নিজস্ব প্রতিবেদক: একসময় ক্ষমতাসীন বিএনপির সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হিসেবে পরিচিতি পাওয়া নেত্রকোণার লুৎফুজ্জামান বাবর বর্তমানে দলীয় রাজনীতিতে প্রায় অচেনা মুখ। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের মেয়াদে বাবর ছিলেন অন্যতম আলোচিত, কখনও বিতর্কিতও। তবে সময়ের বিবর্তনে এখন তিনি দলের কেন্দ্রীয় কিংবা জেলা পর্যায়—কোথাও পদ-পদবি ছাড়াই প্রায় উপেক্ষিত অবস্থায় রয়েছেন।
২০০৭ সালের সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় থেকেই তার রাজনৈতিক পতনের সূচনা বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকরা। জানা গেছে, ওই সময় বিএনপিতে গড়ে ওঠা সংস্কারপন্থী নেতাদের অন্যতম ছিলেন বাবর। যদিও অনেক নেতা চাপের মুখে ওই গ্রুপে যুক্ত হলেও বাবর নিজের উৎসাহে এই অবস্থান নিয়েছিলেন বলে দলের ভেতরেই অভিযোগ রয়েছে।
সংস্কারপন্থী অবস্থানের মূল্য
'মাইনাস-টু' ফর্মুলা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে সরানোর চেষ্টা করছিল। বিএনপিতে গোপনে-স্পষ্টভাবে তখন বিভক্তি তৈরি হয়। দলের তৎকালীন মহাসচিব আব্দুল মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বাধীন সংস্কারপন্থী গ্রুপের একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে বাবর দলের ভেতরে নিজের অবস্থান আরও জটিল করে তোলেন। এমনকি খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে নিয়ে বিরূপ মন্তব্যও করেছিলেন তিনি, যা আজও ভুলতে পারেনি বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃত্ব।
এরই ধারাবাহিকতায়, ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে বাবরকে মনোনয়ন দেয়নি বিএনপি। তিনি জেল থেকেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নেত্রকোণায় নির্বাচনে অংশ নেন। স্থানীয় বিএনপি কর্মীদের একাংশের সমর্থন পেলেও দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে অবস্থানের কারণে কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে গুরুত্ব হারান তিনি।
দীর্ঘ কারাবাস ও মুক্তির পর পরিস্থিতি
বিভিন্ন দুর্নীতি, অস্ত্র এবং রাজনৈতিক মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে দীর্ঘ প্রায় ১৭ বছর কারাগারে ছিলেন লুৎফুজ্জামান বাবর। বিশেষ করে দশ ট্রাক অস্ত্র মামলা ও একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় তার বিরুদ্ধে কঠোর সাজা হয়েছিল। তবে গত বছর রাজনৈতিক পালাবদলের পর সব মামলায় খালাস পান তিনি।
এ বছরের ১৬ জানুয়ারি বাবর কারামুক্ত হন। নেত্রকোণায় নিজ এলাকার কর্মী-সমর্থকরা তাকে অভ্যর্থনা জানালেও বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের কাউকে দেখা যায়নি। একইভাবে ৭ মে খালেদা জিয়ার বিদেশ সফর শেষে দেশে ফেরার দিন গুলশানের ফিরোজা ভবনের সামনে বাবর দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকলেও কোনো কেন্দ্রীয় নেতা তাকে বাসার ভেতরে ডাকার প্রয়োজন মনে করেননি। শেষ পর্যন্ত ভিড়ের মধ্যে খালেদা জিয়াকে এক নজর দেখার সুযোগ পেলেও তার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়নি বাবরের।
বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থান
বিএনপির কেন্দ্রীয় বা জেলা কমিটিতে বাবরের কোনো পদ নেই। তিনি এখন কেবল প্রাথমিক সদস্য। যদিও নেত্রকোণার স্থানীয় রাজনীতিতে তার কিছু ব্যক্তিগত প্রভাব রয়েছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে তিনি নিজে প্রার্থী হতে না পারায় তার স্ত্রীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল, যা দলের পক্ষ থেকে বাবরের প্রতি আংশিক সহানুভূতির প্রতিফলন ছিল বলে মনে করা হয়।
পর্যবেক্ষকদের বিশ্লেষণ
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বাবরের অবস্থান এবং পরবর্তীতে দলের বিরুদ্ধে কথাবার্তা বিএনপির উচ্চপর্যায়ের নেতারা এখনও ভুলে যেতে পারেননি। সে কারণেই আজও বাবর দলের মূল নেতৃত্বের আস্থাভাজন হতে পারেননি।
এক সময়ের দাপুটে এই মন্ত্রী এখন রাজনীতিতে গুরুত্ব হারিয়ে নিজের অবস্থান ধরে রাখার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হলেও নিজ এলাকায় বাবরের জনপ্রিয়তা এখনও পুরোপুরি মুছে যায়নি বলে মনে করছেন নেত্রকোণার স্থানীয় পর্যবেক্ষকরা।
ইপেপার
Copyright © 2025 ThikanaTV.Press. All rights reserved.