নিজস্ব প্রতিবেদক: খাগড়াছড়িতে তীব্র পানির সংকট শুরু হয়েছে। নদীসহ ছোট-বড় খাল ও ঝরনা শুকিয়ে যাওয়ায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। জেলার সদর উপজেলার ৪ নম্বর পেরাছড়া ইউনিয়নের কাপতলা পাড়া, ভাঙ্গামুড়াসহ ছয়টি গ্রামের প্রায় ৭০০ পরিবার এ সংকটে পড়েছে। এ পাড়ার একমাত্র পানির উৎস হলো দুটি ছড়া ও ছোট ছোট তিনটি কুয়া। তীব্র খরার কারণে কুয়ার পানি শুকিয়ে গেছে। বাধ্য হয়ে তারা এখন নালার নোংরা পানি ব্যবহার করছেন।
কাপতলা পাড়ার আশপাশের গ্রামের লোকজনেরও একই অবস্থা। গত ডিসেম্বরের শুরু থেকেই দেখা দিয়েছে পানির সংকট। ওই এলাকার খাওয়ার পানির ভরসা ছড়ার পাড়ে কুয়া। বর্ষায় সময় বৃষ্টির পানিতে কিছুটা সংকট কেটে গেলেও শুষ্ক মৌসুমে আবার শুরু হয় পানির ভোগান্তি।
এ ছাড়া খাগড়াছড়ির বিভিন্ন এলাকায় এখন তীব্র পানির সংকট দেখা দিয়েছে। জেলার চেঙ্গী নদীসহ ছোট-বড় খাল ও পাহাড়ি ঝরনা শুকিয়ে যাওয়ায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
এসব এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, কেবল খরা নয়, নির্বিচার গাছ কাটা, প্রাকৃতিক বন উজাড় করে অতিরিক্ত সেগুনগাছ লাগানোর কারণে পানি পাওয়া যাচ্ছে না।
শচী রানী ত্রিপুরা জানান, তাদের ভোর ৪টায় ঘুম থেকে উঠে পাহাড় ডিঙিয়ে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে গিয়ে পানি আনতে হয়। বহু বছর ধরেই ডিসেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত এটি তাদের প্রতিদিনের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাঝেমধ্যে ভাবেন একদিন পানির কষ্ট দূর হবে, সুপেয় পানির ব্যবস্থা হবে, তবে সে আশাও এখন ছেড়ে দিয়েছেন। বর্ষাকাল ছাড়া পাড়ার বহু লোকজন কুয়া থেকে পানি ব্যবহার বুঝেশুনে করেন। শুধু বৃষ্টির মৌসুমে পর্যাপ্ত পানি তাদের জন্য আশীর্বাদ। তবে সেটিও বাড়ির পাশের ঝিরি আর কুয়া থেকেই সংগ্রহ করতে হয়। সেটি মোটেও সুপেয় পানি নয়।
জগমালা ত্রিপুরা বলেন, আমাদের সংসারে দৈনিক প্রয়োজন হয় অনেক বেশি। যখন যার সময় হয়, তখন তিনি দৈনন্দিন ব্যবহারের পানি নিয়ে আসেন। অনেক দূর থেকে পানি সংগ্রহ করতে হয়। কমপক্ষে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা সময় লাগে একবার পানি আনতে। আবার কুয়ার কাছে গিয়ে অপেক্ষা করে থাকতে হয়। কুয়ার পানিও প্রায় শুকিয়ে যাচ্ছে। বাধ্য হয়ে ছড়া থেকে পানি সংগ্রহ করতে হয়।
ভাগ্য লক্ষ্মী ত্রিপুরারও একই অবস্থা। প্রতিদিন তাদেরও ভোরে ছুটতে হয় পানির জন্য। তাদের যেতে হয় দুটি পাহাড় ডিঙিয়ে দেড় কিলোমিটার দূরে। ভোরে না গেলে পানির জন্য অপেক্ষা করতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তখন পানি নিয়ে আসতে আসতে রোদ উঠে যায়। রোদ উঠে গেলে কষ্ট বেড়ে যায় দ্বিগুণ।
খাগড়াছড়ি সদর থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে কাপতলা পাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ছোট কুয়া বাঁধ দিয়ে পানি ধরে রেখেছেন এলাকাবাসী। কিন্তু সেটাও এখন শুকিয়ে গেছে।
