ঠিকানা টিভি ডট প্রেস: চলতি অর্থবছরে দেশের ব্যাংকগুলোকে প্রতি মাসে গড়ে ১ লাখ ৮১ হাজার কোটি টাকা ধার দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে গড়ে ৮৫ হাজার ৯০ কোটি টাকা ধার দেয়া হয়েছে রেপোর মাধ্যমে।
চলতি অর্থবছরে দেশের ব্যাংকগুলোকে প্রতি মাসে গড়ে ১ লাখ ৮১ হাজার কোটি টাকা ধার দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে গড়ে ৮৫ হাজার ৯০ কোটি টাকা ধার দেয়া হয়েছে রেপোর মাধ্যমে। রেপোর চেয়েও স্পেশাল লিকুইডিটি সাপোর্ট বা বিশেষ তারল্য সহায়তার আওতায় বেশি অর্থ ধার দিতে হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের প্রতি মাসে বিশেষ এ ধারে ব্যাংকগুলোকে দেয়া হয়েছে ৯৬ হাজার ১৪ কোটি টাকা। দেশের মুদ্রাবাজারের গতিপ্রকৃতি নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৈরি করা ‘মানি মার্কেট ডাইনামিকস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এখন রেপোর চেয়েও স্পেশাল লিকুইডিটি সাপোর্ট হিসেবে বেশি অর্থ ধার করছে। বর্তমানে রেপোর সুদহার ১০ শতাংশ। আর স্পেশাল লিকুইডিটি সাপোর্টের সুদহার ১১ দশমিক ৫০ শতাংশ নির্ধারিত রয়েছে। দৈনন্দিন লেনদেন শেষে কোনো ব্যাংক সিআরআর (আমানতের বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নগদ জমা সংরক্ষণ) ঘাটতিতে পড়লে তবেই স্পেশাল লিকুইডিটি সাপোর্ট নেয়।
তারল্য সংকটে থাকা ব্যাংকগুলো অর্থের জোগানের জন্য প্রথমে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে (কলমানি) যায়। সেখানে পর্যাপ্ত অর্থ না মিললে রেপোর মাধ্যমে মুদ্রাবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করে। এক্ষেত্রে ধার দেয়া ব্যাংকের কাছে সরকারি সিকিউরিটিজ বন্ধক রাখতে হয়। কলমানি কিংবা রেপোর মাধ্যমে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ করতে না পারলে তবেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দ্বারস্থ হয় সংশ্লিষ্ট ব্যাংক। এক্ষেত্রে দিনের নির্দিষ্ট সময়ে আবেদন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে রেপোতে ধার নেয়া হয়। দৈনন্দিন লেনদেন শেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সংরক্ষিত সিআরআর ঘাটতি দেখা দিলে স্পেশাল লিকুইডিটি সাপোর্ট হিসেবে ব্যাংকগুলো অর্থ ধার করে। উভয় ক্ষেত্রেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে সরকারি ট্রেজারি বিল-বন্ড তথা সিকিউরিটি বন্ধক রাখতে হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত তিন বছর দেশের ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট চলছে। আর কিছু ব্যাংকের সংকট গভীর হওয়ায় তারা পুরোপুরি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ধারনির্ভর হয়ে পড়েছে। ভালো ব্যাংক হিসেবে পরিচিত কয়েকটি ব্যাংকও রেপো এবং স্পেশাল লিকুইডিটি সাপোর্ট নিচ্ছে। অপেক্ষাকৃত কম সুদে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার নেয়া অর্থে ওই ব্যাংকগুলো সরকারি ট্রেজারি বিল-বন্ড কিনছে। এভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অর্থে সরকারকে ঋণ দিয়ে ওই ব্যাংকগুলো বড় অংকের মুনাফা করছে।'
