ভারত থেকে আকস্মিক বিদ্যুৎ বন্ধ হলে প্রস্তুত কি বিপিডিবি

নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশে দৈনিক বিদ্যুতের মোট চাহিদা গড়ে প্রায় সাড়ে ১৫ হাজার মেগাওয়াট। এর মধ্যে ভারত থেকে আমদানি হচ্ছে আড়াই হাজার মেগাওয়াটের কম-বেশি।

সম্প্রতি পাল্টাপাল্টি বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞায় বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দুই দেশের এ টানাপড়েন বিদ্যুৎ বাণিজ্যেও প্রভাব ফেলবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। আর তাই যদি হয় অর্থাৎ প্রতিবেশী দেশটি থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে তা মোকাবেলায় বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) প্রস্তুতি নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন তারা।

ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য বিপিডিবির সঙ্গে দেশটির সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে ২ হাজার ৭৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি রয়েছে। এর মধ্যে জিটুজি চুক্তির আওতায় ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট এবং আদানি গোষ্ঠীর সঙ্গে ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াটের। সে অনুযায়ী দৈনিক প্রায় আড়াই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসছে ভারত থেকে, যা দেশে মোট বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রায় ১৭ শতাংশ। তবে বিদ্যুৎ সরবরাহে কোনো ত্রুটি কিংবা আকস্মিক বন্ধ হয়ে গেলে তার জন্য বিপিডিবির প্রস্তুতি রয়েছে কিনা-সে বিষয়ে সংস্থাটির বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে জানার চেষ্টা করা হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিপিডিবির ঊর্ধ্বতন দুই কর্মকর্তা জানান, ভারতের সঙ্গে জিটুজির আওতায় বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি আকস্মিকভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। বিগত এক দশকে এমন পরিস্থিতি কখনো হয়নিও। তবে কোনো কারণে এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হলে সামাল দেয়ার মতো প্রস্তুতি বিপিডিবির রয়েছে বলে দাবি করেন তারা। সেক্ষেত্রে হয়তো কিছুটা লোডশেডিং হতে পারে। অবশ্য বিষয়টি নির্ভর করছে বিদ্যুতের পিক ডিমান্ডের ওপর। যদি বিদ্যুতের চাহিদা কম থাকে সেক্ষেত্রে সামাল দেয়া সম্ভব। চলতি বছরের প্রাক্কলন অনুযায়ী, বিদ্যুতের চাহিদা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছলে সেক্ষেত্রে হয়তো ভিন্ন পরিস্থিতির আশঙ্কা রয়েছে।

বেসরকারিভাবে ভারত থেকে আদানির বিদ্যুৎ আমদানি করছে বাংলাদেশ। জাতীয় গ্রিড লাইনে তা সরবরাহ হলেও মূলত সে বিদ্যুৎ ব্যবহার হয় দেশের উত্তরাঞ্চলে। বিদ্যুৎ আমদানি বাবদ আদানি পাওয়ার বর্তমানে নিয়মিত বিল পেলেও বকেয়া নিয়েও সরকারের সঙ্গে টানাপড়েন রয়েছে। মূলত ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিপুল পরিমাণ বিল বকেয়া পড়ে। এ নিয়ে দুই বছর ধরে সরকারের সঙ্গে নানাভাবে চিঠি চালাচালি চলছে। এমনকি বকেয়া বিল না পাওয়ায় আদানি পাওয়ার বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহও বন্ধ রেখেছিল। এর মধ্যে গত বৃহস্পতিবার আদানি পাওয়ারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এসবি খাইলিয়া বাংলাদেশে এসে বিদ্যুৎ বিভাগের সচিবের সঙ্গে বৈঠক করেন। চাপ দেন বকেয়া পরিশোধে। খাইলিয়ার দাবি অনুযায়ী, বকেয়ার পরিমাণ প্রায় ৯০০ মিলিয়ন ডলার। যদিও বিপি‌ডি‌বির হিসাবে তা ৭০০ মিলিয়নের নিচে। বিষয়টি নিয়ে একপ্রকার জটিলতা তৈরি হয়েছে।

