
নিজস্ব প্রতিবেদক: সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের দাবিতে ২০২৪ সালের ৪ জুলাই সারা দেশে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনকারীরা সেদিন দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক-মহাসড়ক ও রেলপথ অবরোধ করে তাদের দাবি জানাতে থাকেন। রাজধানীসহ প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়ে ওই আন্দোলন। সেদিন ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-রাজশাহী, ঢাকা-আরিচা, ঢাকা-বরিশাল, খুলনা-ঢাকা, খুলনা-যশোর ও খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়কে শিক্ষার্থীদের বাধার মুখে স্থবির হয়ে পড়ে যানবাহন চলাচল।
ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রেলপথ অবরোধ করে ট্রেন থামিয়ে দেন এবং টানা দুই ঘণ্টা বিক্ষোভ করেন। এমন পরিস্থিতিতে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা হামলা চালায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) হল ফটকে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় তালা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ৪ জুলাই বৃষ্টি উপেক্ষা করে রাজপথে নেমে আসেন। দুপুরে রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও এ আন্দোলনে যোগ দেন, একাত্মতা প্রকাশ করেন তাদের দাবি-দাওয়ার সঙ্গে।
ঢাবির শিক্ষার্থী তাহসিন আহমেদ বলেন, বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি হল থেকে আলাদা মিছিল বের হয়ে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে একত্রিত হয়। এরপর সম্মিলিত মিছিলটি হলপাড়া, ভিসি চত্বর ও টিএসসি ঘুরে দুপুর সোয়া ১২টার দিকে অবস্থান নেয় শাহবাগ মোড়ে। এ সময় তারা নানা ধরনের স্লোগান দেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলোÑসারা বাংলায় খবর দে- কোটা প্রথার কবর দে, দালালি না রাজপথ- রাজপথ রাজপথ, জেগেছ রে জেগেছে- ছাত্রসমাজ জেগেছে প্রভৃতি।
অবরোধের ফলে শাহবাগ থেকে ফার্মগেট, পল্টন, সায়েন্স ল্যাব, মগবাজার ও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো বন্ধ হয়ে যায়। অবরোধ চলে টানা সাড়ে ৫ ঘণ্টা। আশপাশে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন ছিল শুরু থেকেই।
সন্ধ্যার দিকে আন্দোলনকারীরা পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করে অবরোধ প্রত্যাহার করেন। আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেনÑসরকার, শিক্ষক, এমনকি শিক্ষার্থীরাও কোটা চায় না। তাহলে কারা চায় এই কোটা? কে সেই অদৃশ্য শক্তি? নির্বাহী বিভাগ আমাদের আদালতের মুখোমুখি দাঁড় করাতে চাইছে।
আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম জানান, আমাদের আন্দোলন আদালতের বিরুদ্ধে নয়। আমরা চাই জনপ্রশাসন বিভাগ দ্রুত সমাধান দিক। ৫ জুলাই অনলাইনে প্রচার চালানো হবে। ৬ জুলাই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ মিছিল এবং ৭ জুলাই ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন করে সর্বাত্মক ছাত্রধর্মঘট পালন করা হবে।
নাহিদ সেদিন আরো বলেন, ২০১৮ সালের গণআন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার কোটা বাতিল করে যে পরিপত্র জারি করেছিল, আজ তা আদালতের মাধ্যমে পুনর্বহাল করা হয়েছে। এটা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রহসন ছাড়া কিছু নয়। রাষ্ট্রযন্ত্রের অভ্যন্তরীণ সমন্বয়হীনতা ও দ্বন্দ্বে আমরা শিক্ষার্থীরা জড়িত নই। তারা নিজেদের মধ্যে সমন্বয় করুক এবং দ্রুত শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবি মেনে নিক।
ছাত্রলীগের হুমকি, হল ফটকে তালা
কোটাবিরোধী আন্দোলন ঠেকাতে ৪ জুলাই ঢাবির বিভিন্ন হলে শিক্ষার্থীদের হুমকি দিয়েছিল নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ। সে রাতের ঘটনা স্মরণ করে ইমরান জোবায়েদ নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, আন্দোলনকারীদের রুখতে ছাত্রলীগ কখনো গেটে তালা ঝুলিয়ে, কখনো হল থেকে জোর করে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল।