রেপোতে ধার নিয়ে সরকারি বিল-বন্ড কেনাকে অনৈতিক চর্চা বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘রেপো কিংবা স্পেশাল লিকুইডিটি সাপোর্ট নেয়ার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সরকারি সিকিউরিটিজ জমা রাখতে হয়। এখন কোনো ব্যাংক যদি তারল্য সংকট না থাকা সত্ত্বেও রেপো নেয়, তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তেমন কিছু করার থাকে না। রেপোতে ধার নিয়ে সে অর্থে বিল-বন্ড কেনা অবৈধ না হলেও এটি অনৈতিক। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, ব্যাংকগুলো এ ধরনের অনৈতিক চর্চা থেকে বিরত থাকবে।’
আরিফ হোসেন খান আরো বলেন, ‘আগের তুলনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার নেয়ার প্রবণতা কমেছে। গত মাস থেকে বাজারে তারল্য সংকট অনেকটাই কেটে গেছে। এ কারণে বিল-বন্ডের সুদহারও এখন নিম্নমুখী। আশা করছি, আগামী মাসগুলোতে বিল-বন্ডের সুদহার রেপো রেটের পর্যায়ে নেমে আসবে। তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার নেয়ার প্রয়োজনীয়তাও কমবে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম মাস তথা গত জুলাইয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে রেপোতে ধার নেয়া অর্থের পরিমাণ ছিল ৯৬ হাজার ৩৮৭ কোটি টাকা। ওই মাসে একদিন মেয়াদি রেপোতে ১ হাজার ৬৫১ কোটি, সাতদিন মেয়াদি রেপোতে ২৩ হাজার ৯৭৮ কোটি, ১৪ দিন মেয়াদি রেপোতে ২৯ হাজার ১৬৫ কোটি ও ২৮ দিন মেয়াদি রেপোতে ৪১ হাজার ৫৯৩ কোটি টাকা ধার করেছে ব্যাংকগুলো। এর পরের মাসগুলোতে রেপোতে ধার নেয়ার প্রবণতা কোনো মাসে কমেছে, আবার কোনো মাসে বেড়েছে। ব্যাংকগুলো আগস্টে ৮১ হাজার ৬৬৮ কোটি, সেপ্টেম্বরে ৯৫ হাজার ৪০৫ কোটি, অক্টোবরে ৯৬ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা রেপোতে ধার নেয়। নভেম্বরের পর থেকে এ ধারের পরিমাণ কিছুটা কমে আসে। সর্বশেষ চলতি বছরের মার্চে রেপোতে ব্যাংকগুলোর ধার নেয়ার পরিমাণ ছিল ৮৩ হাজার ৭৫৭ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত নয় মাসে গড় ধারের পরিমাণ দাঁড়ায় ৮৫ হাজার ৯০ কোটি টাকায়।
রেপোর বিভিন্ন মেয়াদ থাকলেও স্পেশাল লিকুইডিটি সাপোর্ট কেবল একদিনের জন্য দেয়া হয়। ব্যাংকগুলোর দৈনন্দিন লেনদেন শেষে সিআরআর ঘাটতিতে পড়লে তবেই বিশেষ এ ধার দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরজুড়ে ব্যাংকগুলোর বিশেষ এ ধার প্রবণতা বেড়েছে। গত বছরের জুলাইয়ে স্পেশাল লিকুইডিটি সাপোর্টে ব্যাংকগুলোর নেয়া ধারের পরিমাণ ছিল ৯৩ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা। আগস্টে গিয়ে এ ধারের পরিমাণ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। ওই মাসে স্পেশাল লিকুইডিটি সাপোর্ট হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ধার দিয়েছিল ১ লাখ ২ হাজার ৮৬৬ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বরে বিশেষ এ ধার ১ লাখ ১০ হাজার ৫৪৫ কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকে। এরপর অক্টোবরে কিছুটা কমে এলেও নভেম্বরে স্পেশাল লিকুইডিটি সাপোর্টের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ১৪ হাজার ৭৯১ কোটি টাকায়। ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে এ ধার ৮০ হাজার কোটি টাকার নিচে নেমে এলেও ফেব্রুয়ারিতে এসে আবারো ১ লাখ ৭ হাজার ৭১ কোটি টাকায় উঠে যায়। আর সর্বশেষ চলতি বছরের মার্চে স্পেশাল লিকুইডিটি সাপোর্ট হিসেবে ব্যাংকগুলো ৯৪ হাজার ২১৬ কোটি টাকা ধার করেছে। সব মিলিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক চলতি অর্থবছরে প্রতি মাসে গড়ে ৯৬ হাজার ১৪ কোটি টাকার বিশেষ এ ধার দিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, ভালো ব্যাংকগুলো রেপোতে ধার বেশি নিলেও স্পেশাল লিকুইডিটি সাপোর্ট নিয়েছে মূলত তারল্য সংকটে থাকা ব্যাংক। গত তিন বছর ইসলামী ধারার বেশির ভাগ ব্যাংকসহ অনিয়ম-দুর্নীতিতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়া ব্যাংকগুলো স্পেশাল লিকুইডিটি সাপোর্ট নিচ্ছে। এ কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এত বেশি পরিমাণ অর্থ ধার দিতে হচ্ছে। তবে মেয়াদ কম হওয়ায় এ অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ফিরে এসেছে। বর্তমানে স্পেশাল লিকুইডিটি সাপোর্টের স্থিতি প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেট ম্যানেজমেন্ট বিভাগের পরিচালক ইস্তেকমাল হোসেন বণিক বার্তাকে জানান, বাজারে তারল্য সংকট ছিল, এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক রেপো ও স্পেশাল লিকুইডিটি সাপোর্ট দিয়ে ব্যাংকগুলোর পাশে দাঁড়িয়েছে। এ মুহূর্তে তারল্য সংকট অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। এ কারণে ব্যাংকগুলোর ধার নেয়ার প্রয়োজনীয়তাও কমেছে। এতদিন বিভিন্ন মেয়াদি থাকলেও বর্তমানে কেবল সাত ও ১৪ দিন মেয়াদি রেপো চালু আছে। চলতি বছরের ১ জুলাই থেকে ১৪ দিন মেয়াদি রেপোও বন্ধ করে দেয়া হবে। তখন কেবল সাতদিন মেয়াদি রেপো চালু থাকবে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কথা বলে গত দুই অর্থবছর ধরে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি প্রণয়ন করে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এজন্য রেপো বা নীতি সুদহার পাঁচ দফায় বাড়ানো হয়েছে। রেপো রেট ৫ থেকে বাড়িয়ে উন্নীত করা হয় ১০ শতাংশে। আর সরকার ট্রেজারি বিল-বন্ডের মাধ্যমে ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নিচ্ছে ১১ থেকে ১৩ শতাংশে। এটিকে সুযোগ হিসেবে নিয়ে অনেক ব্যাংক ১ থেকে দেড় শতাংশ মুনাফা বের করে নিচ্ছে। বেসরকারি খাতে না দিয়ে ব্যাংকগুলো এখন অর্থের সংকটে থাকা সরকারকে বেশি ঋণ দিচ্ছে। এ কারণে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫৭ শতাংশে নেমে এসেছে। যদিও গত মার্চ পর্যন্ত সরকারের ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৬ দশমিক ৩২ শতাংশ। ওই মাসে ব্যাংক খাত থেকে নেয়া সরকারের ঋণের স্থিতি ছিল ৪ লাখ ৫৪ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে রেপোতে ধার নেয়া ও একই সঙ্গে সরকারকে ঋণ দেয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘বেসরকারি খাতের পাশাপাশি সরকারকে ঋণ দেয়াও ব্যাংকের দায়িত্ব। আমরা উদ্বৃত্ত তারল্য দিয়ে সরকারি ট্রেজারি বিল-বন্ড কিনছি। আবার প্রয়োজন হলে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রেপোতে ধার নিচ্ছি। এটি মুদ্রাবাজারের একটি স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড। এর মাধ্যমে ব্যাংকের যদি কিছু মুনাফা হয়, তাহলে কোনো ক্ষতি তো দেখি না।’
তবে মোহাম্মদ আলী জানান, গত বছরের আগস্টের তুলনায় এখন বাজারে তারল্যের প্রবাহ বেশ ভালো। বিল-বন্ডের সুদহারও রেপো রেটের কাছাকাছি চলে এসেছে। মূল্যস্ফীতি কমে এলে নীতি সুদহারও কমানো হবে। তখন তারল্য উদ্বৃত্ত থাকলে বিল-বন্ডের সুদহারও কমে আসবে। ব্যাংকগুলোর রেপোতে টাকা নেয়ার প্রয়োজনীয়তাও খুব বেশি থাকবে না।'