
নিজস্ব প্রতিবেদক: শীর্ষ নেতৃত্বের দায়, বাংলাদেশ-ভারত যৌথ অভিযান: কমিশনের তদন্তে উঠে এসেছে যে জোরপূর্বক গুমের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে র্যাব, পুলিশের ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ (ডিবি), এবং সিটিটিসি (কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম) ইউনিটগুলো প্রধান ভূমিকা পালন করেছে।এছাড়াও ভারতের গোয়েন্দা র এর সাথে যুক্ত রয়েছে
এছাড়া এসব গুমের পিছনে ভারতের হাত রয়েছে. বাংলাদেশে গুমের ঘটনা শুধু অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়, বরং আন্তর্জাতিক চক্রান্তের অংশ-বিশেষ করে ভারতীয়দের জড়িত থাকার কথা কমিশনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থার সাথে গোপনে বিনিময় চুক্তির মাধ্যমে গুমের কাজ সম্পাদন করতো.
উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, পুরো অপারেশন তাদের সরাসরি তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়েছে। দেশের এবং আন্তর্জাতিক আইনে এক্ষেত্রে শাস্তির বিধান থাকলেও অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা দেশের বাইরে পালিয়ে গিয়ে জবাবদিহিতা এড়ানোর চেষ্টা করেছেন বলে কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
বৈশ্বিক ঘটনাপ্রবাহের দিকে তাকালে দেখা যায় রাজপথের রাজনৈতিক আন্দোলন স্তব্ধ করে দিতেই ঘটে থাকে বেশিরভাগ গুমের ঘটনা। সংবিধান রক্ষার অজুহাতে ২০১৪ সালে একপাক্ষিক নির্বাচনে জিতলেও স্বস্তি ছিল না দেড় দশক মসনদে বসে সদ্য ক্ষমতাচ্যুত হওয়া আওয়ামী লীগে। সেসময় বলা হয়েছিল দ্রুত আরেকটি নির্বাচনের কথা।’
তবে ওই দাবি ভুলে পরের দফা ক্ষমতা নিশ্চিতে ২০১৬-১৮ সালে ঘটানো হয় দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি গুমের ঘটনা। এমনকি নির্মাণ করা হয় গোপন বন্দিশালাও। গুম কমিশনের অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনের সুত্র ধরে একটি বন্দিশালার খোঁজ পেয়েছে যমুনা টেলিভিশন। তুলে নিয়ে নিখোঁজ করে দেয়ার ঘটনায় মিলেছে প্রতিবেশি দেশ ভারতের যোগসাজসের অভিযোগ।
এক দশক আগের ঘটনা। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় নির্বাচন ঘিরে ব্যাপক উত্তেজনা ছিল রাজপথে। ভোটের আগেই দেড়শ’র বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে ক্ষমতা নিশ্চিত করে আগেরবার নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী আওয়ামী লীগ। তীব্র ক্ষোভ থেকে কঠোর আন্দোলনে নামে বিরোধীরা। পরের বছরগুলোতে বেড়ে যায় আটকের পর নিখোঁজের ঘটনা। সেগুলোর সাক্ষ্য হিসেবে রয়েছে আর্কাইভস ভবনে তখনকার পত্রিকাগুলো। গুম কমিশনের অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত মোট গুমের অভিযোগ এক হাজার ৬৭৬টি। এরমধ্যে কমিশন পর্যালোচনা করে ৭৫৮টি।
বছরভিত্তিক গুমের পরিসংখ্যান:
বছর গুমের সংখ্যা ২০১৬- ১৩০ জন
২০১৭-৮৪. জন
২০১৮-৮৯. জন
২০১৬ সালের পরের দুই বছর অর্থাৎ ২০১৭ ও ২০১৮ সালে এতো গুমের ঘটনা কেন ঘটলো, এমন প্রশ্নের জবাবে বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০১৮ সালের শেষদিকে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় নির্বাচনে টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতা নিশ্চিত করতে টার্গেট করা হয় অনেককে। কমিশন মনে করে, রাজনৈতিক কারণেই ঘটেছে বেশির ভাগ গুমের ঘটনা। ক্ষমতা ধরে রাখতে বানানো হয় গোপন বন্দিশালা। মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ উমর ফারুক বলেন, যখন অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেশে হলো না, তখন কেউ কেউ লেখালেখি শুরু করে।
