
ঠিকানা টিভি ডট প্রেস: অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সিদ্ধান্ত ছিল ভবিষ্যতের বাজেটে অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালো টাকা প্রদর্শিত (সাদা) করার আর কোনো সুযোগ থাকবে না।
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সিদ্ধান্ত ছিল ভবিষ্যতের বাজেটে অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালো টাকা প্রদর্শিত (সাদা) করার আর কোনো সুযোগ থাকবে না। অর্থ উপদেষ্টাসহ একাধিক উপদেষ্টা বিভিন্ন সময় তাদের বক্তব্যেও বিষয়টি জানিয়েছেন। তবে শেষ পর্যন্ত কালো টাকা সাদা করার বিধান রেখেই বাজেট প্রস্তাব চূড়ান্ত করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সংস্থাটির সে প্রস্তাব পাস হলে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটেও অপ্রদর্শিত অর্থ সাদা করার সুযোগ থাকছে।
আগের মতো অবশ্য ঢালাও ভাবে নয়; কেবল স্থাপনা, বাড়ি, ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট, ফ্লোর স্পেস ও জমি কেনার ক্ষেত্রে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন এনবিআর কর্মকর্তারা। এক্ষেত্রে বিদ্যমান করহার সর্বোচ্চ সাত গুণ পর্যন্ত বাড়ানো হতে পারে। এদিকে কালো টাকা সাদা করার ক্ষেত্রে করহার বাড়ানো হলেও জমি ও ফ্ল্যাট নিবন্ধনের কর কমানোর সুপারিশ করা হয়েছে। বাজারমূল্যে দলিল নিবন্ধন উৎসাহিত করতে এ সুপারিশ করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
বাজেটের নীতি তৈরির সঙ্গে যুক্ত এনবিআর কর্মকর্তাদের কেউই অবশ্য এ বিষয়ে মন্তব্য করতে চাননি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা জানিয়েছেন, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবের ভেটিং সম্পন্ন হয়েছে এরই মধ্যে। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ আগামী ২ জুন বাজেট ঘোষণা করবেন। উপদেষ্টার বাজেট বক্তব্যও চূড়ান্ত হয়েছে।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকেই দেশের জাতীয় বাজেটে কালো টাকা সাদা করার বিধান রাখা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত ২২ বারে এ সুযোগ দেয়া হয়েছে ৪০ বছর। তবে সুযোগ দেয়া সত্ত্বেও দেশে কালো টাকার পরিমাণের তুলনায় যৎসামান্য অংশই কর দিয়ে সাদা করা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ৪৭ হাজার কোটি টাকা সাদা করা হয় বলে এনবিআর সূত্রে জানা গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২০ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা সাদা করা হয় ২০২০-২১ অর্থবছরে। মোট ১১ হাজার ৮৫৯ ব্যক্তি এ সুযোগ নিয়েছেন। কভিড-১৯ সৃষ্ট বৈশ্বিক দুর্যোগের কারণে ওই অর্থবছরটিতে দেশ থেকে অর্থ পাচারের সুযোগ সীমিত হয়ে যায়। এর প্রভাবেই এত পরিমাণ কালো টাকা সাদা করা হয়েছে বলে এনবিআর কর্মকর্তারা মনে করেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কালো টাকা সাদা করার সুযোগটি পুরোপুরি অসাংবিধানিক ও অনৈতিক। এর মধ্য দিয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত অভিজাতদের অপ্রদর্শিত বা জ্ঞাত উপায়বহির্ভূত আয়কে বৈধতা দেয়ার সুযোগ তৈরি হয়। এ ধরনের নিয়ম দুর্নীতি বা অবৈধ পন্থায় আয়কারীদের উৎসাহ ও সুরক্ষা দেয়। আবাসন খাতে বর্গমিটারের ভিত্তিতে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পরিশোধের পর এর উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন তুলতে না পারলে তা সমাজে অস্বচ্ছতা ও অন্যায্যতাকে আরো বাড়িয়ে তুলবে।
