইআরডি) মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের চলমান প্রযুক্তিগত ও পরিচালনাগত সমস্যাগুলো নিয়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে সমস্যাগুলো উঠে আসে। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন ইআরডির অতিরিক্ত সচিব ড. মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। চলমান প্রকল্পের আওতায় উদ্ভূত সমস্যায় অসন্তোষ প্রকাশ করে তিনি বলেন, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যর্থতার মূল কারণগুলো দ্রুত অনুসন্ধান করে সমাধানের ব্যবস্থা নিতে হবে। বিষয়টি দ্রুত এগিয়ে নিতে বিশেষজ্ঞ দলের মাধ্যমে পরীক্ষা করার আহ্বান জানান তিনি।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্প পরিচালক মুহাম্মদ সাইফুর রহমান জানিয়েছেন, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে কেন্দ্রের বয়লারে ছাই জমা (অ্যাশ স্লাগিং) এবং বাধা সৃষ্টি (ফাউলিং) সমস্যা দেখা দিচ্ছে। প্রকল্প থেকে বয়লারের ত্রুটি সংশোধন করে ফের পূর্ণ সক্ষমতায় আনার জন্য প্রকৌশল, ক্রয় ও নির্মাণ ঠিকাদার (ইপিসি) প্রতিষ্ঠানকে অনুরোধ জানানো হলেও তারা কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
তিনি জানিয়েছেন, জাপানি যৌথ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সুমিতোমো-তোশিবা-আইএইচআই করপোরেশন (এসটিআইসি) অভিযোগ করেছে, প্রকল্পে নিম্নমানের বয়লার ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু মাতারবাড়ী যৌথ পরামর্শক প্রতিষ্ঠান (এমজেভিসি) জাপানে বয়লারের নমুনা পরীক্ষা করে উল্লেখযোগ্য কোনো ত্রুটি খুঁজে পায়নি। ত্রুটি শনাক্তে ‘মূল কারণ বিশ্লেষণ’ (রুট কজ অ্যানালাইসিস) করা জরুরি বলে বৈঠকে মত দেন প্রকল্প পরিচালক।
তিনি আরও জানান, ত্রুটি সংশোধনে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান এসটিসি ১৩৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ২১ মাসের একটি সংস্কার পরিকল্পনা (রেকটিফিকেশন প্ল্যান) দিয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক পরামর্শক সংগঠন ফিডিক (ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব কনসালটিং ইঞ্জিনিয়ার্স) দলিলে ইপিসি কর্তৃক এমন ব্যয় নির্বাহের উল্লেখ না থাকায় এ বিষয়ে জটিলতা দেখা দিয়েছে। উল্টো ইপিসি বকেয়া বিল পরিশোধে চাপ দিচ্ছে। এ ছাড়া ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান এসটিআইসি কুলিং ওয়াটার পাম্পের সমস্যা আংশিকভাবে সমাধানের চেষ্টা করলেও সার্বিক সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না।
বৈঠকে সাইফুর রহমান বলেছেন, ৩০ বছরের প্ল্যান্ট লাইফ বিবেচনায় সিপিজিসিবিএল মূল যন্ত্র প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ওরিজিনাল ইক্যুইপমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারারের (ওইইএম) সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি রক্ষণাবেক্ষণ চুক্তি করতে আগ্রহী। এজন্য তারা ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে প্রথম পাঁচ বছরে প্রয়োজনীয় খুচরা যন্ত্রাংশের তালিকা দিতে বলেছে।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে সিপিজিসিবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. নাজমুল হক এবং মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রধান প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক মুহাম্মদ সাইফুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তাদের ব্যবহৃত সরকারি মোবাইল ফোনে বারবার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
তবে সিপিজিসিবিএলের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেছেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের বয়লারে ছাই জমছে। ফলে কাঙ্ক্ষিত বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে না। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন যেমন কমে গেছে, একইভাবে ক্যাপাসিটি পেমেন্টের কারণে বিপুল পরিমাণে আর্থিক ক্ষতি হয়ে গেছে। কী কারণে ছাই জমছে, সেটার কারণ বের করা যায়নি। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা করে ত্রুটি খুঁজে বের করার পাশাপাশি বয়লার পরিষ্কারের চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে যে সংস্কার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, সেটি দীর্ঘমেয়াদি।’