একইভাবে রাজনৈতিক সভা সমাবেশও ছোট-বড় পরিসরে হতে থাকে। রাজনৈতিক দলের কাছে যে ব্যক্তির কর্মকাণ্ডকে নিজেদের বিরুদ্ধে যাচ্ছে বলে মনে করা হলো, তাদেরকেই মূলত গুমের প্রাথমিক পরিকল্পনায় নিয়ে আসা হয়। এর বাইরে সিভিল সোসাইটির অনেক ব্যক্তিও এই গুমের শিকার হন তাদের অনলাইন-অফলাইন লেখালেখি ও বক্তব্যের কারণে- বলে মনে করেন তিনি। তার মতে, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের পরোক্ষ অংশগ্রহণ ছিলো গুমকাণ্ডে।’
এই কাজের পারফরম্যান্সের স্কেল অনু্যায়ী একটি সুবিধাও পেতেন তারা। সেইসাথে ভারতীয় অনেক নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরাও এই কাজে জড়িত বলে মনে করেন ড. মুহাম্মদ উমর ফারুক। শেখ হাসিনার আমলে তৈরি করা গুমের সাথে সম্পৃক্ত একাধিক বন্দিশালা গুড়িয়ে ফেলা হলেও এখনও কিছু অবশিষ্ট রয়েছে। বিভিন্ন সুত্র বলছে, এরকমই এক বন্দিশালায় যাওয়া-আসা ছিল বরখাস্ত মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানের। শেখ হাসিনার আমলে তৈরি করা একাধিক বন্দিশালার মধ্যকার একটি ভবনের একাংশ।
এদিকে, অপরাধ ও আইন বিশ্লেষক অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জনের মতে, এ ধরণের মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো কাজকে অনুমোদন দেয়া একেবারেই অনুচিত। তৎকালীন সময়ের রাজনৈতিক আবহও এর নেপথ্যের অন্যতম কারণ বলে দায়ী করেন তিনি। কমিশনের তদন্তে গুমের ঘটনায় প্রতিবেশী দেশ ভারতের সম্পৃক্ততার তথ্যও উঠে আসে। এমনই একটি ঘটনা ঘটে মানিকগঞ্জে।’
২০২৩ সালের ২৯ আগষ্ট জেলার বড় নালাই গ্রামের রহমত উল্লাহ নামের এক যুবককে তুলে নিয়ে যায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। তিনি নিখোঁজ ছিলেন ১৬ মাস। যখন বন্দিশালা থেকে বের হয়ে বাড়ি আসেন, তখন তিনি দেশেই ছিলেন না। তার অবস্থান ছিলো ভারতের একটি কারাগারে। যমুনা টেলিভিশনের সাথে কথা বলেছেন রহমত উল্লাহ। তিনি বলেন, যদি আমাকে তারা (যারা তাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলো) ফাঁসি দিয়ে দিত তাহলেও আমার আক্ষেপ থাকতো না। কিন্তু এভাবে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর অজানা একটি জায়গায় রাখা সেইসাথে ভারতে পাচার করে দেয়া এটি কতটুকু নৈতিক- এরকম প্রশ্নও রাখেন রহমত। রহতম আলী, যিনি ১৬ মাস নিঁখোজ থাকার পর ভারতের একটি কারাগার থেকে বাংলাদেশে ফেরেন। বোঝা গেলো মানসিকভাবে অনেকটাই ভেঙে পড়েছেন রহমত।
এখনও আছেন ট্রমায়, কখন আবার গুম হয়ে যান তিনি সেই অজানা এক ভয় এখনও তার অবচেতন মনে কাজ করে মাঝেমধ্যেই। ভুক্তভোগীর বোন রাজিয়া আক্তার অভিযোগের তির তোলেন প্রতিবেশী দেশ ভারতের ওপর। তার ধারণা বাংলাদেশের গুমকাণ্ডে ওতপ্রোতভাবে জড়িত দেশটির আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। একই ঘটনা ঘটেছে রহমত উল্লাহর মতো একাধিক ব্যক্তির। তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে আটক হলেও পরে সন্ধান মিলেছে আন্তর্জাতিক সীমানার বাইরে।
আওয়ামী শাসনামলে সরকারি সংস্থা কর্তৃক বলপূর্বক গুমের শিকার হয়েছে এমন সব পরিবারের প্ল্যাটফর্ম ‘মায়ের ডাক’-এর আহ্বায়ক সানজিদা ইসলাম জানান, গুমকাণ্ডে ফেরত আসা একাধিক ব্যক্তির অভিযোগে একটি বিষয়ের মিল লক্ষ্য করা যায়। গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের যখন মানসিক ও শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয় তারা অনেকেই খেয়াল করেছেন যারা নির্যাতন চালাচ্ছে তাদের বলা ভাষা বাংলা নয়, বরং সেটি প্রতিবেশী দেশের। গুমের শিকার নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনদের আহাজারি। কমিশনের শঙ্কা, এখনও যাদের খোঁজ মেলেনি, তাদের হয়তো আর ফিরে পাওয়া যাবে না। কিন্তু গুমের শিকার প্রিয়জনের ভাগ্যে কী ঘটেছে, তা জানতে উদগ্রীব হয়ে আছেন স্বজনরা। কারণ, সবশেষে তাদের আশায় বুক তো বাধতেই হবে।’