
নিজস্ব প্রতিবেদক: ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীতে চলাচলের জন্য ২০১০ সালে ঢাকঢোল পিটিয়ে উদ্বোধন করা ৫০০ কোটি টাকা প্রকল্পের ওয়াটার বাস এখন আর চলছে না । বন্ধ রয়েছে ২০২০ সাল থেকেই । ওয়াটার বাসের প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল সাবেক নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের নির্দেশে । ব্যাপক দুর্নীতি-অনিয়মের এই প্রকল্প থেকে তার বিরুদ্ধে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে । একটি ওয়াটার বাস তৈরিতে ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকা খরচ হলেও শাজাহান খানের নির্দেশে একেকটির নির্মাণ ব্যয় দেখানো হয়েছে ৪০ থেকে ৫০ কোটি টাকা । ওয়াটার বাস প্রকল্প এবং বুড়িগঙ্গা খননকাজে শাজাহান খান কয়েক হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
২০১০ সালের ২৮ অক্টোবর ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে দুটি ওয়াটার বাসের মাধ্যমে বুড়িগঙ্গায় ওয়াটার বাস সার্ভিস চালু হয়েছিল । এর পরপরই এই প্রজেক্টের ব্যর্থতা নিয়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা এবং অভিজ্ঞ মহলের ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন শাজাহান খান । তারপরও তিনি নিজের আখের ঘুছাতে পর্যায়ক্রমে ২০১০ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত মোট ১২টি ওয়াটার বাস তৈরি করে বুড়িগঙ্গায় নামান।
১২টি ওয়াটার বাসের মধ্যে বর্তমানে বিআইডব্লিউটিসির বাদামতলী ঘাটে অরক্ষিত অবস্থায় ৪টি ওয়াটার বাসের সন্ধান পাওয়া গেলেও বাকি ৮টির অস্তিত্ব নেই । বিভিন্ন ল্যান্ডিং পয়েন্টে ওয়াটার বাসের জন্য তৈরি পন্টুনগুলো রয়েছে ছিন্নমূল মানুষের আস্তানা ও মাদকসেবীদের দখলে। রয়েছে রক্ষণাবেক্ষণের অভাব। নদীর ঘাটে ল্যান্ডিং পয়েন্টের পন্টুনে খোঁজ মেলেনি ওয়াটারবাসে কর্মরত চালক ও অন্যান্য স্টাফের।,
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০০২ সালে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ভাইস চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) আকবর হোসেন নৌপরিবহনমন্ত্রী থাকাকালে ঢাকা শহরের যানজট নিরসনে শহরের চারদিকে ৪টি নৌ-পথ চালুর উদ্যোগ নেন। তখন তিনি বুড়িগঙ্গা, বালু, শীতলক্ষ্যা ও তুরাগ নদীর ২৯ কিলোমিটার নৌ-পথ সচল করেন। সে লক্ষ্যে সাতটি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে ঢাকা শহরের যানজট নিরসন প্রকল্পের আওতাধীন নদী খনন শুরু করা হয়। তখন দুটি ওয়াটার বাসের মাধ্যমে প্রকল্প চালু করা হয়। ওয়াটার বাসের জন্য বুড়িগঙ্গার তীরে বিভিন্ন পয়েন্টে ৩ কোটি ৬৭ লাখ টাকা ব্যয়ে ১০টি ল্যান্ডিং স্টেশন তৈরি করা হয় । ২০০৬ সালে বিএনপি ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার পর এ প্রকল্প বন্ধ হয়ে যায়।
২০১০ সালে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতিবাজ নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান দ্বিতীয়বারের মতো বুড়িগঙ্গায় ওয়াটার বাস সার্ভিস চালুর উদ্যোগ নেন । পর্যায়ক্রমে ১২টি ওয়াটার বাস তৈরিতে ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে আবারও ঢাকার বাদামতলী থেকে গাবতলী পর্যন্ত ২৯ কিলোমিটার দূরত্বের নদীপথে বুড়িগঙ্গায় ওয়াটার বাস সার্ভিস চালু করা হয়। ২০১০ সালের ২৮ অক্টোবর ঘটা করে ১০০ কোটি টাকা ব্যয় প্রথমে দুটি ওয়াটার বাস চালু করা হয়। এরপর ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে ২০১০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত আরো ১০টি ওয়াটার বাস বুড়িগঙ্গায় ভাসানো হয়। কিন্তু শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সফলতার মুখ দেখেনি ওয়াটার বাসগুলো। তবে সফল হয়েছেন ওয়াটার বাস প্রকল্পের তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক বর্তমানে বিআইডব্লিউটিসির প্রকৌশল অধিক্ষণ কর্মকর্তা জিয়াউল ইসলাম এবং সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান।