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকার মূল্যবৃদ্ধির যে প্রস্তাব দিয়েছে, সেখানে বেশকিছু অস্পষ্টতা রয়েছে। সিপিজিসিবিএল এখন অস্পষ্টতার কারণ যাচাই করছে। এদিকে, করোনাকালীন অতিরিক্ত খরচ ও ভ্যাট ফেরতের বকেয়া দাবির (ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স-আসিসি) সালিশ নিষ্পত্তির জন্য মূল দাবির ১০ শতাংশ) ক্ষেত্রে সিপিজিসিবিএল ও এসটিআইসি একটি নিষ্পত্তি চুক্তি করতে যাচ্ছে। সেটি অবশ্য চূড়ান্ত রায়ের পর কার্যকর হবে।,
বিদ্যুৎ বিভাগের একজন প্রতিনিধি জানান, চুক্তি অনুযায়ী, কেন্দ্রের সর্বনিম্ন ৯০ শতাংশ প্রাপ্যতা (অ্যাবিলিবিলিটি) থাকা উচিত ছিল। কিন্তু চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রকৃত প্রাপ্যতা ইউনিট-১-এ ৪৭ শতাংশ এবং ইউনিট-২-এ ৫৩ দশমিক ৬ শতাংশ। এর ফলে ঘণ্টায় ৪ দশমিক ৮৪ মিলিয়ন মেগাওয়াট (এমডব্লিউএইচ) বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষতি হয়েছে। টাকার অঙ্কে (ক্যাপাসিটি পেমেন্ট) এ ক্ষতি ১ হাজার ১৬৯ কোটি। কিন্তু চুক্তিতে ধারা উল্লেখ না থাকায় ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান বারবার এ ক্ষতিপূরণের দাবি প্রত্যাখ্যান করছে।
জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) দাবি, প্রযুক্তিগত ও আর্থিক জটিলতা প্লান্টের কার্যকারিতা প্রভাবিত করছে। তারা বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন। সংস্থাটি বিদ্যুৎ বিভাগ ও ইআরডির যৌথ উদ্যোগে সমাধান প্রক্রিয়া জোরদারের আহ্বান জানিয়েছে। বৈঠকে জাইকার প্রতিনিধি বলেছেন, কারিগরি সমস্যার প্রকৃত কারণ সম্পর্কে জাইকাও এখনো অবগত নয়। ঠিকাদার কর্তৃক বিল পরিশোধ এবং কারিগরি ত্রুটির মধ্যে প্রাধিকার নির্ণয়ে যত্নবান হওয়া প্রয়োজন। এ বিষয়ে জাইকা ঠিকাদারের সঙ্গে আলোচনা করছে বলে সেই প্রতিনিধি বৈঠকে জানিয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, ২০২৬ সালের জানুয়ারি থেকে একটি দীর্ঘমেয়াদি রক্ষণাবেক্ষণ কর্মপরিকল্পনা (এলটিএসএ) বাস্তবায়নের লক্ষ্যে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) প্রস্তুত করা প্রয়োজন। জবাবে প্রকল্প পরিচালক বলেছেন, ডিপিপি প্রণয়নের কাজ চলমান রয়েছে। যন্ত্রাংশের তালিকা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কাছে পাঠানো হয়েছে।
জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় প্রযুক্তিগত ত্রুটি চিহ্নিত করে জাইকার সঙ্গে যৌথভাবে সমাধান পরিকল্পনা তৈরি করা হবে। এ ছাড়া বিদ্যুৎ বিভাগকে ২০২৬ সালের জানুয়ারির মধ্যে প্রকল্পের সংশোধিত প্রস্তাব (ডিপিপি) তৈরি করে জাইকার কাছে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, জাপানের সহায়তায় নির্মিত মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রটি দেশের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের আধুনিকতম উদাহরণ। কিন্তু এখন এর ত্রুটি শুধু প্রযুক্তিগত নয়—এটি চুক্তি ব্যবস্থাপনা, আর্থিক ক্ষতি এবং প্রকল্প পরিচালনার দুর্বলতারও প্রতিফলন। সময়মতো সংস্কার কাজ শুরু না হলে মাতারবাড়ী কেন্দ্রটি দীর্ঘ সময় অর্ধেক ক্ষমতায় চালাতে হতে পারে। এতে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ ঘাটতি ও ব্যয় বাড়বে। দ্রুত সমাধান না হলে মাতারবাড়ীর মতো মেগা প্রকল্পের প্রত্যাশিত সুফল দীর্ঘ সময় অনিশ্চিত থেকে যাবে।,
মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রটি কক্সবাজার জেলার মহেশখালীতে অবস্থিত একটি ১২শ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। কেন্দ্রটি দেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল এবং অত্যাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর একটি প্রকল্প, যেখানে আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড। জাপানের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় নির্মিত ৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার দুই ইউনিটের বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে খরচ হয়েছে প্রায় ৫২ হাজার কোটি টাকা। কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর ও চলতি বছরের ২৮ আগস্ট দ্বিতীয় ইউনিট বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয়।,
ইপেপার
Copyright © 2025 ThikanaTV.Press. All rights reserved.