দুদক সংস্কার কমিশনের প্রধান ও টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘স্থাপনা, ফ্ল্যাট, বাড়ি ইত্যাদি যে উদ্দেশ্যেই হোক, অপ্রদর্শিত অর্থ যদি বৈধ আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয়; তাহলে তা কালো টাকা হিসেবে বিবেচিত হবে। একে বৈধতা দেয়া কোনো যুক্তিতেই গ্রহণযোগ্য নয়। এরূপ অনুপার্যিত অবৈধ আয় সংবিধানের ২০(২) অনুচ্ছেদের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক, বৈষম্যমূলক ও দুর্নীতি-সহায়ক। একই সঙ্গে সরকার গঠিত দুদক সংস্কার কমিশনের সুনির্দিষ্ট সুপারিশেরও পরিপন্থী। অন্তর্বর্তী সরকার যদি এ সুযোগ রাখে তবে তা হবে হতাশাজনক এবং সরকারের নিজের জন্য বিব্রতকর। কোনো বিশেষ মহলের চাপে সরকার এ ধরনের ভুল বার্তা দিয়ে জনগণকে দুর্নীতিতে নিমজ্জিত থাকতে উৎসাহিত করবে, এটি অগ্রহণযোগ্য।’
ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার সরকার সর্বশেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটেও ঢালাওভাবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। এরপর উপদেষ্টা পরিষদের সিদ্ধান্তের আলোকে ২ সেপ্টেম্বর এনবিআর থেকে জারীকৃত এক প্রজ্ঞাপনে সিকিউরিটিজ, নগদ, ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ, আর্থিক স্কিম ও ইনস্ট্রুমেন্ট সব ধরনের ডিপোজিট বা সেভিং ডিপোজিটের ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার যে সুযোগ ছিল তা বাতিল করা হয়। তবে স্থাপনা, বাড়ি, ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট, ফ্লোর স্পেস ও জমি কেনার ক্ষেত্রে এ সুযোগ ঠিকই বহাল থাকে।
বর্তমানে আবাসন খাতে কালো টাকা সাদা করতে এলাকাভিত্তিক জমিতে বর্গমিটারে সবচেয়ে বেশি অর্থ পরিশোধ করতে হয় রাজধানীর অভিজাত এলাকাগুলোয়। এনবিআরের এ-সংক্রান্ত আয়কর পরিপত্রের তথ্য অনুযায়ী, এজন্য ঢাকার গুলশান থানা, বনানী, মতিঝিল, তেজগাঁও, ধানমন্ডি, ওয়ারী, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, শাহবাগ, রমনা, পল্টন, কাফরুল, নিউমার্কেট ও কলাবাগান থানার অন্তর্গত সব মৌজায় স্থাপনা, বাড়ি, ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট অথবা ফ্লোর স্পেসে প্রতি বর্গমিটারে ৬ হাজার টাকা এবং এসব এলাকায় জমির ক্ষেত্রে প্রতি বর্গমিটারে ১৫ হাজার টাকা কর দিতে হয়। আগামী বাজেটে এসব করহার সর্বোচ্চ সাত গুণ পর্যন্ত বাড়তে পারে।
সরকারের উপদেষ্টাদের পক্ষ থেকে কালো টাকা সাদা করার কোনো সুযোগ না রাখার ঘোষণা এলেও এ বিষয়ে কিছুটা নমনীয় ছিলেন এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান। গত ২২ মার্চ এক কর্মশালায় তিনি বলেন, ‘আবাসনের ব্যবসায়ীরা বিশেষ করে রিহ্যাব সবসময় বলে এ সুযোগ রাখার। না রাখলে তাদের ফ্ল্যাট, প্লট বিক্রি ও এ খাতে বিনিয়োগ কমে যাবে। আমরা চেষ্টা করব বাতিল করতে। যদি এটি পুরোপুরি বাতিল করতে ব্যর্থ হই, তাহলে অন্তত ট্যাক্সের হার বৃদ্ধি করে আদর্শ করহারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার চেষ্টা করব।’
রাজধানীর গুলশান ও বনানীর মতো অভিজাত এলাকাগুলোয় জমি ও অ্যাপার্টমেন্টের দাম এখন সবচেয়ে বেশি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসব এলাকায় অ্যাপার্টমেন্টের পেছনে ব্যয় লন্ডন-দুবাই-নিউইয়র্কের সবচেয়ে অভিজাত এলাকাগুলোর বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টের মূল্যকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। অ্যাপার্টমেন্টের দাম ২০-৩০ কোটি টাকায়ও উঠছে। নিবন্ধনের সময় যদিও এর মূল্য দেখানো হচ্ছে ১-২ কোটি টাকা। এসব অ্যাপার্টমেন্ট বা ফ্ল্যাটের ক্রেতাদের বড় একটি অংশ সরকারি কর্মকর্তা। অথচ দেশের বিদ্যমান বেতন কাঠামো অনুযায়ী কোনো সরকারি কর্মকর্তারই এসব এলাকায় ফ্ল্যাট কিনতে পারার সামর্থ্য থাকার কথা নয়।
