
অনলাইন ডেস্ক: মধ্যপ্রাচ্যে ইরান-ইসরায়েল সংঘাত ক্রমশই ঘনীভূত হচ্ছে। সাম্প্রতিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইরান যে কৌশল দেখিয়েছে, তাতে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে—কঠোর নিষেধাজ্ঞার পরেও দেশটি কীভাবে এমন সামরিক শক্তি অর্জন করল?
ঐতিহাসিক ভিত্তি ও রূপান্তরের গল্প
ইরানের সামরিক শক্তির গোড়াপত্তন ঘটে ১৯২০-এর দশকে রেজা শাহ পাহলভির হাতে। পশ্চিমা শক্তির সহায়তায় তিনি আধুনিক বাহিনী গড়ে তোলেন। পরে তার ছেলে মোহাম্মদ রেজা পাহলভির শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো থেকে বিপুল অস্ত্র কেনা হয়।
১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর সেই পশ্চিমা সহায়তা বন্ধ হয়ে গেলে ইরান সামরিকভাবে একঘরে হয়ে পড়ে। তবে আমেরিকান অস্ত্রের মজুদ ও বিকল্প কৌশলে যুদ্ধ সক্ষমতা ধরে রাখে তারা।
যুদ্ধ, গবেষণা ও নিষেধাজ্ঞার শিক্ষা
ইরান-ইরাক যুদ্ধ (১৯৮০-৮৮) ইরানকে আত্মনির্ভরশীল সামরিক কৌশলে ঠেলে দেয়। অস্ত্র মেরামত, যন্ত্রাংশ পুনঃব্যবহার, রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিং এবং উত্তর কোরিয়া, চীন, রাশিয়ার সহযোগিতায় এক সময় তারা নিজস্ব প্রযুক্তি বিকাশে সক্ষম হয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মার্কিন ‘ইরান-কন্ট্রা স্ক্যান্ডাল’ থেকে শুরু করে অবৈধ পথে যন্ত্রাংশ সংগ্রহ, এমনকি গোপনে আমেরিকান ও ইসরায়েলি অস্ত্র পাওয়া পর্যন্ত—ইরানের কৌশল ছিল বিচিত্র এবং বাস্তবতাসম্পন্ন।
ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন প্রযুক্তিতে বিশাল অগ্রগতি
বর্তমানে ইরান একাধিক ব্যালিস্টিক ও হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরিতে সক্ষম। ‘শাহাব-৩’, ‘সেজিল’, ‘খেইবার’সহ বহু মিসাইল ২০০০ কিমি দূরত্বে আঘাত হানতে সক্ষম। সাম্প্রতিক হামলায় ইরান দাবি করেছে, তাদের হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র মাত্র ১০ মিনিটে ইসরায়েল পৌঁছেছে।
ড্রোন প্রযুক্তিতে ইরান এতটাই উন্নত হয়েছে যে, ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াকেও ড্রোন দিয়েছে।
প্রতিরক্ষা বহর ও সামরিক বাজেট
গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার ২০২৪-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, সামরিক শক্তিতে ১৪৫টি দেশের মধ্যে ইরানের অবস্থান ১৪তম, যা ইসরায়েলের (১৭তম) চেয়েও এগিয়ে।
ইরানের রয়েছে-
৫৫১টি সামরিক বিমান
১২৯টি হেলিকপ্টার
৬৫ হাজারের বেশি সাঁজোয়া যান
১,৯৯৬টি ট্যাংক
১০১টি যুদ্ধজাহাজ
১৯টি সাবমেরিন
২০২৩ সালে দেশটি সামরিক খাতে ব্যয় করেছে প্রায় ১০ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার।
অর্থের উৎস ও রপ্তানিযোগ্যতা
তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ ইরান জ্বালানি বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করে। হরমুজ প্রণালী নিয়ন্ত্রণে থাকায় বিশ্ব জ্বালানির ২১% এই পথ দিয়েই যায়।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও হুন্ডি, বার্টার, ক্রিপ্টোকারেন্সি, আঞ্চলিক বাণিজ্য—সব কিছু মিলিয়ে ইরান বৈশ্বিক অর্থনীতিতে প্রভাব রেখে যাচ্ছে।
নেতৃত্ব, নেটওয়ার্ক ও আঞ্চলিক প্রভাব
আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির নেতৃত্বে ইরান দীর্ঘ মেয়াদে সামরিক নীতিতে স্থির থেকেছে। লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের হুতি, ইরাক-সিরিয়ায় মিত্র গোষ্ঠী—সব মিলিয়ে একটি প্রক্সি বলয় তৈরি করেছে তারা।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নিষেধাজ্ঞাই ইরানকে ‘স্বনির্ভর সামরিক গবেষণা ও নির্মাণশক্তির’ দিকে ঠেলে দিয়েছে।
শেষ কথা:
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, প্রযুক্তি চর্চা, বিপ্লব-পরবর্তী কৌশলগত সিদ্ধান্ত এবং বিকল্প অর্থনৈতিক কূটনীতি—সব মিলিয়ে ইরান নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও মধ্যপ্রাচ্যের এক শক্তিশালী সামরিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। বড় যুদ্ধে জড়ালে এই সক্ষমতাই ইরানের প্রতিরক্ষা ও প্রভাব বজায় রাখার বড় হাতিয়ার হয়ে উঠবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।