নিজস্ব প্রতিবেদক: অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের নেতৃত্বে রাজনৈতিক সংস্কার সংলাপ শুরু হলেও দীর্ঘ আলোচনার পরও তেমন কোনো কার্যকর অগ্রগতি হয়নি। এতে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নির্ধারিত সময়ে অনুষ্ঠিত হবে কি না, তা নিয়ে ক্রমবর্ধমান অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কমিশনের ধীরগতির কাজ, আস্থার সংকট ও দলগুলোর মধ্যকার মতপার্থক্য নির্বাচনী সময়সূচিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
এর আগেও বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচনের নজির রয়েছে। ১৯৯১ সালে বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে, ১৯৯৬ সালে বিচারপতি হাবিবুর রহমান এবং ২০০১ সালে বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ৯০ দিনের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন করে। তিনটি নির্বাচনই দেশি-বিদেশি মহলে স্বীকৃত হয় নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হিসেবে। বিচারপতি লতিফুর রহমান দলীয় প্রভাব মোকাবেলায় একদিনে ২০-৩০টি মন্ত্রণালয়ের সচিবকে বদলি করে প্রশাসনে শৃঙ্খলা আনেন। অথচ বর্তমান কমিশন মাসের পর মাস সংলাপ চালিয়েও কাঙ্ক্ষিত ঐকমত্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ১১ সেপ্টেম্বর থেকে সংবিধান, নির্বাচন, পুলিশ প্রশাসন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন ও জনপ্রশাসনসহ মোট ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। পরবর্তীতে এসব কমিশনের সুপারিশ পর্যালোচনার ভিত্তিতে চলতি বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠিত হয়। সাবেক প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে সভাপতি ও যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. আলী রীয়াজকে সহসভাপতি করা হয়।
কমিশনটি ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে কাজ শুরু করে এবং ২০ মার্চ থেকে ১৯ মে পর্যন্ত প্রথম ধাপের সংলাপ চালায়। দ্বিতীয় ধাপের সংলাপ শুরু হয় ২ জুন থেকে, যা এখনও চলছে। সূত্র জানায়, কমিশন এখন পর্যন্ত ৯টি সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন এবং সংসদীয় কমিটিতে বিরোধী দলের সভাপতিত্বের প্রস্তাবে দলগুলোর মধ্যে আংশিক ঐকমত্য এসেছে। তবে প্রধানমন্ত্রী পদে মেয়াদকাল নির্ধারণ, দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ গঠন এবং ‘জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল’ গঠনের বিষয়ে এখনও মতভেদ রয়েছে।
বিএনপি এবং অন্যান্য কয়েকটি বড় দল অভিযোগ করেছে, প্যাড-নির্ভর অপ্রতিনিধিত্বশীল ছোট দলগুলোর মতামতকে সমান গুরুত্ব দিয়ে সংলাপের গতি কমিয়ে আনা হয়েছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, “সংলাপে অনেক সময় আলোচনার চেয়ে খানাপিনাই বেশি হচ্ছে। সব বিষয়ে ১০০% একমত হওয়ার শর্তে আলোচনার প্রয়োজনীয়তা প্রশ্নবিদ্ধ।”
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, বৈদেশিক বিনিয়োগের ঘাটতি ও প্রশাসনিক স্থবিরতা রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। বিদেশি কূটনীতিকদের একটি অংশ এবং দেশীয় ব্যবসায়ী মহলও নির্বাচন পিছিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনায় উদ্বিগ্ন। এক রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, “ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন না হলে আগামী দুই এক বছরেও তা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কিছু মহল পরিকল্পিতভাবে সংলাপ দীর্ঘায়িত করছে।”
সোশ্যাল মিডিয়াতেও এই সংলাপ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠেছে। কেউ কেউ অভিযোগ করছেন, কমিশনের দায়িত্বপ্রাপ্তরা রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা উপভোগ করেই সংলাপ দীর্ঘায়িত করছেন। আবার কেউ কেউ এটিকে সরকারপন্থী মহলের চক্রান্ত বলে উল্লেখ করছেন—যার লক্ষ্য হলো বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে বাইরে রেখে একটি প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (পিআর) ভিত্তিক সংসদ গঠন।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটেও নানা উদ্বেগ তৈরি হচ্ছে। সম্প্রতি বিদেশি গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, মিয়ানমারে যুদ্ধরত রোহিঙ্গাদের একটি অংশ বাংলাদেশে হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এমন কোনো ঘটনা ঘটলে নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার নতুন অজুহাত তৈরি হতে পারে বলেও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।
সার্বিকভাবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের পরামর্শ, অতীতের অভিজ্ঞতা সামনে রেখে নির্ধারিত সময়েই গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের জন্য এখনই সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ জরুরি। অন্যথায় জাতীয় ঐকমত্যের যে প্রত্যাশা, তা দুরাশায় পরিণত হতে পারে।
ইপেপার
Copyright © 2025 ThikanaTV.Press. All rights reserved.