
যে সকল প্রতিষ্ঠানের অফিসে বা অফিস প্রাঙ্গণে বাগান রয়েছে সাধারণত সে সকল প্রতিষ্ঠানে বাগান পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ সম্পাদনের প্রেক্ষিতে যে কোন প্রতিষ্ঠানই একজন মালি প্রয়োজন। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটির বাগানের হতে পারে সৌন্দর্যবর্ধনের কারণে, নান্দনিকতার কারণে। তবে সৌন্দর্য বর্ধনের সাথে যোগ হয় দৃষ্টিনন্দিত সবুজায়ন।
শরীরের যেমন নিয়মিত যত্ন দরকার তেমনি গাছের ক্ষেত্রেও নিয়মিত যত্ন নিতে হয়। নিয়ম মাফিক পরিচর্যা করা উচিত যাতে গাছগুলো সতেজ প্রাণবন্ত থাকে যেন শ্রম বিফলে না যায়।
একটি টেকসই ও উৎপাদনমুখী সবুজায়ন যেন পৃথিবীর সকল মানুষের জন্য অনাবিল সুখ হাসি আনন্দের পাথেয় হয়। আমাদের পরিকল্পিত পৃথিবীতে সবুজায়নকে টেকসই ও উৎপাদনমুখী করতে আমরা বরাবরই একজন দক্ষ মালির প্রয়োজন অনুভব করি।
শিক্ষককে যদি সবুজায়নের সাথে তুলনা করি তবে শিক্ষাক্ষেত্রগুলোকে আমরা ভূমিরূপ বা প্রতিষ্ঠানের সাথে তুলনা করতে পারি। যেখানে ব্যবস্থাপনায় রয়েছে দায়িত্বশীল সুশীল সমাজ অর্থাৎ উচ্চ পর্যায়ে পরিকল্পনাবিদগণ। বিদ্যালয় পর্যায়ে প্রতিটি শিক্ষককে যদি বাগানের মালির মত দায়িত্বশীল আসনে চিন্তা করা যায় প্রতিটি শিশুকে আমরা ফুলের মত উপাদান হিসেবে পেতে পারি। প্রতিটি বিদ্যালয়ে আগত ৪+ অথবা ৫+ বয়সী শিশু এক একটি নতুন কলি যা উপযুক্ত পরিচর্যার মাধ্যমে আমাদের পৃথিবীকে সুশোভিত করতে পারে।
প্রাথমিকে পরিকল্পনাকারী, বাস্তবায়নকারী এবং অভিভাবক, শিক্ষার্থী, শিক্ষক এর যথাযথ দায়িত্বশীল আচরনের ইতিবাচক প্রয়োগ শিক্ষার্থীর সঠিক বিকাশকে নিশ্চিত করতে পারে। তবে বিকাশের ক্ষেত্রকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেন এক জন দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শিক্ষক। যেখানে তাঁর পেশাদারিত্ব তাকে ভীষনভাবে অনুপ্রাণিত করে।
আমেরিকান গবেষক লায়ন জে রেইড গবেষণা মাধ্যমে দেখান যে যদি প্রথম শ্রেণির সমাপ্তিকালে কেউ পঠন দক্ষতায় দুর্বল থাকে তবে প্রায় ৯০% ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, ৪র্থ শ্রেণির শেষেও পঠন দক্ষতায় দুর্বল থাকে।শিশুর পড়তে শেখার ক্ষেত্রে আর্লিগ্রেড রিডিং খবই গুরুত্বপূর্ণ।কারণ এ সময় শিশু পঠন দক্ষতা ঠিকমতো অর্জন না
করলে পরবর্তী স্তরেও দুর্বলতা দেখা যায়।
(১ম ও ২য় শ্রেণিকে বলা হয় আর্লিগ্রেড শ্রেণি । এই স্তরে শিশুরা পড়তে শেখার সাথে সাথে ভাষার মূল উপাদানগুলো যেমন: বর্ণ, বণের্র উচ্চারণ, শব্দ ইত্যাদি আয়ত্ব করে। এই আর্লিগ্রেড স্তরে শিশুদের যা পড়ানো হয় তাকে আলি গ্রেড রিডিং বলা হয়। আলি যেড রিডিং এর ফলে-শিশুদের পড়ার দক্ষতা তৈরি হয় ও পাঠের বিষয়ে আত্ববিশ্বাসী হয়ে ওঠে। বই পড়তে আগ্রহী হয় এবং পাঠের অভ্যাস তৈরি হয়। স্বশিখনে উৎসাহী হয়। আনন্দ পায় এবং বিনোদন হিসেবে বিবেচিত হয়।
দক্ষ পাঠক হওয়ার জন্য প্রতিটি ভাষার প্রাথমিক পর্যায়ে শিশুর জন্য পাঁচটি মৌলিক পঠন দক্ষতা অর্জন করা প্রয়োজন। এই দক্ষাতাগুলোকে বলা হয় পঠনের দক্ষতা ভিত্তি মূলক দক্ষতা। দক্ষতাগুলো হলো- ধ্বনি সচেতনতা, বর্ণজ্ঞান, শব্দভান্ডার, সাবলীলতা, বোধগম্যতা ধ্বনি সচেতনতা: দুটি শব্দ, অজ এবং অলি শব্দের মধ্যেকার উচ্চারণগত পার্থক্য হলো ধ্বনি সচেতনতা।
অজ-অ, অলি-ও…।
