প্রিন্ট এর তারিখঃ জুন ২৮, ২০২৫, ১২:০৩ পি.এম || প্রকাশের তারিখঃ জুন ২৩, ২০২৫, ৭:২৭ পূর্বাহ্ণ

নিজস্ব প্রতিবেদক: স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পরও থেমে নেই দোসরদের দাপট। সাবেক যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেলের ঘনিষ্ঠজন মাসুদ আলমের মালিকানাধীন ই-লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং লিমিটেড পেয়েছে ২৯৭ কোটি টাকার ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ প্রকল্প—যার টেন্ডার প্রক্রিয়ায় একাধিক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব পাওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে দুর্নীতি, ভুয়া সনদ, অর্থপাচার ও প্রতারণার অভিযোগে তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
প্রকল্প পরিচালক আব্দুল হামিদ খান এবং কার্যাদেশপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার মাসুদের বিদেশ সফরসহ ঘনিষ্ঠতার প্রমাণ রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এতে স্বার্থের সংঘাত (Conflict of Interest) তৈরি হয়েছে।
বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, টেন্ডারের শর্ত অনুযায়ী ১০ বছরের অভিজ্ঞতা বাধ্যতামূলক হলেও মাত্র ৪ বছর আগে গঠিত মাসুদের প্রতিষ্ঠান ই-লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং লিমিটেড-কেই বেছে নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত আছেন সরকারের প্রভাবশালী আমলারা। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মেসবাহ উদ্দিন সচিব থাকাকালে ৪৬.৭ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নকশা করেন। পরে মাসুদের প্রতিষ্ঠান কাজ পায় এবং অবসরের পর মেসবাহ নিজেই প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ও শেয়ারহোল্ডার হন।
আরেক সাবেক সচিব আখতার হোসেনের স্ত্রী মাহবুবা আক্তার মাসুদের অপর প্রতিষ্ঠান নগদহাট বাংলাদেশ লিমিটেড-এর শেয়ারহোল্ডার। আরজেএসসির নথি অনুযায়ী, এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আরও এক সাবেক সচিব মো. নাসির উদ্দিন। এ থেকে প্রকল্প প্রাপ্তির পেছনে প্রভাবশালী আমলাদের যোগসাজশ স্পষ্ট।
ক্রয় কমিটির তথ্যমতে, ২০টি প্রতিষ্ঠান টেন্ডারে অংশ নিলেও মাত্র ৪টি প্রতিষ্ঠান ‘রেসপনসিভ’ হিসেবে বিবেচিত হয়। কারিগরি ও আর্থিক মূল্যায়নে প্রথম হয় মাসুদের প্রতিষ্ঠান।
২০২৩ সালের অক্টোবরে প্রকল্পটি ঘোষণার পর আইটি খাতে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম নেয়। সাময়িকভাবে প্রকল্প স্থগিত হলেও পরে অজানা শক্তির ইঙ্গিতে তা মাসুদের প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে চূড়ান্ত হয়।
ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সাবেক সহসম্পাদক মাসুদ আলম শরীয়তপুরের গোসাইরহাট উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে 'শেখ হাসিনাতেই আস্থা' নামক ফেসবুক পেজ তিনি পরিচালনা করতেন সামরিক সচিব ও যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে।
এই কর্মকাণ্ডের স্বীকৃতিস্বরূপ মাসুদ পেয়েছেন ‘স্মার্ট বাংলাদেশ অ্যাওয়ার্ড ২০২৩’, ‘শেখ হাসিনা ইয়ুথ ভলান্টিয়ার অ্যাওয়ার্ড ২০২২’ এবং জাতীয় যুব পুরস্কারসহ একাধিক সম্মাননা। মাসুদের বাবা আজাহার উদ্দিন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ছোট ভাই রাসেল আলমও ছিলেন ছাত্রলীগের কর্মী।
২০২৩ সালের নভেম্বরে একটি টিভি অনুষ্ঠানে মাসুদ দাবি করেন, ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এলে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে তার পরিবার পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। সে সময় তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়াশোনাও শেষ করতে পারেননি।
সাবেক সচিব মেসবাহ উদ্দিনের বিরুদ্ধে অতীতে বিচারবিভাগীয় ক্যুর চেষ্টার অভিযোগ রয়েছে। তিনি গত অক্টোবরে ‘জুলাই গণহত্যা’ সংক্রান্ত মামলায় গ্রেপ্তার হন।
বিষয়টি নিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “প্রতিষ্ঠানটির নির্ধারিত পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই এবং দুর্নীতির তদন্ত চলমান। তাই কার্যাদেশ বাতিল করে প্রকল্পটি নতুনভাবে টেন্ডার করা উচিত।” তিনি আরও বলেন, “প্রকল্পটির বাস্তব প্রয়োজনীয়তা যাচাই করাও জরুরি—এটি যেন আরেকটি ‘ডিজিটাল লুটপাটে’ পরিণত না হয়।”
প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ও বেসিসের সাবেক সভাপতি ফাহিম মাশরুর বলেন, “আউটসোর্সিং ও প্রশিক্ষণের নামে আগেও হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে, যার ফলাফল শূন্য। ফ্যাসিস্ট শাসনব্যবস্থা নতুন রূপে পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।”
এ বিষয়ে মাসুদ আলমের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।