নিজস্ব প্রতিবেদক: জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার বাইগুনি গ্রামে বসে থাকা ৪৫ বছর বয়সি সাফিরুদ্দিন এখনো পেটের ব্যথায় কাতরান। এক সময় ভেবেছিলেন কিডনি বিক্রি করে পরিবারের দারিদ্র্য ঘোচাবেন। ২০২৩ সালের গ্রীষ্মে সাড়ে তিন লাখ টাকার বিনিময়ে ভারতে গিয়ে নিজের কিডনি বিক্রি করেছিলেন। আজ সেই টাকাও শেষ, বাড়ির নির্মাণও অসম্পূর্ণ। দিনমজুরি করলেও শারীরিক অসুস্থতার কারণে কাজ করাও দুরূহ হয়ে উঠেছে।
“আমি স্ত্রী-সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই কিডনি বিক্রি করেছি,” বললেন সাফিরুদ্দিন। তবে দালালদের দেওয়া প্রলোভনের বাস্তবতা এখন তার কাছে নির্মম প্রতারণা।
এই গ্রামেরই আরও অনেকে একই পথে হেঁটেছেন। ফলে স্থানীয়ভাবে জায়গাটিকে ডাকা হয় 'এক কিডনির গ্রাম' নামে। গবেষণা বলছে, কালাইয়ের প্রতি ৩৫ জন প্রাপ্তবয়স্কের একজন কিডনি বিক্রি করেছেন। বেশিরভাগই দরিদ্র পুরুষ, যাদের বয়স ৩০ বছরের আশপাশে।
ভারতে মানব অঙ্গ প্রতিস্থাপন আইন অনুযায়ী কিডনি প্রতিস্থাপন শুধুমাত্র ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের কাছ থেকে, কিংবা সরকারি অনুমতির ভিত্তিতে করা যায়। কিন্তু এই নিয়মকে পাশ কাটিয়ে দালালরা তৈরি করছে ভুয়া ডিএনএ টেস্ট, নোটারি অ্যাফিডেভিট ও জাল পাসপোর্ট। দাতার পরিচয় বদলে ফেলে আত্মীয়রূপে উপস্থাপন করছে। এই কারসাজির মাধ্যমে কিডনি চলে যাচ্ছে ভারতের ধনী রোগীদের শরীরে।
মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞ ড. মনিরুজ্জামান বলেন, “দালালরা সাধারণত দাতার নাম পরিবর্তন করে ফেলে। জাল নোটারি সনদ দিয়ে তারা সম্পর্ক প্রমাণ করে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও অনেক সময় এই জালিয়াতি ইচ্ছাকৃতভাবেই দেখে না।”
বাইগুনি গ্রামের বাইরে বিনাই গ্রামের ৪৫ বছর বয়সি বিধবা জ্যোৎস্না বেগম ২০১৯ সালে দালালদের চাপে পড়েই স্বামীসহ ভারতে কিডনি বিক্রি করেন। চুক্তি অনুযায়ী সাত লাখ টাকা পাওয়ার কথা থাকলেও হাতে আসে মাত্র তিন লাখ। কলকাতার একটি হাসপাতালে তার কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়। কাগজে কিডনি গ্রহীতাকে আত্মীয় দেখানো হয়।
প্রতারণা এখানেই শেষ নয়। ঢাকার ব্যবসায়ী মোহাম্মদ সজল (ছদ্মনাম) ইভ্যালির ধসের পর ঋণের চাপে ২০২২ সালে নিজের কিডনি বিক্রি করেন। প্রলোভন ছিল ১০ লাখ টাকার, কিন্তু পান মাত্র সাড়ে তিন লাখ। পরে তিনিও দালালের ভূমিকায় নামেন। কয়েক মাস কাজ করে নিরাপত্তাহীনতার কারণে সরে দাঁড়ান।
বাংলাদেশ পুলিশ জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক কিডনি পাচার চক্র শনাক্তে তারা মাঠে কাজ করছে। সহকারী মহাপরিদর্শক এনামুল হক সাগর বলেন, “চক্রের সদস্যদের ধরতে আমরা নিরলস চেষ্টা করছি।”
অন্যদিকে ভারতে সম্প্রতি কিছু চিকিৎসক গ্রেপ্তার হলেও তা যথেষ্ট নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে দিল্লিতে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট সার্জন বিজয়া রাজাকুমারী গ্রেপ্তার হন। তার বিরুদ্ধে ১৫ জন বাংলাদেশির কিডনি প্রতিস্থাপনের অভিযোগ রয়েছে।
এই পাচার ব্যবসার মূল চালিকাশক্তি—দারিদ্র্য আর আইনের ফাঁকফোকর। কিডনি গ্রহণে আগ্রহী রোগীদের সংখ্যা অনেক বেশি হলেও বৈধ দাতার সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। ফলে ধনী রোগীরা দ্রুত সমাধানের জন্য বেআইনি পথে ঝুঁকছেন, আর গরিব দাতারা পড়ে যাচ্ছেন দালালদের ফাঁদে।
ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের সহযোগী পরিচালক শরীফুল হাসান বলেন, “অনেকে চরম দারিদ্র্যের কারণে কিডনি বিক্রি করেন, কিন্তু প্রতারণার শিকার হন। অনেক সময় তাদের ভিসা, পাসপোর্ট ও প্রেসক্রিপশন পর্যন্ত নিয়ে নেওয়া হয় যাতে প্রমাণ না থাকে।”
ভারতের ‘কিডনি ওয়ারিয়রস ফাউন্ডেশন’-এর প্রধান রঘুবংশী বলেন, “বৈধ দাতার অভাবই এই পাচারের মূল কারণ। অসহায় রোগীরা তখন অবৈধ পথ খোঁজেন।”
বিশেষজ্ঞদের মতে, কিডনি পাচার বন্ধে কেবল দালাল ধরলেই হবে না। দরিদ্র মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে এবং চিকিৎসা ভ্রমণ খাতকে মানবিক নীতিমালার আওতায় আনতে হবে। তা না হলে এই নিষ্ঠুর ব্যবসা থামবে না—বরং আরও বিস্তৃত হবে।
ইপেপার
Copyright © 2025 ThikanaTV.Press. All rights reserved.