জহুরুল ইসলাম, স্টাফ রিপোর্টার: টাঙ্গাইলে এলজিইডির দুটি রাস্তার কাজ সম্পন্ন না করে ৫৩ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন মামলা দায়ের হতেই রাস্তা দুটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। দুদকের চাপে ও এলজিইডির নির্বাহী প্রৌকশলীর দপ্তরের হুমকির মুখে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করে।
জানাগেছে, ২০১৯ সালের আগস্টে নাগরপুর উপজেলার দপ্তিয়র ইউনিয়ন পরিষদ থেকে তেবাড়িয়া রাস্তায় দপ্তিয়র বাজার থেকে কদিম কোকনা পর্যন্ত ১৬০০ মিটার পিচ ঢালাই ও তিনটি বক্স কালভার্ট নির্মাণের জন্য মেসার্স ফেন্ডস কনস্ট্রাকশন নামক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দুই কোটি ২০ লাখ টাকায় কাজের চুক্তি করে।
অন্যদিকে, একই উপজেলার গয়হাটা থেকে ভাড়রা রাস্তায় সিংজোড়া থেকে নোটারভাঙা পর্যন্ত পিচ ঢালাই কাজের জন্য ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে চার কোটি ৪০ লাখ টাকায় মেসার্স সৈয়দ মজিবর রহমান অ্যান্ড অবনী এটারপ্রাইজের (জেভি) চুক্তি হয়। এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলীর দপ্তরে একাধিকবার তাগিদ দিলেও অবস্থার কোনা পরিবর্তন হয়নি। ফলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সীমাহীন কালক্ষেপণে স্থানীয় জনসাধারণ ব্যাপক ভাগান্তির শিকার হয়। সর্বশেষ টাঙ্গাইল এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ কামরুজ্জামান চলতি বছরের ৬ মার্চ ৪৬.০২.৯৩০০.০০০.১৪.৩৩২.২০-১৩২৬ নম্বর স্মারকে মেসার্স ফেন্ডস কনস্ট্রাকশনকে এবং ১২ মার্চ ৪৬.০২.৯৩০০.০০০.১৪.৩৩২.২০-১৩৯৯ নম্বর স্মারকে মেসার্স মজিবর রহমান অ্যান্ড অবনী এটারপ্রাইজকে (জেভি) চূড়ান্ত নোটিশ দেন।
এদিকে, অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের টাঙ্গাইল জেলা কার্যালয়ে প্রাথমিক তদন্ত শেষে ২৭ এপ্রিল (রবিবার) উপ-সহকারী পরিচালক বাসেদ আলী বাদী হয়ে দুটি মামলা দায়ের করেন। দুদকের মামলায় টাঙ্গাইল এলজিইডির সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী এবং বর্তমান প্রধান কার্যালয়ের মনিটরিং ও মূল্যায়ন শাখার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম, নাগরপুরের সাবেক উপজেলা প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান, উপ-সহকারী প্রকৌশলী শহিদুল ইসলাম, সাবেক উপ-সহকারী প্রকৌশলী মোহাম্মদ মাইনুল হক, মেসার্স ফ্রেন্ডস কনস্ট্রাকশনের স্বত্বাধিকারী শহীদুর রহমান খান এবং মেসার্স সৈয়দ মজিবর রহমানের স্বত্বাধিকারী সৈয়দ মজিবর রহমানকে অভিযুক্ত করা হয়।
সরজমিন দেখা যায়, দপ্তিয়র ইউনিয়ন পরিষদ থেকে তৌবাড়িয়া রাস্তায় দপ্তিয়র বাজার থেকে কদিম কোকনা পর্যন্ত ১৬০০ মিটার পিচ ঢালাই ও তিনটি বক্স কালভার্ট নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। কদিম কোকনা গ্রামের এসএসসি পরীক্ষার্থী মো. ফিরোজ শেখ, ১০ম শ্রেণির শিক্ষার্থী মো. আশিক হোসেন, একই ক্লাসের মো. কলিম উদ্দিন, কৃষিজীবী হায়দার শেখ, গহবধূ মোছা. পারভীন আক্তার, আম্বিয়া খাতুন, স্থানীয় ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা চালক দিনু শেখ, বাচ্চু শেখ, কফিল শেখ, নুরুল ইসলাম সহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ জানায়, দীর্ঘদিন তারা চরম ভাগান্তির শিকার হয়েছে। ঠিকাদার কাজ শুরু করে বার বার বন্ধ রেখেছে- এতে দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। রাস্তাটি প্রায় এক মাস আগে সমাপ্ত হওয়ায় তারা সহ এলাকাবাসী খুবই খুশি। এখন তারা পাকা সড়কে যাতায়াতের সুফল ভোগ করছে।
অন্যদিকে, একই গয়হাটা থেকে ভাড়রা রাস্তায় সিংজোড়া থেকে নাটারভাঙা পর্যন্ত রাস্তাটি গত ৬ মে সমাপ্ত করা হয়েছে। সিংজোড়া-নাটারভাঙা গ্রামের কৃষিজীবী মো. সাদিকুর রহমান, বাবলু মিয়া, স্কুল ছাত্র নইম উদ্দিন, আবুল শেখ, নাজমুল ইসলাম, মো. সাইফুল ইসলাম, গৃহবধূ আঞ্জুমান আরা, সাহেরা বানু, রোজিনা আক্তার, ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা চালক বাবলু মিয়া, কাশেম শেখ, হযরত আলী শেখ, আবুল খায়ের, ব্যবসায়ী রকিব হোসেন, ডা. ওসমান গনি সহ অনেকেই জানান, রাস্তাটির জন্য তারা মারাত্মক দুর্ভোগের শিকার হয়েছেন। ঠিকাদার কাজ শুরু করে হাওয়া হয়ে গিয়েছিলেন, তার সহযোগীরা একবার কাজ ধরেছেন আবার বন্ধ করে রেখেছেন। সর্বশেষ গত ৬ মে (মঙ্গলবার) কাজ সমাপ্ত করা হয়েছে। এখন তারা সিংজোড়া বাজার থেকে নাটারভাঙা পর্যন্ত পাকা সড়কে যাতায়াতের সুবিধা পাচ্ছেন। কিন্তু পাশেই একটি ডোবায় কাঠের সাঁকো দিয়ে বছরের পর বছর চলাচল করতে হচ্ছে। ওই স্থানে একটি সেতু বা মাটি ভরাট করে রাস্তা নির্মাণ করলে সহবতপুর ও নাগরপুর সদরের সঙ্গে যাতায়াত সহজতর হবে।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স ফ্রেন্ডস কনস্ট্রাকশনের স্বত্বাধিকারী শহীদুর রহমান খান জানান, তিনি হার্টের রোগী। চিকিৎসার জন্য ইনডিয়ায় গিয়ে টাকার অভাবে পুরা চিকিৎসা না করে ফিরে আসেন। পরে উপজেলা প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমানের কাছে অনুনয়-বিনয় করে কাজের পুরা টাকা উত্তোলন করে চিকিৎসার জন্য ইনডিয়ায় যান। এজন্য কাজটি যথাসময় শেষ করতে পারেন নাই। এখন মোটামুটি সুস্থ্য এবং নির্বাহী প্রকৌশলীর চিঠি ও দুদক মামলা হওয়ায় দ্রুত কাজটি সমাপ্ত করেছেন।
মেসার্স সৈয়দ মজিবর রহমানের স্বত্বাধিকারী সৈয়দ মজিবর রহমান গোপালপুর উপজেলা আওয়ামীলীগের একজন নেতা। আওয়ামীলীগের শাসনামলেই তিনি পাওনাদারদের চাপে পালিয়ে পালিয় বেড়াতেন। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে তিনি পুরাপুরি আত্মগোপনে চলে গেছেন। কোনোভাবেই তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে তার প্রতিনিধি হিসেবে জৈনক আইয়ুব আলী গয়হাটা থেকে ভাড়রা রাস্তায় সিংজোড়া থেকে নাটারভাঙা পর্যন্ত রাস্তার কাজটি সম্পন্ন করেছেন।
টাঙ্গাইল এলজিইডির সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী এবং বর্তমান প্রধান কার্যালয়ের মনিটরিং ও মূল্যায়ন শাখার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম জানান, তিনি যথাযথ নিয়ম মেনে কাজ দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো পেয়েছিল। কাজ শুরু করে তারা নানা কারণ দেখিয়ে সময় বাড়িয়ে নেয়। তারপরও অজ্ঞাত কারণে কাজ দুটি তারা শেষ করেনি। এজন্য একাধিকবার তাদরকে নির্বাহী প্রকৌশলীর দপ্তর থেকে তাগিদ দেওয়া হয়েছে। তৎসময় ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে তারা কাজ দুটি সমাপ্ত করেন নাই বলে তিনি মনে করেন।
টাঙ্গাইল এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ কামরুজ্জামান জানান, তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে সড়ক দুটি নির্মাণ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে একাধিকবার সতর্ক করা হয়। সর্বশেষ চূড়ান্ত নোটিশ দেওয়ার পরে তারা নির্মাণ কাজ শুরু করে এবং দুদকে মামলা হওয়ার পর কাজ সমাপ্ত করেছে।