বিয়ের অতিথিদের জেরা করবে দুদক

নিজস্ব প্রতিবেদক: ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৪৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. আনিসুর রহমান নাঈম ২০০৯ সালে বিয়ে করেন। তিনি বিয়ের সময় ৬৪ ভরি স্বর্ণালংকার পেয়েছেন বলে আয়কর রিটার্নে উল্লেখ করেন। নাঈমের অতিথিরা আসলেই এসব স্বর্ণালংকার উপহার দিয়েছিলেন কি না, তা জানতে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সেজন্য তাদের তালিকা সংগ্রহের পরিকল্পনা করছে সংস্থাটি।

দুদক কর্মকর্তারা মনে করেন, ওই তালিকা ধরে অনুসন্ধান ও জিজ্ঞাসাবাদ করলেই প্রকৃত তথ্য বেরিয়ে আসবে।

সংস্থার তথ্যমতে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৪৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. আনিসুর রহমান নাঈমের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাণিজ্য, জমি দখল ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপসহ বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ পেয়েছে সংস্থা। দুদকের ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১-এর সহকারী পরিচালক মো. মাহবুব মোর্শেদ অভিযোগটি অনুসন্ধান করছেন। অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে দুদক ২০২৩ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর নাঈমের সম্পদ বিবরণী দুদকে দাখিলের জন্য নোটিস জারি করে। ওই নোটিস পেয়ে তিনি সম্পদ বিবরণী দাখিল করেন। অনুসন্ধানকালে কাউন্সিলর নাঈমের আয়কর নথিসহ অন্যান্য রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করেছেন দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা। আয়কর নথির তথ্যমতে, আয়কর নথিতে নাঈমের সোয়া তিন কাঠা জমি, নগদ ১ লাখ টাকা, ব্যাংক জমা ১ কোটি ১৮ লাখ ৪০ হাজার, গোল্ডেন থ্রি প্রপার্টিজে ৮ লাখ টাকার শেয়ার, ৯০ লাখ টাকার প্রাডো গাড়িসহ আসবাবপত্র, টিভি-ফ্রিজ থাকার তথ্য দিয়েছেন। তিনি ৯০ লাখ টাকার গাড়ি কিনতে ১ কোটি ৬ লাখ ৯ হাজার গাড়ি ঋণ দেখিয়েছেন। এ ছাড়া তার আয়কর নথিতে বিয়ের সময় উপহার হিসেবে ৬৪ ভরি স্বর্ণালংকার পেয়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন। বিবরণীতে এর দাম উল্লেখ না থাকলেও বর্তমানে বাজারমূল্য পৌনে ১ কোটি টাকা। বিয়েতে এত বিপুল পরিমাণ স্বর্ণালংকার উপহার হিসেবে পাওয়া সন্দেহজনক মনে করছে দুদক। এ কারণে সংস্থা বিষয়টি নিশ্চিত হতে চায় নাঈমের বিয়েতে কারা অতিথি ছিলেন, কারা এসব স্বর্ণালংকার উপহার দিয়েছেন। দুদক জানতে চায়, আসলেই নাঈম এসব স্বর্ণালংকার উপহার হিসেবে পেয়েছেন, নাকি অবৈধ টাকায় স্বর্ণালংকার কিনে আয়কর রিটার্নে উপহার হিসেবে দেখানো হয়েছে’।

দুদকের মহাপরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন বলেন, অনেকই আছেন যারা অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থে গাড়ি, বাড়ি, জমি, স্বর্ণালংকারসহ বিভিন্ন দামি পণ্যসামগ্রী কিনে দান বা উপহার বলে চালিয়ে দেন। তারা এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অবৈধ আয়কে বৈধ করার চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, যদি কারও বিয়েতে বেশি পরিমাণ স্বর্ণালংকার উপহারের বিষয় থাকে তাহলে অনুসন্ধান কর্মকর্তা অতিথি তালিকা সংগ্রহ করে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করলেই সব বেরিয়ে আসবে।

জানা গেছে, আনিসুর রহমান নাঈমের পরিবার এক সময় খুবই সাধারণ জীবনযাপন করতেন। তিনি ২০১৯ সালের ১৬ নভেম্বর ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। একই বছর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৪৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পর তার পরিবার এখন বিত্তবান।

জানা গেছে, ডিএনসিসির ৪৯ নম্বর ওয়ার্ডটি আশকোনা, কাওলা ও গাওয়াইর এলাকা নিয়ে গঠিত। সেখান বর্তমান কাউন্সিলর মো. আনিসুর রহমান নাঈম। তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাণিজ্য, জমি দখল, সন্ত্রাসী কর্মকা- ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানে ২০২০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর মাঠে নামে দুদক। এরপর ২০২৩ সালে তার বিরুদ্ধে আবারও অভিযোগ জমা হয় দুদকে। আগের অভিযোগের সঙ্গে নতুন আসা অভিযোগ যুক্ত করে ২০২৩ সালের ১৮ জুন অনুসন্ধানে নামে দুদক’।

