
নিজস্ব প্রতিবেদক: ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে বলা হয় ইতিহাস-ঐতিহ্যে ভরা এক সম্ভাবনাময় জেলা। কিন্তু সাম্প্রতিক এ বছর এ জেলার নাম বারবার উঠে আসছে সংঘর্ষ, আধিপত্য বিস্তার ও রক্তক্ষয়ী সহিংসতার খবরে। তুচ্ছ বিষয়কে কেন্দ্র করে প্রতিনিয়ত টেঁটা, দা, লাঠিসোটা ও উইদেশীয় অস্ত্র হাতে একে অপরের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ছে সাধারণ মানুষ। এর ফলে অশান্ত হয়ে উঠছেন ঐঐধশান্তিপ্রিয় জনপদ ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
চলতি বছরের গত জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে তুচ্ছ ঘটনায় কমপক্ষে ৩৫০ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায়। এতে আহত হয় কয়েক হাজার মানুষ। নিহত হয় আটজন। দুজনের কবজি কেটে ফেলা হয় সংঘর্ষের সময়। হামলা থেকে বাদ পড়েননি ইউএনও, ওসিসহ পুলিশ সদস্যরাও। এ সকল সংঘর্ষকারীদের বেশির ভাগই দেশীয় অস্ত্র বিশেষ করে টেঁটা, দা, লাঠি, বল্লম ইত্যাদি ব্যবহার করে থাকে। সংঘর্ষে অংশগ্রহণকারীরা নিজেদের রক্ষায় মাথায় হেলমেট লাইফ জ্যাকেট পরে। সংঘর্ষপ্রবণ এলাকার বেশির ভাগ বাড়িতেই দেশীয় অস্ত্র থাকে।
এ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যপক আলোচনা সমালোচনায় তূলপাড়।সবচেয়ে বেশি সংঘর্ষ হয় জেলা সদরসহ সরাইল ও নাসিরনগর উপজেলায়। এ ছাড়া আশুগঞ্জ, বাঞ্ছারামপুর, নবীনগর ও বিজয়নগর উপজেলায়ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। মাঝেমধ্যে সংঘর্ষ হয় কসবা উপজেলায়।
তুচ্ছ ঘটনাই বড় সংঘর্ষে রূপ নিচ্ছে:
সম্প্রতি মায়ের লাশ না দেখানো নিয়ে সংঘর্ষসহ, নারীর দিকে তাকানো, হাস, টিস্যু দেওয়া, শশা চুরি,ভাংতি টাকা বা ফুল ছেঁড়ার মতো তুচ্ছ ঘটনাকেও কেন্দ্র করে সংঘর্ষে জড়াচ্ছে গ্রামবাসী। এক পক্ষ অন্য পক্ষের ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে পরিণত করছে গ্রামকে রণক্ষেত্র।এতে প্রতিটি সংঘর্ষে আহত হচ্ছেন অর্ধশত থেকে শতাধিক মানুষ। নিহতের সংখ্যা বাদ যায়নি সংঘর্ষ থেকে।
গত ১০ মাসে জেলার ৯টি উপজেলায় প্রায় ৩৫০ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে আহত হয়েছেন প্রায় ৭ হাজারেও বেশি মানুষ, নিহতও হয়েছেন অনেকে।এসব সংঘর্ষে নারীরাও সামনের সারিতে থেকে জরিয়ে পরছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া এসব ঘটনার ভিডিও দেখে দেশ-বিদেশে থাকা প্রবাসীরাও হতবাক।
প্রতিটি উপজেলাতেই সংঘর্ষের ছোঁয়া:
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থেকে শুরু করে কসবা, বিজয়নগর, নবীনগর, সরাইল, বাঞ্ছারামপুর, নাসিরনগর, আশুগঞ্জ ও আখাউড়া—প্রায় প্রতিটি উপজেলাতেই সংঘর্ষের রেশ লেগেই আছে।,
সদর: মায়ের লাশ দেখতে না দেয়ায়,চড় দেওয়াকে কেন্দ্র করে মহাসড়কে টর্চ লাইট জ্বালিয়ে দু-পক্ষের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ।রান্নার ধোঁয়া ঘরে যাওয়াকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ।
নবীনগর :ভাতিজার হাতে চাচার হাত কর্তন, আধিপত্য বিস্তারকে কেদ্র করে সংঘর্ষ।
সরাইলে: পূর্ব বিরোধের জেরে দুই গোষ্ঠীর সংঘর্ষে ইউএনও ও ওসি আহত হন—যা স্থানীয় প্রশাসনের জন্যও উদ্বেগজনক দৃষ্টান্ত।
বিজয়নগরে:গ্রাম্য প্রভাব বিস্তার ও রেলওয়ে সম্পত্তি নিয়ে হাত কর্তনসহ একাধিক সংঘর্ষে আহত হয়েছেন অনেকে।
বাঞ্ছারামপুরে: আধিপত্যের জেরে একের পর এক হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে।
নাসিরনগরে:একটি “শশা চুরি” নিয়ে সংঘর্ষে দফায় দফায় ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া।