বিপিডিবির হিসাব অনুযায়ী, দেশে গ্রিডভিত্তিক বিদ্যুতের মোট সক্ষমতা ২৭ হাজার ৫৩৬ মেগাওয়াট। এর মধ্যে আমদানি ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াটের হিসাব বাদ দিলে ২৬ হাজার ৩৬০ মেগাওয়াট। দেশে এখনো বিদ্যুতের সর্বোচ্চ সরবরাহ হয়েছে সাড়ে ১৬ হাজার মেগাওয়াট। তবে এ পরিমাণ বিদ্যুৎ সরবরাহ দিতে গিয়ে ভারত থেকে আদানি ও জিটুজি চুক্তির আওতায় বিদ্যুৎ আমদানি করতে হয়েছে বিপিডিবিকে।

বিদ্যুৎ খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভারত থেকে আমদানি না করেই বিদ্যুৎ চাহিদার পুরোটাই পূরণ করতে পারে বাংলাদেশ। কেননা দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা চাহিদার অনেক বেশি। তবে পর্যাপ্ত জ্বালানির সংস্থান না থাকায় অনেক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসিয়ে রাখতে হচ্ছে। বিশেষ করে কয়লাভিত্তিক সাত হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালানোর মতো জ্বালানি না থাকায় বিপিডিবি এখনো আমদানিনির্ভর। এসব কেন্দ্রের জ্বালানি জোগান এবং গ্যাসভিত্তিক বড় কেন্দ্রগুলো সার্বক্ষণিক ব্যবহার না করা পর্যন্ত তা এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগও নেই।

বিপিডিবির হিসাব অনুযায়ী, দেশে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সক্ষমতা প্রায় সাড়ে ১২ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু ব্যবহার করা যায় সাড়ে ৫ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কেন্দ্র। ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সক্ষমতা ৫ হাজার ৫৮১ মেগাওয়াট, খরচ বিবেচনা ও জ্বালানি সংকটে ব্যবহার করা যায় দেড় হাজার থেকে সর্বোচ্চ আড়াই হাজার মেগাওয়াট। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সক্ষমতা ৭ হাজার ১৭৯ মেগাওয়াট, এর মধ্যে উৎপাদন করা যায় সর্বোচ্চ সাড়ে ৪ হাজার মেগাওয়াট। এছাড়া সৌরবিদ্যুতের যতটুকু সক্ষমতা রয়েছে সেগুলো দিনের বেলা ছাড়া ব্যবহারের সুযোগ নেই।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ-ভারতের বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার প্রভাব সব ক্ষেত্রেই রয়েছে। বিদ্যুৎ খাতও সংকটে রয়েছে। কারণ বিল বকেয়াসংক্রান্ত বিষয়গুলো নিয়ে অনেক আগ থেকে টানাপড়েন চলছে। বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির কোনো একটি ক্লজ ধরে এখানেও সংকট দেখা দেয়ার বিষয়টি উড়িয়ে দেয়া যায় না।

এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির প্রকৌশল অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাণিজ্য নিয়ে ভারতের সঙ্গে যে ধরনের অস্থিরতা চলছে, তাতে বিদ্যুৎ খাতেও ঝুঁকি রয়েছে। যেকোনো অজুহাত খাড়া করে বিদ্যুৎ বন্ধ করে দিতে পারে তারা। বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির মধ্যে বহু ক্লজ রয়েছে, যার কোনো একটি ধরে বন্ধ করে দেয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে এ বিষয়ে সরকার বিশেষত বিপিডিবির সতর্ক থাকা প্রয়োজন।’

তিনি মনে করেন, ‘আমাদের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। এগুলো সব বেইজ লোডভিত্তিক কেন্দ্র। এ কেন্দ্রগুলোর জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থা তৈরি করা জরুরি। জ্বালানি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র কম ব্যবহার করে কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র ব্যবহার করা যায় কিনা সেটা বোঝা জরুরি। পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পগুলোর জন্য মফস্বল এলাকায় রুফটপ সোলার প্রকল্প করা যেতে পারে। বৃহৎ আকারে রুফটপ করা গেলে ওই সব শিল্পে গ্রিডের বিদ্যুৎ কম প্রয়োজন হবে। সেক্ষেত্রে বিদ্যুতের চাহিদা কমে গেলে আমদানিনির্ভরতাও এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব।’

