নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশের বিমানবন্দরে যাত্রী তথ্য ব্যবস্থাপনায় নতুন প্রযুক্তি স্থাপনের একটি স্পর্শকাতর প্রকল্পে আর্থিক অনিয়ম, স্বার্থের সংঘাত ও আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আই–এর এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে জানা গেছে, এ প্রকল্পে সরাসরি জড়িত রয়েছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাষ্ট্রদূত আবদুল্লাহ আলী আলহমুদি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, রাষ্ট্রদূত আলহমুদি ৩৪ শতাংশ মালিকানা নিয়ে দুবাইভিত্তিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ‘আইডেন্টিমা’র অংশীদার। আর এই প্রতিষ্ঠানকেই বাংলাদেশে নতুন প্যাসেঞ্জার ইনফরমেশন সিস্টেম বাস্তবায়নের কাজে সাব-কন্ট্রাক্ট দেওয়া হয়।
নথিপত্র অনুযায়ী, রাষ্ট্রদূত থাকা অবস্থায়ই তিনি আইডেন্টিমা প্রতিষ্ঠা করেন এবং প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার হিসেবেও তালিকাভুক্ত থাকেন। ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী, কর্মরত কূটনীতিক নিজ দায়িত্ব পালনের দেশ থেকে কোনো বাণিজ্যিক লাভ নিতে পারেন না, যা এই পরিস্থিতিতে লঙ্ঘিত হয়েছে।
২০২২ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ও আমিরাত সরকারের মধ্যে যাত্রী তথ্য সংগ্রহ এবং নিরাপত্তা নিশ্চিতের লক্ষ্যে একটি সমঝোতা স্মারক (MoU) স্বাক্ষর হয়। এর আওতায় আমিরাতের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান এমিরেটস টেকনোলজি সলিউশনস (Etek) কে দায়িত্ব দেওয়া হয়, যারা আবার প্রকল্পের একটি বড় অংশ আইডেন্টিমাকে হস্তান্তর করে।
আইডেন্টিমা পরে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান সিটার (SITA) সঙ্গে চুক্তি করে প্রকল্প বাস্তবায়নে। যদিও সিটা এই খাতে আন্তর্জাতিকভাবে অভিজ্ঞ, তবে প্রশ্ন উঠেছে মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা ও চার্জ নির্ধারণ নিয়ে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, এই সেবার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে যাত্রীপ্রতি প্রাথমিকভাবে ৬.৫০ মার্কিন ডলার গুণতে হয়, যা পরে ৪ ডলারে নামানো হয়। আন্তর্জাতিক সিভিল অ্যাভিয়েশন অর্গানাইজেশন (ICAO) যেখানে সর্বোচ্চ ৩.৫০ ডলার চার্জের সুপারিশ করে, সেখানে সংযুক্ত আরব আমিরাতে একই সেবার জন্য ১.৫০ ডলার চার্জ নেওয়া হয়।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এ চুক্তিকে ‘ক্ষমতার অপব্যবহার ও স্বার্থের সংঘাতের সুস্পষ্ট উদাহরণ’ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, “একজন রাষ্ট্রদূত সরকারের অনুমোদন ছাড়া কোনো বাণিজ্যিক কার্যক্রমে যুক্ত হতে পারেন না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, তার বিনিয়োগের উৎস কী?”
তিনি আরও বলেন, “একজন কর্মরত রাষ্ট্রদূতের কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে সম্পৃক্ততা শুধু অনৈতিক নয়, এটি কূটনৈতিক শিষ্টাচারেরও লঙ্ঘন।”
প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, আইডেন্টিমার বাকি ৬৬ শতাংশ মালিকানা রয়েছে বাংলাদেশের দুই নাগরিক মুনতাসির বিল্লাহ শাহরিয়ার ও সাজেদ আহমেদ সামির-এর হাতে। শাহরিয়ারকে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং তাঁর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের একটি ছবিও প্রতিবেদনে সংযুক্ত করা হয়েছে।
এ বিষয়ে মিডল ইস্ট আই রাষ্ট্রদূত আলহমুদি, ঢাকার আমিরাত দূতাবাস, বাংলাদেশ সরকার এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করলেও কেউ মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
এদিকে বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) প্রকল্পের ধীরগতির বিষয়টি স্বীকার করে চলতি বছরের শুরুতে একটি পর্যালোচনা কমিটি গঠন করেছে। রাষ্ট্রদূতের সম্পৃক্ততা সামনে আসায় প্রকল্পটির ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিষয়টি কেবল অর্থনৈতিক নয়, এটি বাংলাদেশের কূটনৈতিক নীতিমালাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ফলে বিষয়টির পূর্ণাঙ্গ, স্বচ্ছ এবং স্বাধীন তদন্তের দাবি উঠছে বিভিন্ন মহল থেকে।
ইপেপার
Copyright © 2025 ThikanaTV.Press. All rights reserved.