আশিকুর রহমান নামে আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ৪ জুলাই ঢাবির মাস্টারদা সূর্য সেন হলে সকাল ১০টার পর মূল ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেয় ছাত্রলীগ। ফটকের বাইরে অবস্থান নেয় হল শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল্লাহ খান ওরফে শৈশবসহ কয়েকজন নেতাকর্মী। প্রায় আধাঘণ্টা কোনো শিক্ষার্থী হল থেকে বের হতে পারেননি। শিক্ষার্থীদের তীব্র প্রতিবাদের মুখে পরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের হস্তক্ষেপে তালা খোলা হয়।
সেদিন শুধু সূর্যসেন হল নয়, বিজয় একাত্তর হল, জহুরুল হক হল, হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল ও জসীমউদ্দীন হলসহ বিভিন্ন হলে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ভয় দেখায়। জসীমউদ্দীন হলের চারতলায় কয়েকজন শিক্ষার্থীকে আটকে রাখা হয়, যেন তারা আন্দোলনে যোগ দিতে না পারে। সূর্যসেন হলের গেটে তালা দিয়ে পুরো একটি প্রজন্মের কণ্ঠ রুদ্ধ করার চেষ্টা চলে। এ ছাড়া হলে কোটাবিরোধী প্রচার চালাতে গেলে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বের করে দেওয়া হয়। অন্তত ২১টি হলে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা আন্দোলনের সমর্থকদের টার্গেট করে। ছাত্রনেতা সালমান আনসারকে এক হল থেকে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করে ছাত্রলীগ নেতারা। কিন্তু সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধের মুখে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। রাতভর উত্তেজনার মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনার পর আন্দোলনকারীরা বিভিন্ন হলে অবস্থান নিয়ে ঘোষণা দেনÑযে কোনো হলে হামলা হলে তারা একত্রে প্রতিরোধ গড়ে তুলবেন।
৪ জুলাই রাতে আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক সারজিস আলমকে অমর একুশে হল থেকে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেনের অনুসারীরা। সন্ধ্যায় তাকে হল ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। আতঙ্কিত সারজিস হলত্যাগ করতে গেলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা গেট আটকে দাঁড়ান এবং তাকে আবার হলে ফিরিয়ে আনেন।,
সেদিন সারজিস আলম গণমাধ্যমকে বলেন, কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতা আমাকে হল ছাড়ার জন্য চাপ দেয়। আমি ভয় পেয়ে বের হয়ে যেতে চাইলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা বাধা দেয় এবং আমাকে আবার হলে ফিরিয়ে নিয়ে যায়।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
দুপুর ১২টার দিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকশ শিক্ষার্থী মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে সামনের সড়ক অবরোধ করেন। প্রায় এক ঘণ্টা সেখানে অবস্থান করার পর শিক্ষার্থীরা রায়সাহেব বাজার মোড়ে গিয়ে নতুন করে সড়ক অবরোধ করেন। রায়সাহেব বাজার মোড়ে প্রায় দেড় ঘণ্টা অবস্থান শেষে শিক্ষার্থীরা আবার বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ফিরে যান। পুরো কর্মসূচিজুড়ে তারা কোটাবিরোধী নানা স্লোগান দেন এবং আন্দোলনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার অঙ্গীকার করেন।,
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
দুপুর ১২টার দিকে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দ্বিতীয় ফটকের সামনে থেকে মিছিল বের করে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় অতিক্রম করে আগারগাঁও মোড়ে গিয়ে অবস্থান নেন। সড়ক অবরোধের কারণে মিরপুর-ফার্মগেট এবং মহাখালী-শিশুমেলা রুটে যান চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। দুপুর দেড়টার দিকে শিক্ষার্থীরা অবরোধ তুলে নেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
শিক্ষার্থীরা বেলা ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে তারা চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে প্রায় এক ঘণ্টা অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন। এতে শত শত শিক্ষার্থী অংশ নেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
সকাল সাড়ে ৯টা থেকেই শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারিস রোডে জড়ো হতে শুরু করেন এবং সকাল ১০টা ২০ মিনিট পর্যন্ত সেখানে অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন স্লোগান দেন। পরে মিছিল নিয়ে প্রধান ফটকের সামনে গিয়ে সকাল ১০টা ৪৫ মিনিটে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করেন। প্রবল বৃষ্টির মধ্যেও তারা অবিচল থাকেন আন্দোলনে। প্রায় দেড় ঘণ্টা অবরোধ চলার পর দুপুর ১২টা ১০ মিনিটে শিক্ষার্থীরা কর্মসূচি প্রত্যাহার করেন।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়
বেলা সাড়ে ১২টার দিকে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করেন। এর আগে সকাল সাড়ে ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলচত্বরে আবাসিক হল ও মেসের শিক্ষার্থীরা একত্রিত হন। পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী তারা বিশ্ব রোডের দিকে যাত্রা শুরু করলে পুলিশি বাধার মুখে পড়েন। পরে শিক্ষার্থীরা বিকল্প পথ ধরে ময়নামতি জাদুঘরের পাশের সড়ক দিয়ে কোর্টবাড়ি বিশ্ব রোডে পৌঁছে অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন।
বরিশালে ছাত্রলীগের হামলা
দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভুঁইয়া ও প্রক্টর ড. আব্দুল কাইউম শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করে অবরোধ প্রত্যাহারের জন্য অনুরোধ করেন। তবে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন একযোগে প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত সড়ক খুলবেন না জানিয়ে ফের অবস্থান নেন। পরে উপাচার্য ও প্রক্টর চলে যান। কিছুক্ষণ পর ছাত্রলীগের এক নেতা মোটরসাইকেল চালিয়ে সড়ক পার হওয়ার চেষ্টা করলে শিক্ষার্থীরা বাধা দেন। এ সময় ছাত্রলীগের হামলায় তিন শিক্ষার্থী আহত হন।,
টানা চতুর্থ দিনের অবরোধে সেদিনের কর্মসূচিতে বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়কেও শিক্ষার্থীরাও অংশ নিয়েছিলেন।
বাকৃবি শিক্ষার্থীদের রেলপথ অবরোধ
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) শিক্ষার্থীরা দুপুর ১২টায় ক্যাম্পাসের মুক্তমঞ্চে সমবেত হন। এরপর বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে কেআর মার্কেট অতিক্রম করে আবার মুক্তমঞ্চের সামনে দিয়ে আব্দুল জব্বার মোড়ে এসে অবস্থান নেন। এ সময় ঢাকা থেকে জামালপুরগামী ‘জামালপুর এক্সপ্রেস’ট্রেনটি শিক্ষার্থীরা আব্দুল জব্বার মোড় সংলগ্ন রেললাইনে আটকে রাখেন। প্রায় দুই ঘণ্টা ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে প্রধান ফটক (ডেইরি গেট) সংলগ্ন ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করেন। এরপর দুপুর ১টার দিকে তারা অবরোধ তুলে নেন। এর আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সড়ক পেরিয়ে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের হয়, যা প্রধান ফটকে এসে শেষ হয়।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
বেলা পৌনে ১২টায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রধান ফটকের সামনে অবস্থান নিয়ে কুষ্টিয়া-খুলনা মহাসড়ক ২০ মিনিট অবরোধ করেন। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারে একত্রিত হয়ে তারা কোটা সংস্কারসহ চার দফা দাবিতে বিভিন্ন স্লোগান দেন। দুপুর ১২টা থেকে ১২টা ২৫ মিনিট পর্যন্ত এ বিক্ষোভ ও অবরোধ চলে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিকাল সাড়ে ৪টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত বৃষ্টি উপেক্ষা করে নগরীর জিরো পয়েন্ট অবরোধ করেন। কোটাবিরোধী নানা স্লোগানে উত্তাল হয়ে ওঠা ওই এলাকায় খুলনা-ঢাকা, খুলনা-যশোর ও খুলনা-সাতক্ষীরা সড়কের প্রবেশমুখ বন্ধ থাকে।,