প্রিন্ট এর তারিখঃ জুলাই ১, ২০২৫, ৪:০৭ পি.এম || প্রকাশের তারিখঃ জুন ২০, ২০২৫, ৯:০৮ পূর্বাহ্ণ

নিজস্ব প্রতিবেদক: জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনারের (ইউএনএইচসিআর) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ বিশ্বজুড়ে রাষ্ট্রবিহীন মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৪ লাখে। এদের মধ্যে প্রায় ১২ লাখ—অর্থাৎ এক-চতুর্থাংশের বেশি অবস্থান করছেন বাংলাদেশে। অধিকাংশই মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী, যারা জন্মভূমিতে নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত হয়ে আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে।
জাতিসংঘের ১৯৫৪ সালের কনভেনশন অনুযায়ী, রাষ্ট্রবিহীন বলতে এমন একজন ব্যক্তিকে বোঝায়, যাকে কোনো রাষ্ট্র তার আইনের অধীনে নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না। ফলে তারা নাগরিকত্বসংশ্লিষ্ট মৌলিক অধিকার যেমন ভোটাধিকার, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, চাকরি ও চলাচলের স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত হন।
বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা সর্বোচ্চ
চলতি বছরের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ইউএনএইচসিআরের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে অবস্থান করছেন ১১ লাখ ৩৩ হাজার ৯৮১ জন রোহিঙ্গা। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোতে রোহিঙ্গা আশ্রয়প্রাপ্তির সংখ্যা অনেক কম—মালয়েশিয়ায় ১ লাখ ১১ হাজার, ভারতে ২৩ হাজার, ইন্দোনেশিয়ায় ২ হাজার ৮০০ এবং থাইল্যান্ডে মাত্র ৫০০ জন। পুরো অঞ্চলে রোহিঙ্গা শরণার্থীর মোট সংখ্যা ১২ লাখ ৭২ হাজার, যার ৮৯.১ শতাংশই অবস্থান করছে বাংলাদেশে।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ছিল প্রায় তিন লাখ। ২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারে সেনা অভিযানের মুখে নতুন করে সাড়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে এদেশে আশ্রয় নেয়। বর্তমানে বাংলাদেশে রোহিঙ্গার সংখ্যা ১২ লাখ ছাড়িয়েছে।
সংকুচিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক সহায়তা
জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইস সম্প্রতি জানান, ২০২৪ সালে কক্সবাজার ও ভাসানচরে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের সহায়তায় ৫৮০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সংগ্রহ করা সম্ভব হলেও ২০২৫ সালে এ সহায়তা উল্লেখযোগ্য হারে কমে যেতে পারে। ইতোমধ্যে অনেক সংস্থা কার্যক্রম স্থগিত করেছে বা সীমিত করেছে। ইউনিসেফের শিক্ষা প্রকল্প বন্ধ হওয়ায় চাকরি হারিয়েছেন প্রায় ১,২০০ বাংলাদেশি শিক্ষক, পাঠ বন্ধ হয়েছে প্রায় ৫ লাখ রোহিঙ্গা শিশুর।
প্রত্যাবাসন অনিশ্চিত, নিরাপত্তা হুমকি
২০১৭ সালে বাংলাদেশ-মিয়ানমার চুক্তির মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের পরিকল্পনা থাকলেও বাস্তবায়ন হয়নি। বর্তমানে রাখাইন রাজ্যে জান্তা সরকারের নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে পড়েছে, অধিকাংশ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে সশস্ত্র আদিবাসী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি (AA)। ফলে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ সরকার তাদের সঙ্গে কূটনৈতিক যোগাযোগ রাখলেও মিয়ানমার সরকারের অসন্তোষের আশঙ্কা রয়েছে।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. মিজানুর রহমান বলেন, “আমাদের প্রধান লক্ষ্য রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবাসন। কিন্তু মিয়ানমারের ভেতরে বাস্তবতা এখন আরও জটিল।”
পরিবেশ-অর্থনীতি-আইনশৃঙ্খলা—সবখানেই চাপ
দীর্ঘদিন রোহিঙ্গা বসতির ফলে কক্সবাজার ও আশপাশের বনাঞ্চল ধ্বংস হয়েছে। স্থানীয়দের জীবনমানেও পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব। কম পারিশ্রমিকে শ্রম বিক্রির কারণে স্থানীয় শ্রমিকরা চাকরি হারাচ্ছেন। অপরদিকে, মাদক চোরাচালান, অপহরণ, অস্ত্র ব্যবসা ও চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে পড়ছেন অনেকে, যা নিয়ন্ত্রণে কঠিন হয়ে পড়ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য।
জরুরি সহায়তায় নতুন পরিকল্পনা, তহবিল সংকট বড় বাধা
রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকার, জাতিসংঘ ও বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা ২০২৫-২৬ মেয়াদে যৌথ প্রতিক্রিয়া পরিকল্পনা (Joint Response Plan) গ্রহণ করেছে। এতে ৯৩৪.৫ মিলিয়ন ডলার সহায়তা আহ্বান করা হয়েছে, যার মাধ্যমে কক্সবাজার ও ভাসানচরে আশ্রিত রোহিঙ্গা ও স্থানীয় মিলে প্রায় ১৫ লাখ মানুষ উপকৃত হবেন। কিন্তু সরকারি সূত্রে জানা গেছে, এর মাত্র ১৫ শতাংশ অর্থই এখন পর্যন্ত নিশ্চিত হয়েছে।
কূটনৈতিক সমন্বয়ে নতুন দৃষ্টিভঙ্গির আহ্বান
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, “মিয়ানমার সরকারকে এমন একটি প্রক্রিয়ার অংশ করতে হবে যাতে তারা নিজেদের লাভ দেখেন। তবেই তারা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে আগ্রহী হবে। পাশাপাশি বিদেশি সাহায্য সংস্থাগুলোর খরচ কাঠামো পুনর্বিবেচনা জরুরি। দুর্বল অর্থনীতিতে স্থানীয় কর্মীদের বাদ দিয়ে বিদেশি কর্মীদের উচ্চ ব্যয়বহুল নিয়োগ যৌক্তিক নয়।”
রোহিঙ্গা সংকট কেবল একটি মানবিক ইস্যু নয়, এটি বাংলাদেশের জন্য এখন কৌশলগত চ্যালেঞ্জও। সংকট যত দীর্ঘায়িত হচ্ছে, চাপ তত বাড়ছে। প্রয়োজন বাস্তবভিত্তিক, দায়িত্বশীল আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং মিয়ানমারকে প্রত্যাবাসনে কার্যকরভাবে সম্পৃক্ত করার নতুন কূটনৈতিক কৌশল। তা না হলে বিশ্বের এক-চতুর্থাংশ রাষ্ট্রবিহীন মানুষের ভার বাংলাদেশ একা বহন করে যেতে পারবে না—এমন আশঙ্কাই এখন প্রকট।