ভারতের সঙ্গে জিটুজির আওতায় ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি সাশ্রয়ী ও নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ। এ বিদ্যুতের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ দিয়ে ১ হাজার মেগাওয়াট এবং ত্রিপুরা দিয়ে ১৬০ মেগাওয়াট আমদানি করা হচ্ছে। ভারত থেকে আমদানি করা এ বিদ্যুৎ খরচ অনেকটাই সাশ্রয়ী।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ‍বুয়েটের অধ্যাপক ম. তামিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ভারত থেকে জিটুজি ভিত্তিতে ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ চুক্তি সবচেয়ে সাশ্রয়ী, যা বাংলাদেশের গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের চেয়েও দ্বিতীয় সর্বনিম্ন খরচ। এ বিদ্যুৎ দেশের গ্রিডের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বিদ্যুতের অন্যতম একটি উৎস। ফলে বিষয়টি শুধু নির্ভরতা নয়, অর্থনৈতিক বিবেচনায় বিপিডিবির জন্য সাশ্রয়ী বটে!’

বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য স্থগিতের মধ্যে বিদ্যুৎ রফতানির প্রসঙ্গটি উদ্বেগের কারণ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ। বিশেষ করে কোনো অজুহাতে বিদ্যুৎ আমদানি আকস্মিকভাবে বন্ধ হলে তাতে বাংলাদেশের প্রস্তুতি কতটুকু রয়েছে সে বিষয়টি আলোচনায় রয়েছে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এ ধরনের কোনো ইস্যু তৈরি হলে সেটার বিকল্প ব্যবস্থা আমরা করতে পারব। এর আগে আদানির সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি হওয়ার কারণে সাময়িকভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহে যে ঘাটতি তৈরি হয়েছিল, সেটি আমরা ব্যবস্থা করেছিলাম। তবে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা নিয়ে প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে এ ধরনের সুযোগ আপাতত দেখছি না।’

Facebook
Twitter
WhatsApp
Pinterest
Telegram

এই খবরও একই রকমের

সামিট পাওয়ারের পাঁচ বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ

নিজস্ব প্রতিবেদক: উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত সামিট পাওয়ার লিমিটেডের আরও দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র-জাঙ্গালিয়া (গ্যাসভিত্তিক ৩৩ মেগাওয়াট) এবং মদনগঞ্জ (এইচএফও-ভিত্তিক ১০২ মেগাওয়াট)। এর ফলে প্রতিষ্ঠানটির

বাইডেনের বিশেষ প্রতিনিধি ঢাকায় পৌঁছেছেন

অনলাইন ডেস্ক: চার দিনের সরকারি সফরে ঢাকায় পৌঁছেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বাইডেন প্রশাসনের বিশেষ প্রতিনিধি দল। আন্তর্জাতিক শ্রমবিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি কেলি এম ফে রজরিগেজ এবং শ্রম

সিরাজগঞ্জের সলঙ্গায় ভ্যানচালকের লাশ উদ্ধার

জুয়েল রানা: সিরাজগঞ্জের সলঙ্গায় ভ্যানচালকের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। শনিবার (০১ জুন ) সকালে থানার বাসুদেবকোল মধ্যপাড়া কলাবাগান থেকে রেজাউল করিম (৪৫) নামে এক ভ্যানচালকের

তিস্তা প্রকল্প চীনের পছন্দ হলেও ভারতের আপত্তি

নিজস্ব প্রতিবেদক: তিস্তা নদীতে বাংলাদেশ অংশে একটি বহুমুখী ব্যারেজ নির্মাণের জন্য চীন যে তৎপর হয়েছে, সেটি আটকে আছে ভারতের আপত্তির কারণে। শেখ হাসিনার সরকার টানা

হিজবুল্লাহর হামলায় কাঁপল ইসরাইল

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: সম্প্রতি দক্ষিণ লেবাননের ওপর ইসরাইলি আগ্রাসনের প্রতিক্রিয়ায় ইসরাইলের দখলকৃত অঞ্চলে নতুন করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে হিজবুল্লাহ। শনিবারের এ হামলায় অন্তত ২৫টি রকেট দখলকৃত

সিরাজগঞ্জ উল্লাপাড়ায় এক শিক্ষার্থীর মরদেহ উদ্ধার

সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি: সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় স্বপন আলী (২০) নামে এক শিক্ষার্থীর মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। বৃহস্পতিবার দুপুরে উপজেলার পঞ্চক্রোশী ইউনিয়নের শাহীকোলা গ্রামের ফসলের মাঠ থেকে তার