অনুসন্ধান কর্মকর্তা দুদকের সহকারী পরিচালক মো. মাহবুব মোর্শেদ তফসিলি ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, রেজিস্ট্রি অফিস, বিআরটিএ ও ভূমি অফিস থেকে তথ্য সংগ্রহ করেন। বর্তমানে এসব নথিপত্র পর্যালোচনা চলছে। শিগগিরই কমিশনে অনুসন্ধান প্রতিবেদন দাখিল হতে পারে। সেই প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেবে কমিশন।

দুদকের কাছে থাকা অভিযোগে বলা হয়, বিমানবন্দর ও আশকোনা এলাকার ত্রাস হিসেবে পরিচিত নাঈম। কাউন্সিলর হওয়ার পর দ্রুতই তার পরিবারের আর্থিক উন্নতি হয়েছে। রাজধানীর বিমানবন্দর, কাওলা, শিয়ালডাঙ্গা ও গাওয়াইরসহ আশপাশের এলাকায় দখল ও চাঁদাবাজির জন্য রয়েছে নাঈমের নিজস্ব ‘বাহিনী’ তারা এলাকায় ‘নাঈম খলিফা’ হিসেবে পরিচিত।

এয়ারপোর্ট পাবলিক টয়লেট তার দখলে: অভিযোগ রয়েছে, এয়ারপোর্ট পাবলিক টয়লেটটি ৪৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নাঈমের নির্দেশে তাজুল দখল করে নেন। টয়লেটের আয় থেকে নাঈমকে প্রতি মাসে নির্দিষ্ট একটা অর্থ দেওয়া হয়। এয়ারপোর্ট পাবলিক টয়লেট চত্বর ঘিরে অবৈধভাবে গড়ে উঠছে কয়েকটি হোটেল ও দোকানপাট। এসব দোকানে টয়লেট থেকেই বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়েছে। প্রতিদিন টয়লেট থেকে বিক্রি হয় হাজার-হাজার গ্যালন পানি। অসংখ্য মোটরসাইকেল ও গাড়ি ধোয়ার কাজও চলে এ টয়লেটের পানি দিয়ে। এখান থেকে প্রতিদিন প্রায় ৮০ হাজার টাকা আয় হয়। কিছু অংশ সিটি করপোরেশনকে দেন তাজুল। আর বাকিটা নিজেরা ভাগবাটোয়ারা করে নেন।

মাদ্রাসার টাকা যাচ্ছে নাঈমের কাছে: অভিযোগ রয়েছে, নাঈম ও তার পরিবারের সদস্যরা বিমানবন্দর গোলচত্বরের পূর্বপাশের বাবুস সালাম মসজিদ মাদ্রাসা কমপ্লেক্স মার্কেট দখল করে নেন। মসজিদ দখল নিয়ে স্থানীয় লোকজন বলছেন, মসজিদে দান ও মার্কেট থেকে মাসে প্রায় ৫০ লাখ টাকার মতো আয় হয়। নাঈম জোর করে দোকানগুলোর ভাড়া নিয়ে যান। কমপ্লেক্সের টাকা ইচ্ছেমতো ব্যয় করেন। তিনি কারও কাছে জবাবদিহি করেন না। মসজিদের দখলকে কেন্দ্র করে ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে ‘নাঈম বাহিনীর’ হামলায় চারজন আহত হয়। এ ঘটনায় আহত ব্যবসায়ী নাজমুল হোসেন ভূঁইয়া ওরফে প্রিন্স বিমানবন্দর থানায় নাঈমসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এ ছাড়া মসজিদ কমপ্লেক্স দখলের অভিযোগে আদালতে মামলা করেছেন বাবুস সালাম ওয়াকফ এস্টেটের মোতাওয়াল্লি সৈয়দ মোস্তফা হোসেন। মামলায় কাউন্সিলর নাঈম, মোতালেব মুন্সী ও মামুন সরকারকে আসামি করা হয়।

দখল করা জায়গায় গ্যারেজ: অভিযোগ রয়েছে, কাওলা এলাকায় আশিয়ান সিটির প্রবেশমুখের কাছে প্রায় পাঁচ বিঘা জমি দখল করেছেন নাঈম ও তার লোকজন। সেখানে অবৈধ বাস টার্মিনাল ও রিকশা গ্যারেজ করে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। কাউন্সিলরের কার্যালয়ও করা হয়েছে সেখানে। কাওলা সিভিল অ্যাভিয়েশন স্টাফ কোয়ার্টারে সংস্কার-নির্মাণকাজসহ সব ধরনের ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করে ‘নাঈম বাহিনী’। তারা ঢাকা কাস্টম হাউজেরও কিছু অংশ নিয়ন্ত্রণ করে, সেখান থেকেও বিপুল পরিমাণ অর্থ পেয়ে থাকে।

