বিশেষ প্রতিনিধি: সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, যিনি লোটাস কামাল নামে পরিচিত, তাঁর এবং তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে বিদেশে বিপুল সম্পদের মালিক হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ অন্তত সাতটি দেশে তাঁদের সম্পদের বিস্তার রয়েছে বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও অনুসন্ধানী সূত্র জানিয়েছে। এসব সম্পদের বড় একটি অংশের অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে।
আলোচিত লোটাস কামাল একসময় দেশের পরিকল্পনা এবং অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, ব্যাংক খাত থেকে অর্থ আত্মসাৎ এবং জনশক্তি রপ্তানিতে প্রতারণাসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। অর্থনীতিবিদদের একাংশ মনে করেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির দুর্বলতার পেছনে সাবেক এই মন্ত্রীর ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য।
দুবাইয়ে ১৮টি বাড়ি, একাধিক ব্যবসা
ইউরোপীয় সংস্থা ইউ ট্যাক্স অবজারভেটরির তথ্যমতে, ২০২২ সালে দুবাইয়ের আবাসন খাতে ৫৩২ জন বাংলাদেশির মালিকানার তথ্য উঠে আসে, যার মধ্যে লোটাস কামাল ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নাম রয়েছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দুবাইয়ে কামাল পরিবারের নামে অন্তত ১৮টি বাড়ি ও ফ্ল্যাটের মালিকানা রয়েছে। এর মধ্যে আ হ ম মুস্তফা কামালের তিনটি, তাঁর স্ত্রী কাশমেরি কামালের নয়টি এবং মেয়ে নাফিসা কামালের চারটি বাড়ি রয়েছে। এসব বাড়ির মোট আনুমানিক মূল্য প্রায় ৯৩৭ কোটি টাকা (বাংলাদেশি মুদ্রায়)।
এ ছাড়া দুবাইয়ে তাঁদের মালিকানাধীন অন্তত ১৮টি নিবন্ধিত কোম্পানির অস্তিত্ব মিলেছে। এর মধ্যে 'অরবিটাল ইন্টারন্যাশনাল' নামে একটি প্রতিষ্ঠান নির্মাণ ও আবাসন খাতে কাজ করছে। কাশমেরি কামাল প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম মালিক। জানা গেছে, অরবিটাল ইন্টারন্যাশনালের মাধ্যমে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিভিন্ন অঞ্চলে ছয়টি বড় আকারের আবাসন প্রকল্পের কাজ চলছে, যার মোট বিনিয়োগ প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা।
নাফিসা কামালের ব্যবসায়িক সম্প্রসারণ
লোটাস কামালের মেয়ে নাফিসা কামাল দুবাইয়ে 'এনকে স্পোর্টস' নামের একটি কোম্পানি পরিচালনা করছেন, যার কার্যক্রম মূলত ক্রীড়া ইভেন্ট ও চ্যারিটি আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত। ওই কোম্পানির পৃষ্ঠপোষকদের তালিকায় বাংলাদেশের সাবেক ক্রিকেট অধিনায়ক সাকিব আল হাসানের নাম রয়েছে। এনকে স্পোর্টসে আনুমানিক ৭৫০ কোটি টাকার বিনিয়োগ হয়েছে বলে জানা যায়।
এ ছাড়া নাফিসা কামালের মালিকানাধীন 'ফ্যাশন হাউস' নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে বিলাসবহুল পোশাক আমদানি করে দুবাই ও শারজাহ শহরের ছয়টি আউটলেটে বিক্রি করা হয়। সম্প্রতি তিনি শারজাহতে একটি কসমেটিকস কোম্পানির ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছেন। চলতি বছরের ডিসেম্বর নাগাদ ওই ফ্যাক্টরির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পরিকল্পনা রয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে বিনিয়োগের বিস্তার
তথ্য অনুযায়ী, কাতারে ২০২২ সালের ফুটবল বিশ্বকাপের সময় নাফিসা কামাল ব্যবসায়িক বিনিয়োগ শুরু করেন। বর্তমানে তিনি কাতারে নিবন্ধিত ব্যবসায়ী, এবং কাতারের স্টক এক্সচেঞ্জে তাঁর উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ রয়েছে। পাশাপাশি সৌদি আরবে একটি শপিং মল নির্মাণের জন্য আবেদন করেছেন তিনি ও তাঁর মা কাশমেরি কামাল। সৌদি ফুটবল ক্লাব আল নাহিয়ানসহ দুটি ক্লাবের শেয়ার কিনতেও আগ্রহ প্রকাশ করেছেন নাফিসা কামাল।
অন্যদিকে, যুক্তরাজ্যে লোটাস কামাল পরিবারের বাসস্থান ও ব্যবসার তথ্য পাওয়া গেছে। জানা যায়, লন্ডনে তাঁদের একটি বাড়ি রয়েছে, যেখানে পরিবারের ছোট মেয়ে বসবাস করেন। দুবাইয়ের ঠিকানা ব্যবহার করেই লোটাস কামাল সুইস ব্যাংকে বিপুল পরিমাণ অর্থ রেখেছেন বলে একাধিক সূত্র দাবি করলেও, ব্যাংকের গোপনীয়তার কারণে বিষয়টি স্বাধীনভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
ভানুয়াতুর নাগরিকত্ব ও গোল্ডেন পাসপোর্ট
অর্থ পাচার ইস্যুতে আলোচনার কেন্দ্রে থাকা লোটাস কামাল প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্র ভানুয়াতুর নাগরিকত্ব নিয়েছেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, তিনি নিজের পূর্ণ নাম 'আবু হেনা মোস্তফা কামাল' ব্যবহার করে এ নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। ভানুয়াতুর গোল্ডেন পাসপোর্ট স্কিমের আওতায় প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার মার্কিন ডলারের বিনিময়ে তিনি নাগরিকত্ব লাভ করেন, যা বিশ্বের ১৩০টির বেশি দেশে ভিসামুক্ত ভ্রমণের সুবিধা দেয়। করমুক্ত সুবিধার জন্য ভানুয়াতু বিশ্বের বিতর্কিত ব্যবসায়ী ও রাজনীতিকদের পছন্দের গন্তব্য বলে পরিচিত।
বাংলাদেশে তদন্তের অগ্রগতি নেই
লোকাল ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অভিযোগ ও তথ্যপ্রমাণ উঠলেও এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে কোনো দৃশ্যমান আইনি পদক্ষেপ বা অনুসন্ধানের অগ্রগতি নেই। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অর্থ পাচার এবং বিদেশে সম্পদের তদন্তে দুর্বলতা দেশীয় অর্থনীতির জন্য বড় হুমকি তৈরি করছে।
এ বিষয়ে লোটাস কামাল বা তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
ইপেপার
Copyright © 2025 ThikanaTV.Press. All rights reserved.