
নিজস্ব প্রতিবেদক: সিরাজগঞ্জের বেলকুচিতে চালা আব্দুল হাই সুপার মার্কেটে নিজের সত্ব না থাকা সত্ত্বেও জমির মালিকানা দাবি করে দোকানের ভাড়া আদায়ে দোকানীদের চাপ দেয়ার অভিযোগ উঠেছে প্রভাবশালী এক বিএনপি নেতার বিরুদ্ধে। তাকে এই ভাড়া প্রদান না করলে দোকানে তালা ঝুলিয়ে দেয়া হবে বলেও হুমকি দিয়েছেন তিনি। এতে মার্কেটের ৫১ দোকানের ভাড়টিয়া ব্যবসায়ীরা বিপাকে পড়েছেন। ওই নেতার ভয়ে মূল মালিককেও ভাড়া দিচ্ছেন না ভাড়াটিয়ারা। এদিকে সমস্যার সমাধানে নিজ নামীয় দলিল দস্তাবেজ নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরে হয়রানির শিকার হচ্ছেন মার্কেটের মূল মালিকআব্দুল হাই মন্ডল গং।’
জমিসহ মার্কেট দখলের পায়তারাকারি বেলকুচি পৌর এলাকার জিধুরী গ্রামের মৃত মজিবর রহমানের ছেলে
আব্দুর রাজ্জাক মন্ডল বেলকুচি উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারন সম্পাদক।
সরেজমিনে জানা যায়, আব্দুর রাজ্জাক মন্ডল উপজেলা বিএনপির প্রভাবশালী নেতা হওয়ায় জোরপূর্বক একই মহল্লার ইকবাল রানার পৈতৃক ৪০ শতক জায়গাসহ মার্কেট দখলের চেষ্টা করছেন। তিনি দেড় মাস আগে ওই মার্কেটের উপর জোরপূর্বক একটি সাইনবোর্ডও টাঙ্গিয়ে ছিলেন।’
ভুক্তভোগীদের সাথে কথা বলে এবং বন্টন নামা দলিল সূত্রে জানা যায়, বেলকুচি উপজেলার চালা মৌজায় ২৬৮ নং দাগের ৭৮ শতক জমির মালিক ওসমান গনি মন্ডল। ১৯৬৫ সালে ওয়াপদা বাঁধ নির্মাণের জন্য ওই সম্পত্তির ৩০ শতক জমি অধিগ্রহণ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। পরবর্তী ১৯৭৬ সালে ওসমান গনি মন্ডলের মৃত্যুর পর বাকি ৪৮ শতক জমির মধ্যে ৪৪ শতক জমিতে বন্যার আশ্রয় কেন্দ্র নির্মান করার জন্য মৃত ওসমান গনি মন্ডলের চার সন্তান রোস্তম আলী,মজিবর রহমান,মতিয়ার রহমান ও আব্দুল হাই মন্ডলের কাছ থেকে সরকার মৌখিক চুক্তিতে নিয়ে নেয়। এরপর তিন ভাই উক্ত জমির মধ্যে থেকে ৪০ শতক জমি ১৯৭৮ সালের ২৭ নভেম্বর বাটোয়ারা দলিল মূলে (দলিল নং-২২৬৮) আব্দুল হাই মন্ডলকে হস্তান্তর করেন।’
কিন্তু পরবর্তীতে সরকার মৌখিক চুক্তিতে নেয়া ওই জমিতে বন্যার আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ না করায় আব্দুল হাই মন্ডলের নামের ৪০ শতক ও বাকি ৪ শতকসহ মোট ৪৪ শতক জমি ফেরত চেয়ে হাইকোর্টে রিট পিটিশন দাখিল করেন আব্দুল হাই মন্ডল। পরে হাইকোর্ট ২০০০ সালে উক্ত জমি ৩০ দিনের মধ্যে আবেদনকারীকে বুঝিয়ে দিতে ভূমি মন্ত্রনালয়কে আদেশ প্রদান করেন।
এরপর ওসমান গনি মন্ডলের কন্যা সন্তানের ওয়ারিশ আব্দুল হাকিম গংরা বাটোয়ারা দলিল (মামলা নং ৫৯/২০০৮), বাতিলের দাবিতে আদালতে মামলা দায়ের করেন। এ মামলায় আব্দুর রাজ্জাক মন্ডল গংরা অন্তভূক্ত হয়ে জবাব দাখিল করে। পরে মামলাটি ২০১৮ সালের ৪ জুন খারিজ করে দেয় আদালত।
বিএনপি নেতা আব্দুর রাজ্জাক মন্ডলের ভাড়া চাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে ওই মার্কেটের চাল ব্যবসায়ী শহীদ আলী মন্ডল (৬৫) বলেন, মার্কেটটি আব্দুল হাই মন্ডলের। তার অবর্তমানে আমরা প্রত্যেক মাসে তার ছেলে ইকবাল রানাকে ভাড়া দিয়ে আসছি। আব্দুর রাজ্জাক মন্ডল এতদিন কিছু বলে নাই।’
স্থানীয়রা জানান, প্রভাবশালী বিএনপি নেতা রাজ্জাক মন্ডল ৫ আগস্টের পরে ওই মার্কেট অবৈধভাবে দখলের উদ্দেশ্যে ভাড়াটিয়াদের কাছে ভাড়া চেয়ে চাপ দেওয়ায় বিব্রত হয়ে মার্কেটের মূল মালিককে ভাড়া দিচ্ছেন না ভাড়াটিয়ারা। এতে ক্ষতিগ্রস্ত ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন জমিসহ ওই মার্কেটের মূল মালিক আব্দুল হাই মন্ডলের সন্তানেরা।’
মুদি ব্যবসায়ী নূরনবী আক্তার বলেন, আব্দুল হাই মন্ডলকে দোকানের পজিশন বাবদ দুই লাখ টাকা দিয়ে ২০০৮ সাল থেকে এই মার্কেটে ব্যবসা করছি। পরবর্তী ২০১৪ সালে তিনি মারা যাওয়ায় তার সন্তানদের ভাড়া দিচ্ছি। কিন্তু বিএনপি নেতা আব্দুর রাজ্জাক মন্ডল গত এক দুই মাস ধরে ভাড়া চাচ্ছেন। তাকে ভাড়া না দিলে দোকানে তালা ঝুলিয়ে দেয়ার ঘোষনা দিয়েছেন।
ভুক্তভোগী ইকবাল রানা বলেন, ‘পৈতৃক সূত্রে ওই জায়গা আমরা ২০০৭ সালে একটি মার্কেট ও একটি সেড নির্মাণ করেছি। নির্মাণের পর থেকেই সেগুলো ভাড়া দেয়া হয়েছে। যথারীতি আমরা ভাড়া আদায় করে আসছি। আমরা কেউ কোন রাজনীতিও করিনা। কিন্তু গত দেড় মাস আগে হঠাৎ মার্কেটের মালিক দাবি করে আব্দুর রাজ্জাক মন্ডল দলের প্রভাব খাটিয়ে সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে দেয়। পরে সেটি সরিয়ে ফেলেছে। কিন্তু এখন আবার মার্কেটের প্রত্যেক দোকানদারের কাছ থেকে তিনি ভাড়া চাচ্ছেন। তাকে ভাড়া না দিলে ব্যবসা বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দিয়েছেন। এর আগে তিনি জোড়পূর্বক সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে মার্কেট দখলের চেষ্টা করেছিলেন। তখন থানায় এটা লিখিত অভিযোগও করেছিলাম।’
ওই জমি সংক্রান্ত বিষয়টি সুরাহা করার জন্য বেলকুচি আসনে বিএনপির এমপি প্রার্থী কেন্দ্রীয় নেতা আমিরুল ইসলাম খাঁন আলিমের কথামত ‘বিএনপির রাজশাহী বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ওই জমির কাগজপত্র যাচাই বাছাই করার দায়িত্ব দেন তাড়াশ উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি খন্দকার সেলিম জাহাঙ্গীরকে। এ বিষয়ে সেলিম জাহাঙ্গীর বলেন,ওই জমির কাগজপত্র নিয়ে আইনজীবীদের সঙ্গে বসেছিলাম। তারা বলেছে আব্দুর রাজ্জাক মন্ডলের বাবা ও তার চাচারা বাটোয়ারা দলিল মূলে ওই জমি আব্দুল হাই মন্ডলের নামে হস্তান্তর করেছেন। সুতরাং ওই জমির মালিক আব্দুল হাই মন্ডল।’
সম্পত্তির মালিক দাবি করে উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক মন্ডল বলেন, এতোদিন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় ওই জায়গায় আমরা যেতে পারি নাই। মূলত হাইকোর্ট ওই জমি আমার বাবা ও চাচাদের ফেরত দিয়েছে। জমিতে আমার বাবার অংশ আছে। এজন্য মার্কেটে থাকা দোকানদারদের কাছে ভাড়া চাওয়া হয়েছে। মার্কেটের ৪৪ শতক জমির মধ্যে ৪০ শতক জমি বাটোয়ারা দলিল মূল্যে আব্দুল হাই মন্ডল মালিক এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ওই দলিলের কোন মূল্য নেই৷ জমি যদি তাদের হয়ে থাকে তাহলে তারা আদালত থেকে আদেশ নিয়ে আসুক।’
সিরাজগঞ্জ জজ কোর্টের আইনজীবি বিষ্ণুপদ সাহা ওই জমির দলিল দস্তাবেজ পর্যালোচনা করে বলেন, উচ্চ আদালতের আদেশ ও বাটোয়ারা দলিল মূল্যে ওই ৪০ শতক জমির প্রকৃত মালিক আব্দুল হাই মন্ডল। তবে তিনি প্রয়াত হওয়ায় তার সন্তানেরা বর্তমান মালিক হয়েছেন। আর অবশিষ্ট ৪ শতক জমির অংশিদার ওসমান গণি মন্ডলের অন্য ওয়ারিশগণ।
এ বিষয়ে বেলকুচি থানার ওসি জাকারিয়া হোসেন বলেন, ‘জমির মালিকানা সংক্রান্ত বিষয় এটি। উভয়পক্ষকে কাগজপত্র অনুযায়ী সমাধান করে নিতে পরামর্শ দিয়েছি।’