নাম না বলার শর্তে শাজাহান খানের তৎকালীন একজন সহকর্মী জানান, ওয়াটার বাস প্রকল্প এবং বুড়িগঙ্গা খননকাজে শাজাহান খান কয়েক হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি করেছেন। প্রতিটি ওয়াটার বাস তৈরিতে ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকা খরচ হলেও তিনি ৪০ থেকে ৫০ কোটি টাকা খরচ দেখিয়েছেন।
এ ব্যাপারে প্রকৃত তথ্য জানার জন্য বিআইডব্লিউটিসির বাংলা মোটরে ২৪, কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউর প্রধান কার্যালয় যোগাযোগ করা হয়। তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক জিয়াউল ইসলাম জানান, ২০১০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ঢাকার হাইস্পিড, খান ব্রাদার্স গ্রুপ, মেসার্স ঢাকা ডকইয়ার্ড ও কুমিল্লা ডকইয়ার্ড থেকে পর্যায়ক্রমে মোট ১২টি ওয়াটার বাস তৈরি করা হয়েছে। ১২টি ওয়াটার বাস তৈরিতে কত টাকা ব্যয় হয়েছে, তার প্রকৃত তথ্য তিনি দিতে নারাজ। তিনি বলেন, তথ্য পাওয়ার জন্য বিআইডব্লিউটিসির গণসংযোগ দপ্তরে আবেদন করতে হবে।
এ ব্যাপারে তথ্য চেয়ে গত ২০ এপ্রিল হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে বিআইডব্লিউটিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম মিশা বরাবর আবেদন করা হয় । কিন্তু গত ১৫ দিনেও তিনি ১২টি ওয়াটার বাস নির্মাণের প্রকৃত তথ্য দেননি। তথ্য দিতে আরো ১৫ দিন সময় লাগবে বলে জানান।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ১২টি ওয়াটার বাস নির্মাণে ব্যয় দেখানো হয়েছে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা।
বুড়িগঙ্গার ওয়াটার বাসগুলো এখন কোথায় আছে জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিসির উপ-বাণিজ্য ব্যবস্থাপক (যাত্রী) খন্দকার মুহাম্মদ তানভীর হোসেন জানান, বুড়িগঙ্গায় নৌ-দুর্ঘটনা ও নৌকার মাঝি সমিতির বাধায় বুড়িগঙ্গা নদীতে যাত্রী পরিবহনে সফল হয়নি ওয়াটার বাস প্রকল্প। তিনি জানান, ৪ নম্বর ওয়াটার বাস নারায়ণগঞ্জ ডকইয়ার্ডে বিক্রির অপেক্ষায় আছে। ১ ও ২ নম্বর ওয়াটার বাস টাঙ্গুয়ার হাওরে ভাড়া দেওয়া হয়েছে, ৫ নম্বর ওয়াটার বাস আছে চট্টগ্রামে। ৭ নম্বর ওয়াটার বাস কালীগঞ্জের তেলঘাট থেকে লালকুঠি ঘাটে ভাড়া দেওয়া ছিল। বর্তমানে চলাচল বন্ধ রয়েছে। ৯ নম্বর ওয়াটার বাস নৌ-দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ডকইয়ার্ডে মেরামতের জন্য আছে। ৮ নম্বর ওয়াটার বাস মাসিক ৯০ হাজার টাকায় গত ৩ মার্চ চার্টার্ড (ভাড়া) দেওয়া হয়েছে। ওয়াটার বাস নম্বর ৩, ৬, ১০, ১১, ১২ চার্টার্ড দেওয়ার অপেক্ষায় আছে।
অনুসন্ধানকালে বিআইডব্লিউটিসির বাদামতলী ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, ময়লা-আবর্জনা ও জং ধরা অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে এক সময় বুড়িগঙ্গা কাঁপানো ৪টি ওয়াটার বাস। এ সময় ওয়াটার বাস রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিআইডব্লিউটিসির কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী কিংবা ওয়াটার বাসের চালক বা হেলপারকে বাদামতলী ঘাটে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
বাদামতলী ও ওয়াইজঘাট থেকে গাবতলী পর্যন্ত ওয়াটার বাস ভেড়ানোর জন্য তৈরি করা ল্যান্ডিং পয়েন্ট টার্মিনালগুলোর অবস্থা আরো খারাপ। টার্মিনালে ওয়াটার বাস কর্তৃপক্ষের কাউকেই পাওয়া যায়নি। কেরানীগঞ্জের গোলামোড়া টার্মিনাল ঘাটের নৌকার মাঝি ইদ্রিস জানান, গত ৫ বছরে কোনো কর্মকর্তাকে তিনি এ টার্মিনালে দেখেননি। টার্মিনালগুলো দখল করে আছে মাদকাসক্ত ও ছিন্নমূল মানুষরা।
এ ব্যাপারে বিআইডব্লিউটিসির পরিচালক (প্রশাসন) শেখ মুহাম্মদ নাসিমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, বিভিন্ন কারণে দীর্ঘদিন ধরে বুড়িগঙ্গায় ওয়াটার বাস সার্ভিস বন্ধ রয়েছে। আমরা নতুন করে ইজারা দেওয়ার মাধ্যমে ওয়াটার বাসগুলো চালুর প্রক্রিয়া শুরু করছি। আমাদের মূল থিম ছিল বুড়িগঙ্গায় ওয়াটার বাস সার্ভিস চালু করা। যারা ইজারা নেবেন, তারা যদি নদীর এপার-ওপার পারাপারে ওয়াটার বাস সার্ভিস চালু করেন, তাহলে বুড়িগঙ্গায় আবারও চালু করা যাবে ওয়াটার বাস।’