যেখান থেকে চাঁদা আদায় করা হয়: কাউন্সিলর নাঈমের চাঁদাবাজি নিয়ে পুলিশের এক প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। দুদক সেটি অনুসন্ধানের জন্য আমলে নেয়। অভিযোগে বলা হয়, নাঈমের বিরুদ্ধে জনৈক তাজুল ইসলামের মাধ্যমে কসাইবাড়ি পাবলিক টয়লেট থেকে মাসে ১ লাখ ৮০ হাজার, বিমানবন্দর রেলস্টেশনের পাবলিক টয়লেট থেকে দক্ষিণখান থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি বাবু ওরফে ‘জামাই বাবুর’ মাধ্যমে মাসে ৩০ হাজার, আশিয়ান সিটি হয়ে দক্ষিণখান বাজার-গাওয়াইর রুটে ইজিবাইক থেকে মাসে ১ লাখ, কাওলা রেলগেট থেকে শিয়ালডাঙ্গা হয়ে দক্ষিণখান বাজার রুটে চলাচল করা অটোরিকশা থেকে জনৈক আজমের মাধ্যমে মাসে ১ লাখ, কসাইবাড়ির ছয়টি বাস কাউন্টার থেকে জনৈক জান্নাতের মাধ্যমে মাসে ৩০ হাজার, কসাইবাড়ি টায়ারপট্টি ফুটপাত থেকে জান্নাত ও আজমের মাধ্যমে প্রতি মাসে ৪০ হাজার, মুক্তিযোদ্ধা মার্কেটের সামনের ফুটপাত থেকে এক ব্যক্তির মাধ্যমে মাসে ৩০ হাজার, আশকোনা রেলগেট থেকে হাজি ক্যাম্প পর্যন্ত ফুটপাতে ‘জামাই বাবুর’ মাধ্যমে প্রতি মাসে ৩০ হাজার, বাবুস সালাম মসজিদ মার্কেটের দুটি আবাসিক হোটেল থেকে ম্যানেজার মনিরের মাধ্যমে দৈনিক ১৫ হাজার টাকা করে মাসে ৪ লাখ ৫০ হাজার, রেলস্টেশন ও রেললাইনের পূর্বপাশে পার্কিংয়ের দোকান (পুকুরপাড়) থেকে জনৈক সাজু ও রুবেলের মাধ্যমে মাসে ১ লাখ ২০ হাজার, রেললাইনের পশ্চিমপাশে জনৈক শাহীন আক্তারের মাধ্যমে দৈনিক সাড়ে ১০ হাজার টাকা হিসাবে মাসে ৩ লাখ ১৫ হাজার টাকা আদায় করেন কাউন্সিলর নাঈম।’

Facebook
Twitter
WhatsApp
Pinterest
Telegram

এই খবরও একই রকমের

সিরাজগঞ্জে বাসদের উদ্যোগে গাজায় ইসরাইলি বাহিনীর হামলা ও গনহত্যার প্রতিবাদে মানববন্ধন

নজরুল ইসলামঃ যুদ্ধবিরতিকে অমান্য করে গাজায় ইসরাইলি বাহিনীর হামলা ও গনহত্যার প্রতিবাদে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) সিরাজগঞ্জ জেলার উদ্যোগে মানববন্ধন সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৃহস্পতিবার (২০

তাড়াশে চালের কার্ড করে দেওয়ার নামে টাকা নিয়েছেন চেয়ারম্যানের শ্বশুড়  

তাড়াশ (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধিঃ সিরাজগঞ্জের তাড়াশে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় হতদরিদ্র, গরীব অসহায় পরিবারকে ৩০ কেজি করে সাশ্রয়ী মূল্যে চালের কার্ড করে দেওয়ার নামে টাকা তুলে আত্মসাতের

প্রথম আলোর ওয়েবসাইট হ্যাক করে সতর্কবার্তা

ঠিকানা টিভি ডট প্রেস: দেশের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা প্রথম আলোর ওয়েবসাইট হ্যাক করে সতর্কবার্তা জুড়ে দেওয়া হয়েছে। ‘প্রিয় মতিউর রহমান স্যার এবং প্রথম আলোর কর্মীবৃন্দ’ সম্বোধন

মন্দিরে আগুন, সন্দেহের জেরে ২ ভাইকে পিটিয়ে হত্যা

নিজস্ব প্রতিবেদক: ফরিদপুরের মধুখালীর ডুমাইন ইউনিয়নের পঞ্চপল্লীতে গণপিটুনিতে দুই নির্মাণশ্রমিক নিহত হয়েছেন। এ সময় পুলিশ সদস্যসহ গুরুতর আহত হয়েছেন আরও আটজন। এলাকায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ

তাড়াশে নয়াদিগন্তের ২০ বছর পূর্তি উৎসব উদযাপন 

লুৎফর রহমান তাড়াশ: সত্যের পথে অবিচল থাকার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে সিরাজগঞ্জের তাড়াশে নয়া দিগন্তের ২০বছর পূর্তি উৎসব পালিত হয়েছে। ২৬ (অক্টোবর) বেলা ১২ টায় তাড়াশ

মানুষ স্বৈরাচারকে বিদায় করেছে, এখন দেশ গড়ার পালা: তারেক রহমান

নিজস্ব প্রতিবেদক: বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, আমরা স্বৈরাচার মুক্ত করেছি দেশ। দেশের মানুষ স্বৈরাচারকে বিদায় করেছে দেশ থেকে। এখন সামনের দিনে দেশ গড়ার