
নিজস্ব প্রতিবেদক: ফেনীতে টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর ২১টি স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। এতে পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়া উপজেলার ১০৬টি গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে। লাখো মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার (১০ জুলাই) বিকাল পর্যন্ত পরশুরামে ২৭টি, ফুলগাজীতে ৬৭টি ও ছাগলনাইয়ায় ১২টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। প্রায় ৯ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন ৭০টি আশ্রয়কেন্দ্রে।
ভয়াবহ এ দুর্যোগে কারেন্ট জালে জড়িয়ে একজন বৃদ্ধের মৃত্যু এবং সাপের কামড়ে একজন আহত হয়েছেন।
আশ্রয়কেন্দ্রেও পানি, উদ্ধারকাজে নৌকার সংকট
ফুলগাজী ইউএনও ফাহরিয়া ইসলাম বলেন, “উদ্ধারে নৌকার তীব্র সংকট রয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত থাকলেও পানিবন্দি মানুষকে আনা যাচ্ছে না। পুরো উপজেলার সব ইউনিয়নে পানি ঢুকে পড়েছে, অনেক আশ্রয়কেন্দ্রও প্লাবিত।”
ছাগলনাইয়া ইউএনও সুবল চাকমা জানান, “২০টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন ও স্বেচ্ছাসেবকরা কাজ করছেন।”
বাঁধ মেরামতে গাফিলতির অভিযোগ
স্থানীয়রা জানান, ভাঙনকবলিত এলাকাগুলোর বেড়িবাঁধ আগে থেকেই দুর্বল ছিল। নোয়াপুর গ্রামের আসিয়া বেগম বলেন, “রাত ১২টার দিকে হঠাৎ বাঁধ ভেঙে আমাদের ঘরে কোমর সমান পানি উঠে যায়।”
মানিক চন্দ্র পাল নামে এক খামার মালিক বলেন, “সব শেষ হয়ে গেছে। বেড়িবাঁধ না ভাঙলে এ অবস্থা হতো না।”
পরশুরামের মিন্টু হাওলাদার বলেন, “মাসখানেক আগেই বন্যা হয়েছিল, তখন নামমাত্র মেরামত হয়। ফলে এবার আবার সব বাঁধ ভেঙে গেল।”
সোনাগাজীতেও নদীভাঙনে ভয়াবহ অবস্থা
সোনাগাজীর নদীতীরবর্তী তিন ইউনিয়নে ফের ভাঙন দেখা দিয়েছে। পানির তোড়ে ধসে পড়েছে তিনটি সড়ক। মসজিদ ও বসতবাড়ি হুমকিতে।
স্থানীয়রা জানান, ফেনী নদী থেকে দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ফলেই এই ভাঙন তীব্র হয়েছে।
জরুরি সহায়তায় সেনাবাহিনী ও বিজিবি
পরশুরাম ও ফুলগাজীতে উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রমে সেনাবাহিনী মোতায়েন রয়েছে। দেওয়া হয়েছে বোট, লাইফ জ্যাকেট ও ওবিএম ইঞ্জিন। জরুরি চিকিৎসা নিশ্চিত করতে সেনাবাহিনীর মেডিকেল টিমও কাজ করছে।
বিজিবি রান্না করা খাবার বিতরণ করছে পানিবন্দি মানুষের মাঝে।
কলাগাছের ভেলায় হাসপাতালে
ফুলগাজীর অন্তঃসত্ত্বা নারী কামরুন নাহারকে কলাগাছের ভেলায় করে হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়া হয়। সেখানে তিনি কন্যাসন্তানের জন্ম দেন।
কারেন্ট জালে জড়িয়ে মৃত্যু
ফুলগাজীর বন্দুয়া দৌলতপুরে পানিতে কারেন্ট জালে জড়িয়ে মারা যান নুরুল আলম (৬৫)। তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা সাদেক কমান্ডারের ছেলে।
পুরো বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ
পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, ফেনীর ১২২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের প্রায় পুরোটা ঝুঁকিপূর্ণ। ২০০৯-২০২৪ সাল পর্যন্ত একটি প্রকল্পে কিছু সংস্কার করা হয়েছিল, এরপর আর কাজ হয়নি।
আবহাওয়া পরিস্থিতি ও সতর্কতা
জেলা আবহাওয়া কর্মকর্তা জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় ১৪১ মিমি বৃষ্টিপাত হয়েছে। আগামী শনিবার পর্যন্ত মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস রয়েছে।
প্রশাসনের আশ্বাস
জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম বলেন, “ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। যেসব এলাকায় এখনও পৌঁছানো সম্ভব হয়নি, সেখানে দ্রুত সহায়তা পৌঁছানো হবে।”
বিশেষ বৈঠক ও স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ
বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে মুসাপুর রেগুলেটর ও ফেনীতে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প চূড়ান্ত করার কথা জানানো হয়। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ ও অবকাঠামো পুনর্নির্মাণে কাজ চলমান রয়েছে।