
নিজস্ব প্রতিবেদক: দীর্ঘ এক যুগ ধরে বিদ্যুৎ খাতের নামে রাষ্ট্রীয় অর্থের লুটপাট ও বিদেশে অর্থপাচারের ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে সাবেক বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু ও তাঁর ভাই-বন্ধু চক্রের বিরুদ্ধে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ইতোমধ্যে বিপুসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে সম্পদ অনুসন্ধান শুরু করেছে।
দুদক ও একাধিক তদন্তসূত্রে জানা গেছে, বিপু এবং তাঁর ছোট ভাই ইন্তেখাবুল হামিদ অপু, ঘনিষ্ঠ বন্ধু আলমগীর শামসুল আলামিন (কাজল), আত্মীয় কামরুজ্জামান চৌধুরী এবং মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সুবিধাভোগী কর্মকর্তার সমন্বয়ে গঠিত চক্রটি বিদ্যুৎ প্রকল্প, মিটার সরবরাহ, আইটি সেবা ও বিদেশি ক্রয়াদেশের আড়ালে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে।
বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা সম্পদের ছক:
যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় ৩৬ লাখ ডলারের বিলাসবহুল বাসা ও দেড় ডজন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান
দুবাইয়ে স্ত্রী সীমা হামিদের নামে তিনটি অ্যাপার্টমেন্ট, পুত্র জারিফ হামিদের একাধিক ব্যবসা
লন্ডন, ম্যানচেস্টার ও কানাডায় আবাসন ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান
মাল্টা, মালয়েশিয়া, তুরস্ক, সিঙ্গাপুর ও ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জে বিনিয়োগ
বিদ্যুৎ প্রকল্পের নামে দুর্নীতি:
সূত্র জানায়, বিভিন্ন বিদ্যুৎ প্রকল্প গ্রহণ থেকে অনুমোদন পর্যন্ত অন্তত ২০টি ধাপে ঘুষ নেওয়া হতো। প্রকল্প প্ল্যানিং, সাইট ভিজিট, দরপত্র ছাড়, কমিশনিং, বিল ছাড়, এমনকি পরিচালনা পর্ষদে পদ নিয়োগেও মোটা অঙ্কের অর্থ লেনদেন হতো।
আইটি খাতে বিপুর ভাইয়ের নেতৃত্বে অন্তত ১২টি মেগা প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। ডিপিডিসি, নেসকো, আরইবি, ডেসকোসহ ছয়টি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় আট হাজার কোটি টাকার কাজ আদায় করা হয় বিভিন্ন নামে-বেনামে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে।
মিটার বাণিজ্যেও দুর্নীতি ও পাচার:
২০১০ সাল থেকে শুরু হওয়া প্রিপেইড মিটার প্রকল্পে ৪.৫ কোটির বেশি মিটার সরবরাহের লক্ষ্যে গঠিত একটি চক্র দরপত্র ছাড়া চীনা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগসাজশে কয়েক হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য করে। এই চক্রের পেছনে বিপু ও কাজল সরাসরি যুক্ত ছিলেন।
ক্যাপাসিটি চার্জে অর্থ লোপাট:
কুইক রেন্টাল প্রকল্পের আওতায় প্রয়োজনের চেয়ে দ্বিগুণ বিদ্যুৎকেন্দ্র অনুমোদন দিয়ে সরকার ১৬ বছরে ১ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়েছে। এই অর্থের বড় অংশ পাচার হয়েছে বলে অভিযোগ।
বিশেষজ্ঞদের মতামত:
বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “পাচারকারীদের শাস্তির আওতায় না আনলে তারা আরও উৎসাহিত হবে।”
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. এম শামসুল আলম বলেন, “বিনা দরপত্রে বিদ্যুৎ প্রকল্প দেওয়ার বিষয়টি ছিল একটি সুপরিকল্পিত লুণ্ঠন।”
বিদ্যুৎ খাতে দীর্ঘদিনের অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র এবার দুদকের তদন্তে প্রকাশ্য হতে শুরু করেছে। জনস্বার্থে এই চক্রের জবাবদিহি নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি।