
স্টাফ রিপোর্টার: আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে প্রস্তাবিত বাজেটকে অনেকটা গতানুগতিক বলে আখ্যায়িত করেছে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। এতে জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী প্রথম বাজেটে নতুন বাংলাদেশ পুনর্গঠনের প্রত্যয় আশানুরূপভাবে প্রতিফলিত হয়নি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। গতকাল সোমবার অর্থ উপদেষ্টার বাজেট বক্তৃতার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় এসব মন্তব্য করা হয়।
প্রস্তাবিত বাজেটের মৌলিক জায়গায় গলদ রয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, আগে যেভাবে বাজেট চলে আসছে, সেখান থেকে সংখ্যার তারতম্য হয়েছে, কিন্তু বাজেটের প্রিন্সিপাল একই রয়ে গেছে। এটাও গতানুগতিক বাজেট। বিগত সরকারের ধারাবাহিকতা থেকে অন্তর্বর্তী সরকার বের হতে পারেনি। রাজস্ব আয়ের ওপর ভিত্তি করে বাজেট করা উচিত। তাহলে প্রাইভেট সেক্টরে টাকার সরবরাহ থাকবে, বিনিয়োগ থাকবে, ইন্টারেস্ট কমে আসত, বিদেশি ঋণের পরিমাণ কমে আসত ও সুদের হারও কম পেমেন্ট করতে হতো। কিন্তু আমরা সেই জায়গা থেকে সরে আসতে পারিনি। আমি মনে করি, এই মৌলিক জায়গায় গলদ রয়ে গেছে।
গতকাল সোমবার হোটেল সারিনায় বাজেট নিয়ে তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির এই নেতা এসব কথা জানান। দলের পক্ষ থেকে ৪ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে বাজেট প্রতিক্রিয়া দেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।
আমীর খসরু বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা সীমিত। কারণ তাদের একটা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে তাদের ক্ষমতার থাকার মেয়াদের ব্যবধান রয়েছেÑ এটা মাথায় রাখতে হবে। প্রথমত. বিগত সরকার বাজেটের আকার বাড়াতে বাড়াতে যে জায়গায় নিয়ে গেছে, এর সঙ্গে রাজস্ব আয়ের কোনো সম্পর্ক নেই।
তিনি বলেন, দ্বিতীয়ত. রাজস্ব আয়ের পুরোটাই পরিচালনা ব্যয়ের মধ্যে ব্যয় হয়ে যাবে। উন্নয়ন বাজেট দেশের ভেতর বা বাইরে থেকে ঋণ নিয়ে চালাতে হচ্ছে। সরকার যখন দেশের বাইরের থেকে ঋণ নিলে এর বোঝা বাড়তে থাকে এবং বছরের পর বছর দেশের মানুষকে এই সুদ দিতে হয়। এই কারণেই কিন্তু দেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো ভুগতে থাকে। আর দেশের ভেতরের থেকে নিলে আবার বেশি ক্ষতি। কারণ দেশের ব্যাংক থেকে লোন নিলে ইন্টারেস্ট বেড়ে যায়। আবার ব্যক্তিখাতে লোনও কমে যায়। এর ফলে দেশে বিনিয়োগ হয় না, কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয় না, মানুষের আয় বৃদ্ধি পায় না। প্রাইভেট সেক্টর লোন না পেয়ে অনেকে বিনিয়োগও করতে পারে না। আমি মনে করি, রাজস্ব আয়ের সঙ্গে বাজেটের আকারের একটা সম্পৃক্ততা থাকা উচিত ছিল। কিন্তু এটা হয়নি। রাজস্ব আয় যেটা আছে তার পুরোটাই পরিচালনা ব্যয়ের মধ্যে চলে যাবে। দেশের বাইরে ও ভেতর থেকে লোন নিতে গেলে এসব প্রভাবের কারণে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে বলতে গেলে একটি বাক্যে বলতে হয়, এটি একটি অর্থহীন বাজেট।
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, আমরা প্রস্তাবিত বাজেট ভালো করে পড়ে কয়েকদিন পর পরিপূর্ণ প্রতিক্রিয়া দেব। তবে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হলোÑ আগের বাজেটের তুলনায় খুব বেশি উন্নতি হয়েছে বলে মনে হয়নি। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছুটা ব্যতিক্রম আছে। যেমন বাড়তি বেহুদা খরচের ব্যাপারে, অধিকতর ঘাটতি কিছু কম আছে। দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল থাকতে পারে, কিন্তু দ্রব্যমূল্য কমবে কি নাÑসেটা বাজেটে স্পষ্ট করা হয়নি।
গতকাল সন্ধ্যায় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠক শেষে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জামায়াতের এই নেতা এসব কথা বলেন।
পরে গণমাধ্যমে পাঠানো এক প্রতিক্রিয়ায় জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মা’ছুম বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী প্রথম বাজেটে নতুন বাংলাদেশ পুনর্গঠনের প্রত্যয় আশানুরূপভাবে প্রতিফলিত হয়নি। পূর্বের বাজেটসমূহের ন্যায় এটি একটি গতানুগতিক বাজেট। প্রস্তাবিত বাজেটের সঙ্গে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মূল বাজেটের মোটা দাগে খুব একটা তফাৎ পরিলক্ষিত হয়নি। এবার বাজেটে ব্যয় না বাড়লেও তেমন কোনো ব্যয় কমেনি, এতে কোনে নতুনত্বের ছোঁয়াও পরিলক্ষিত হয়নি।
তিনি আরো বলেন, এই বাজেটে বড় অঙ্কের ব্যয় মেটাতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে চার লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। গত অর্থবছরেও এর কাছাকাছি অর্জন করা সম্ভব হয়নি। যা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ বলে মনে আমরা মনে করছি।’
তিনি বলেন, বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে পাঁচ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। ঘাটতি বাজেট বাড়িয়ে দুই লাখ ৬৬ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, যার একটি বড় অংশ আসবে বৈদেশিক উৎস থেকে। বাজেটে বিদেশনির্ভরতা কমার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
তিনি আরো বলেন, বাজেটে বিভিন্ন ধরনের পরোক্ষ কর বৃদ্ধির মাধ্যমে রাজস্ব বৃদ্ধির উদ্যোগ দেখা গেলেও প্রত্যক্ষ কর বৃদ্ধির তেমন উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। পরোক্ষ কর বৃদ্ধির কারণে দেশের সাধারণ মানুষকে এর ভার বহন করতে হবে। রাজস্ব আয় বাড়ানোর জন্য ভ্যাট ও আমদানি শুল্কখাতে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে।
প্রস্তাবিত বাজেট গতানুগতিক এবং গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে না বলে উল্লেখ করেছে খেলাফত মজলিস। গতকাল এক যৌথ বিবৃতিতে দলটির আমির মাওলানা আব্দুল বাছিত আজাদ ও মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদের বলেন, ঋণনির্ভর এ বিশাল ঘাটতি বাজেটে জনগণের অর্থনৈতিক বৈষম্য তেমন কমছে না।
তারা বলেন, প্রায় সাত লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার প্রস্তাবিত এ বাজেটে দুই লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকার বিশাল অঙ্কের ঘাটতি রয়েছে, যা জিডিপির ৩.৬০ শতাংশ। এই ঘাটতি পূরণে দেশি-বিদেশী ঋণ ও সুদের বোঝা আরো বাড়াবে। এই সুদের পরিমাণ এক লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা। পরিচালন ব্যয় ও সুদ পরিশোধের মতো অনুন্নয়ন খাতেই ব্যয় হবে বাজেটের অধিকাংশ অর্থ। তবে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৫.৫০ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতির গড় হার ৬.৫০ শতাংশ রাখতে পারলে তা হবে বাজেটের বড় চমক।
বিবৃতিতে নেতৃদ্বয় আরো বলেন, বিগত ফ্যাসিবাদী সরকার দেশের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে রেখে গেছে। বাজেটে এ বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে টেনে তোলার আরো ব্যবস্থা থাকার দরকার ছিল। পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।’