বর্ণ জ্ঞান: বর্ণের নাম, আকৃতি ধ্বনিঃ বা উচ্চারণ, শব্দভান্ডার: ক্রমবর্ধমান নতুন শব্দ।
সাবলীলতা : পঠন সাবলীলতা হলো কোনো একটি পাঠ বা পাঠ্যাংশ নির্দিষ্ট গতিতে সঠিক উচ্চারণে এবং যদি চিহ্ন অনুসরণ করে অভিব্যক্তির মাধ্যমে পড়তে পারার দক্ষতা। অথ্যাৎ কোন শব্দ বা বাক্য স্পষ্ট ও শুদ্ধভাবে, সঠিক স্বরভঙ্গি বজায় রেখে পড়তে পাবার দক্ষতাই পঠন সাবলীলতা। পড়ার দুটো অংশ আছে। একটি হলো শব্দকে ডিকোড করতে পারা এবং অন্যটি হলো ডিকোডকৃত শব্দের অর্থ বুঝতে পারা।
বোধগম্যতা: আর্লি’ গ্রেড পর্যায়ে শিশুরা টেক্স ট বই থেকে পড়ার দক্ষতা অর্জন করে। টেক্সট বই থেকে শিশরা সারাবছর নির্ধারিত, বর্ণ, শব্দ, বর্ণনা ইত্যাদি পড়ে এ কারনে ঐ নির্ধারিত বর্ণ ও শব্দগুলো মুখস্ত হয়ে যায়। ফলে বর্ণ ও শব্দ না চিনলেও পড়ার দক্ষতা অর্জন না করলেও টেক্সট বই পড়তে সমস্যা হয় না। যেমন- প্রথম শ্রেনির আতা গাছে তোতা পাখি’ কবিতাটি মুখস্থ ও লেখা মিলিয়ে দ্রুত শিক্ষার্থী পড়তে পারে, কিন্তু যদি লিখে দেয়া হয়, তবে সাবলীল ভাবে পড়তে পারে না।
একটি শিশুকে দ্রুত সাবলীল পাঠকে পরিণত করতে শিক্ষককে বিদ্যালয়ে শ্রেণি লেভেলের ঝজগ সহায়ক বইয়ের সঠিক ব্যবস্থাপনার প্রতি নজর দেয়া জরুরী।
বিদ্যালয় পর্যায়ে প্রতিটি শ্রেণিকে বিশেষ করে আর্লিগ্রেড স্তরের শিক্ষার্থীর জন্য একটি করে বুক কর্নার থাকা জরুরী। বুক কর্নারের পাশাপাশি রিডিং কর্ণার স্থাপন জরুরী।রিডিং কর্নার ওইসব শিক্ষার্থীর অগ্রাধিকার দেয়া উচিত; যারা পিছিয়ে আছে। এজন্য দরকার অবশ্যই বছরে শুরুতে একবার শিক্ষার্থীর বেসলাইন সার্ভে করা। সার্ভের ফলাফলের ভিত্তিতে দল করে চিহ্নিত শিক্ষার্থী প্রতি বিশেষ নজর দিতে পারলেই শতভাগ শিক্ষার্থীর সাবলীল গঠন দক্ষতার উন্নয়ন করা যেতে পারে।
এজন্য শ্রেণিতে শিক্ষকের আন্তরিকতা, দায়বদ্ধতা শিক্ষার্থীর প্রতি গভীর ভালোবাসা অত্যন্ত জরুরী। শিক্ষকের অবহেলা আর্লিগ্রেড স্তরের শিক্ষার্থীর জন্য মারাত্বক ক্ষতির কারণ হতে পারে। আর্লি গ্রেড স্তরের শিক্ষার্থীর শতভাগ উপস্থিতি নিশ্চিতকরণে বিদ্যালয়, অভিভাবক ও শিক্ষকের সম্মিলিত প্রচেষ্টার শতভাগ শিক্ষার্থীর সাবলীল পাঠক হিসাবে গড়তে সাহায্য করে। একজন সাবলীল পাঠকের বিদ্যালয়, থেকে ঝরে পড়ার হার খুবই কম। তাই আমরা বলতেই পারি যে, বাগানের মালি যেমন ভালোবেসে বাগানে ফুল ফোটায় তেমনি একটি বিদ্যালয়ের শিক্ষকের আন্তরিকতা ও পরম মমতায় বিকশিত হয় শিশুর সুপ্ত প্রতিভা।
আমার দেশের প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রতিটি শিক্ষক ও সুপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে সঠিক কার্যকরী মনিটরিং এর মাধ্যমে, দক্ষ ও সুদূরপ্রসারী কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণে শিশুর শিক্ষার ভিতকে মজবুত করে তুলতে পারে।
বেলা শেষে শিক্ষকের দায়বদ্ধ আচরণ শিক্ষককে সফল সার্থক করে তুলতে পারে। জাতির ভবিষ্যৎ তৈরীর কারিগর শিক্ষক যার যোগ্য নেতৃত্বে প্রতিটি বিকশিত জীবনকে তার গন্তব্যে পৌঁছে দিতে পারে। অর্থাৎ শিশুর ঝরে পড়াকে শুন্যে আনতে বিদ্যালয়ে শিক্ষক হতে পারে মালির মত প্রশংসিত। পেশাগত জীবনের দীর্ঘ পথ চলার পর প্রতিটি শিক্ষককে বলতে চাই- আগামীর শিশুর কাছে/আমি চির স্মরণীয়/পড়ন্ত বেলায় আজ/ আমি তৃপ্ত/ আমি চির বরণীয়…
লেখক: সহকারি শিক্ষক, ভারই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ভূঞাপুর, টাঙ্গাইল।