আখাউড়ায়: মসজিদের দানবাক্সের হিসাব নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে হাতাহাতি ও মারামারির ঘটনা ঘটে।
আশুগঞ্জে:ফুল ছেঁড়া ও গ্রামবাসীর দুই পক্ষের সংঘর্ষে একাধিক আহত হয়।
কসবায়: আধিপত্য বিস্তার ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের লড়াইয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে প্রাণহানি ঘটে।
সামাজিক স্থিতিশীলতা বিপন্ন:
স্থানীয়রা বলছেন, এসব সংঘর্ষ এখন যেন এক ধরনের “সংস্কৃতি”তে পরিণত হয়েছে। আগে যেসব বিরোধ মীমাংসা করা হতো গ্রামীণ সালিশে, এখন সেগুলোও অস্ত্রের মুখে নিষ্পত্তি হচ্ছে।মূলত গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বেই এসব সংঘর্ষ বাধে। ৯টি উপজেলার পাঁচটি পৌরসভা ও ১০০ ইউনিয়নের প্রায় এক হাজার ৪০০ গ্রামের বেশির ভাগ স্থানে রয়েছে গোষ্ঠীগত ঐক্য। আবার কখনো কখনো এক গোষ্ঠীর সঙ্গে অন্য গোষ্ঠীর জোট বাঁধে। এলাকাভিত্তিক ঐক্যও রয়েছে বিভিন্ন স্থানে। নিজ নিজ গোষ্ঠী কিংবা এলাকাভিত্তিক নিজেদের সম্মান রক্ষায় কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি হয় না। অনেক ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদ ও জনপ্রতিনিধিরা নিজেদের প্রভাব ঠিক রাখতে কখনো কখনো ঝগড়া উসকে দেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। আবার অনেক সময় প্রবাসীরাও এটাকে নিজেদের ইজ্জত রক্ষার লড়াই হিসেবে দেখে টাকা ছড়িয়ে দেন।
সংঘর্ষের পরপরই ঘটে লুটপাট, বাড়িঘর ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও প্রাণনাশের ঘটনা। এরপর শুরু হয় মামলা-মোকদ্দমা, গ্রেপ্তার, হাজিরা ও আইনি লড়াই-যার ভুক্তভোগী হয় সাধারণ মানুষ।
নেপথ্যে আধিপত্য, রাজনীতি ও বিচারহীনতা:
বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এসব সংঘর্ষের পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে যেমন:আধিপত্য বিস্তার ও রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা – স্থানীয় পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে কে কতটা প্রভাবশালী, তা দেখানোর লড়াই প্রায়ই রক্তাক্ত সংঘর্ষে পরিণত হয়। জমি-জমা ও পারিবারিক বিরোধ – উত্তরাধিকার ও জমির মালিকানা নিয়ে দীর্ঘদিনের বিবাদ অনেক সময় প্রজন্মের পর প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়ে। বিচারহীনতা ও দুর্বল আইনি কাঠামো – অপরাধীরা দ্রুত বিচার না পাওয়ায় তারা আরও সাহসী হয়ে ওঠে। ফলে একই ধরনের ঘটনা বারবার ঘটছে।,
একজন স্থানীয় শিক্ষক বলেন,এখন মানুষ নিজের সম্মান বা ক্ষমতা দেখানোর নামেই লড়াই করে। গ্রামে শান্তি নেই, প্রতিদিনই কেউ না কেউ আহত বা নিহত হচ্ছে। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুরু হয় সংঘর্ষ হামলা পাল্টাহামলা, ভাংচুর লোটপাট, অংগ্নিসংযোগ এর শেষ কোথায়?
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সীমাবদ্ধতা:
স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ কখনো কখনো অভিযান চালালেও অধিকাংশ সময় তা সংঘর্ষের পরেই সীমাবদ্ধ থাকে। স্থায়ীভাবে কোনো পক্ষকেই নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না। অনেক সময় রাজনৈতিক চাপ, মামলা প্রত্যাহার ও সাক্ষ্য ঘাটতির কারণে অপরাধীরা ছাড় পাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
একজন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,“আমরা চেষ্টা করি সংঘর্ষের আগেই তথ্য পেতে, কিন্তু অনেক সময় খবর আসে যখন ঘটনাটা ঘটে গেছে।
সমাধানের পথ কোথায়?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সহিংসতা রোধে প্রশাসনিক পদক্ষেপের পাশাপাশি সামাজিক নেতৃত্বের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।,













