
সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি: ভালোবাসার টানে পরিবার ছাড়িয়ে পালিয়ে বিয়ে করেছিলেন আঁখি খাতুন (২৩)। কিন্তু মাত্র চার বছরের সংসার জীবনের করুণ পরিণতি হলো ঈদের সকালে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। স্বামী আলামিন হোসেনের বাড়ি থেকে তার মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় আত্মহত্যা নাকি পরিকল্পিত হত্যা—তা নিয়ে শুরু হয়েছে রহস্য ও অভিযোগের ঘূর্ণিপাক।
সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার নরিনা ইউনিয়নের চরটেপরি গ্রামের গৃহবধূ আঁখির মরদেহ ৭ জুন (ঈদুল আজহার দিন) সকালে তার স্বামীর বাড়ি থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। আলামিন ও তার পরিবার এটিকে আত্মহত্যা বললেও আঁখির বাবা-মা এ দাবি প্রত্যাখ্যান করে বলেন, তাদের মেয়েকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।
প্রেম থেকে সংসার, তারপর বিষাদ
আঁখি খাতুন উল্লাপাড়া উপজেলার সলপ ইউনিয়নের নওকৈর গ্রামের কৃষক আলম সরদার ও গৃহিণী শিল্পী খাতুনের মেয়ে। ২০২১ সালে ৮ম শ্রেণিতে পড়ার সময় তিনি পালিয়ে বিয়ে করেন দশম শ্রেণির ছাত্র আলামিন হোসেনকে। পরিবারের অমতে বিয়ে হওয়ায় আঁখির বাবা অপহরণের মামলা করেন। এ মামলায় আলামিন ও তার বাবা কারাবরণও করেন। তবে সময়ের সঙ্গে পরিস্থিতি বদলায়—পরিবার দু’টির মধ্যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং আঁখির সন্তান জন্মের পর বিবাদ মিটে যায়।
অভাব, নির্যাতন ও অশান্ত সংসার
বিয়ের পর কিছুদিন সুখে কাটলেও পরবর্তীতে শুরু হয় অভাব-অনটন। কাজ না করা, জুয়া ও মাদকে জড়িয়ে পড়া এবং শ্বশুরবাড়ি থেকে বারবার টাকা দাবির অভিযোগে আলামিনের বিরুদ্ধে পরিবারের ক্ষোভ বাড়তে থাকে। অভিযোগ রয়েছে, আলামিন প্রায়ই আঁখিকে মারধর করত এবং যৌতুক চেয়ে নির্যাতন করত। আঁখির বাবা তার মেয়ে ও জামাতার জন্য এক বিঘা জমি চাষে সহায়তা করেন, সন্তান জন্মের খরচসহ বিভিন্ন সময়ে অর্থসাহায্য দেন।
মৃত্যুর আগের দিনও স্বাভাবিক আচরণ
ঈদের আগের দিন আঁখি নিজ হাতে রান্না করে বাবাকে খাওয়ান, হাসিমুখে বিদায় জানান এবং জানান ঈদের পরদিন স্বামী-সন্তান নিয়ে বাবার বাড়ি যাবেন। কিন্তু ঈদের সকালেই খবর আসে তার মৃত্যু হয়েছে। স্বামীর পরিবার দাবি করে, আঁখি আত্মহত্যা করেছেন। কিন্তু নিহতের গলায় ও শরীরের বিভিন্ন অংশে আঘাতের চিহ্ন ছিল বলে জানায় পরিবারের সদস্যরা।
‘ফকিন্নি’ হোসনে আরাকে কেন্দ্র করে চাঞ্চল্য
আঁখির মা দাবি করেন, আলামিনের চাচি হোসনে আরা ‘ফকিন্নি’ তাবিজ-কবজ, শিকড়বাকড় ও জাদুবিদ্যার মাধ্যমে তার মেয়েকে প্রভাবিত করেছিলেন এবং পালিয়ে বিয়েতে উসকানি দিয়েছিলেন। এই নারী আঁখিকে বারবার নিজের বাড়িতে গোপনে ডেকে নিতেন বলেও অভিযোগ। ঘটনাটিকে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় এই ‘ফকিন্নি’র ভূমিকাও সন্দেহের কেন্দ্রে।
পুলিশের অবস্থান
শাহজাদপুর থানা পুলিশ জানিয়েছে, আঁখির মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য সিরাজগঞ্জ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে এবং এ ঘটনায় একটি ইউডি মামলা রেকর্ড করা হয়েছে। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. কামরুজ্জামান ও ওসি আসলাম আলী বলেন, ময়নাতদন্তের রিপোর্ট অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। একই সঙ্গে তারা পুলিশের বিরুদ্ধে টাকা নিয়ে প্রভাবিত হওয়ার অভিযোগকে ‘ভিত্তিহীন ও বানোয়াট’ বলে প্রত্যাখ্যান করেন।
পরিবারের জোরালো দাবি
আঁখির বাবা আলম সরদার, মা শিল্পী খাতুন এবং আত্মীয়স্বজনদের একটাই দাবি—এটি আত্মহত্যা নয়, বরং নির্মমভাবে পিটিয়ে ও শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। তারা দাবি করেছেন, এ ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত এবং দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
ভালোবাসা, বিয়ে, মেনে নেওয়া, নির্যাতন আর এক নির্মম পরিণতি—আঁখির জীবনের পর্দা নেমেছে এক অনাকাঙ্ক্ষিত ট্র্যাজেডিতে। এখন অপেক্ষা শুধুই ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন ও আইনের নিরপেক্ষতার। প্রেমের শুরু যেখানে সিনেমার মতো, সেই গল্পের পরিসমাপ্তি যেন বাস্তবের চেয়েও ভয়ংকর এক করুণ কাহিনি।