এলাকবাসীরা যে কূয়া থেকে পানি সংগ্রহ করত, সেটাও ধীরগতিতে পানি ওঠে। অনেকে তিন থেকে চার কিলোমিটার দূরে গিয়ে আনতে না পেরে দাঁড়িয়ে পানির জন্য অপেক্ষার করছে কয়েকজন নারী ও শিশু।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, আমাদের কুয়া ছাড়া পাড়ায় কোনো সুপেয় পানির ব্যবস্থা নেই। ছোট পাথরের একটি কুয়া থেকে গ্রামের সবার পানি ব্যবহার করতে হয়। ডিসেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত বৃষ্টি না থাকায় এবং তীব্র তো কুয়ায় পানি ওঠে না। তাই বাধ্য হয়েই অনেক দূর থেকে পানি সংগ্রহ করতে হয়।
সমাজকর্মী বিনোদন ত্রিপুরা বলেন, তাদের এখানে ডিসেম্বরের পরপরই বর্ষা মৌসুম শেষ হলে এলাকাবাসী চরম পানির সংকটে পড়ে। জুন পর্যন্ত তাদের এখানে তীব্র পানির সংকট দেখা দেয়। তারা বহু দূরে গিয়ে ছড়ার পানি সংগ্রহ করতে হয়। এতে তাদের জীবনের কঠিন সময় পার করতে হয়। পানির এই সমস্যা সমাধানে জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের দৃষ্টি কামনা করছি।
এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষায় একুশে পদকপ্রাপ্ত মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা বলেন, এই এলাকায় সবচেয়ে বেশি সমস্যা পানির। কারণ এখানে পানির যে উৎসগুলো রয়েছে, সেগুলো এখন নেই। একেকবার পানির জন্য তাদের অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। এ কারণে সরকারের পক্ষ থেকে কী কী উপায়ে পানি দেওয়া সুযোগ রয়েছে, সেটা দেখার ব্যাপার আছে। পার্বত্য জেলা পরিষদ বা অন্য যেসব কর্তৃপক্ষ রয়েছে, তারা যদি এগিয়ে আসে, তাহলে আমাদের এই এলাকাবাসীর পানি কষ্ট দূর হবে।'
জেলা প্রশাসক এ বি এম ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকার বলেন, পাহাড়ের অন্যতম একটি বড় সমস্যা হচ্ছে সুপেয় পানির অভাব। পাহাড়ের মূল পানির উৎস হচ্ছে ছড়া ও কুয়ার পানি। এখানে ভূগর্ভস্থ পানি পাওয়া যায় না। এটি নিয়ে আমরা কাজ করছি। উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা যারা আছে, আমরা তাদের সঙ্গে কথা বলেছি কীভাবে এটি দূর করা যায়। যেসব অঞ্চলে সুপেয় পানির অভাব রয়েছে, সেসব এলাকায় সৌর বিদ্যুতের মাধ্যমে পাম্প স্থাপন করতে পারি। তবে সব জায়গায় পাম্প স্থাপন করা ঠিক হবে না। এই সিজনে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে, সে জন্য প্রাকৃতিক আধারকে ব্যবহার করতে পারি। এ জন্য বেশ কিছু পরিকল্পনা রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ছড়ার পানিকে সংরক্ষণ করে বৃষ্টির পানি আধারকে পাইপলাইনের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করতে পারি। সে বিষয়ে প্রস্তাব দেওয়া আছে উচ্চ পর্যায়ে। দিকনির্দেশনা পেলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেব। আমরা উপজেলা নির্বাহী অফিসারদেরও বলেছি ছোট প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে যাতে পানির সংকট দূর করতে পারি।'
ইপেপার
Copyright © 2025 ThikanaTV.Press. All rights reserved.