এনবিআরের পরিপত্র অনুযায়ী, বর্তমানে ঢাকার বংশাল থানা, মোহাম্মদপুর, সূত্রাপুর, যাত্রাবাড়ী, উত্তরা মডেল, ক্যান্টনমেন্ট, চকবাজার, কোতোয়ালি, লালবাগ, খিলগাঁও, শ্যামপুর, শাজাহানপুর, মিরপুর মডেল, দারুস সালাম, দক্ষিণখান, উত্তরখান, তুরাগ, শাহ আলী, সবুজবাগ, কদমতলী, কামরাঙ্গীরচর, হাজারীবাগ, ডেমরা, আদাবর, গেন্ডারিয়া, খিলক্ষেত, বিমানবন্দর, উত্তরা পশ্চিম, মুগদা, রূপনগর, ভাসানটেক, বাড্ডা, পল্লবী, ভাটারা; চট্টগ্রামের খুলশী থানা, পাঁচলাইশ, পাহাড়তলী, হালিশহর, কোতোয়ালি; নারায়ণগঞ্জের সদর, সোনারগাঁ, ফতুল্লা, সিদ্ধিরগঞ্জ, বন্দর এবং গাজীপুরের সদর থানার অন্তর্গত সব মৌজায় স্থাপনা, বাড়ি, ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট অথবা ফ্লোর স্পেসে প্রতি বর্গমিটারে ৩ হাজার ৫০০ টাকা কর পরিশোধ করতে হয়। আর জমির ক্ষেত্রে প্রতি বর্গমিটারে ১০ হাজার টাকা কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রয়েছে। আগামী অর্থবছরের বাজেটে এসব এলাকায় স্থাবর সম্পত্তি কেনার ক্ষেত্রেও করহার বাড়ানোর প্রস্তাব রাখা হয়েছে।,
কালো টাকা সাদা করার যেকোনো ধরনের সুযোগই সামাজিক বৈষম্য বলে মনে করেন এনবিআরের সাবেক সদস্য (শুল্ক ও মূসক) মো. ফরিদ উদ্দিন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘কালো টাকা সাদা করার সব ধরনের সুযোগই বাতিল করা উচিত। এটা অন্যায্যতা, বৈষম্য। সামাজিক ন্যায্যতার প্রতি বড় হুমকি। অন্তর্বর্তী সরকার যদি এটি বহাল রাখে, তাহলে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মূল দাবির প্রতি অন্যায় করা হবে। কেননা এটা তাদের আন্দোলনের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ। তবে বিদেশে পাচার হওয়ার চেয়ে দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট উত্তরণে এ সুযোগ উত্তম। কিন্তু আদর্শ ও নীতির প্রশ্নে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বহাল রাখা অনুচিত।’
কালো টাকা সাদা করার বিধান সম্পর্কে চলতি বাজেট প্রস্তাবের সময় বলা হয়, দেশের প্রচলিত আইনে যা-ই থাকুক না কেন, এক্ষেত্রে কোনো কর্তৃপক্ষ কোনো ধরনের প্রশ্ন তুলতে পারবে না। অর্থাৎ সে অনুযায়ী বিনাপ্রশ্নে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ মিলছে।
সব ধরনের অপ্রদর্শিত পরিসম্পদ প্রদর্শনই বাতিল করা উচিত বলে মনে করেন দুদকের সাবেক মহাপরিচালক (লিগ্যাল অ্যান্ড প্রসিকিউশন) মঈদুল ইসলাম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘এ সুযোগের মাধ্যমে দুর্নীতিকে উৎসাহিত করা হয়। আর আয়ের উৎস ও বৈধতা নিয়ে কেন প্রশ্ন করা যাবে না? জমি বিক্রি করেন গরিবরা। কেনেন ধনীরা। তারা কর ফাঁকি দিয়ে অপরাধ করেন। আবার অবৈধ টাকা বৈধ করতে গিয়ে ছাড় পান! এটা তো সংবিধান পরিপন্থী। সংবিধানের ২০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, অনুপার্জিত আয় ভোগ করা যাবে না।’
এদিকে আগামী বাজাটে প্লাস্টিকের তৈরি টেবিলওয়্যার ও কিচেনওয়্যারে ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসানো হচ্ছে। সিগারেট পেপারেও ভ্যাট বাড়ছে। বাণিজ্যিকভাবে আমদানি (যারা সিগারেট তৈরি করেন না) করা সিগারেট তৈরির পেপারে এখন সম্পূরক শুল্ক (এসডি) দিতে হয় ১৫০ শতাংশ, আগামী বাজেটে এটি ৩০০ শতাংশ করা হচ্ছে। আর ইন্ডাস্ট্রিয়াল (যারা নিজেরা সিগারেট তৈরি করেন) আমদানিতে ১০০ শতাংশই বহাল থাকছে বলে এনবিআর সূত্রে জানা গেছে।
বাণিজ্যিকভাবে আমদানি করা সিগারেট পেপারে ভ্যাট বাড়ানোন বিষয়ে জানতে চাইলে এনবিআরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘যারা ইন্ডাস্ট্রিয়াল আমদানি করেন, তারা সিগারেট উৎপাদন করেন, সেটির হিসাব আমরা পাই। কিন্তু বাণিজ্যিক উদ্দেশে আনা সিগারেট পেপার তারা কার কাছে বিক্রি করেন, কোথায় বিক্রি করেন, সে হিসাব পাওয়া যায় না। সেজন্য বাণিজ্যিক আমদানি নিরুৎসাহিত করতে শুল্ক বাড়ানো হচ্ছে।’