
ঠিকানা টিভি ডট প্রেস: কয়েক মাস ধরে দক্ষ একজন মফস্বল সম্পাদকের সন্ধান করছেন সাবেক ‘বস’। আমাকেও খুঁজে দিতে বললেন। সেজন্য কয়েকজনের সঙ্গে কথাও বললাম। তবে স্মার্ট কাউকে পেলাম না। সাবেক এক সহকর্মী বললেন, ‘ভাই, সম্পাদকদের কাছে মফস্বলের গুরুত্ব কম। ভালো বেতনও ধরেন না, কাঙ্ক্ষিত আচরণও করা হয় না। ফলে মফস্বলের জন্য ‘স্মার্ট’ সম্পাদক তৈরি হচ্ছে না। ’
কিছুদিন আগে বগুড়ায় গিয়ে মেধাবী সাংবাদিক মোস্তফা সবুজের (গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সদস্য) সঙ্গে আলাপ। বললেন, মফস্বলের অনেক তরুণ ভালো সাংবাদিকতা করতে চান। তবে বাস্তবতা ভিন্ন। বেতন-ভাতার সঙ্গে অফিশিয়াল সহযোগিতার ক্ষেত্র সীমিত। ফলে এখানে ভালো সাংবাদিকতার সুযোগ কমছে। বড় সাংবাদিকরাও ভিন্নপথ ধরছেন।
আবারও বলতে হয়, দেশে মূলত আমলা-দলীয় লেজুড়বৃত্তির অভিজাত সাংবাদিকতা চলছে। সম্পাদকদের বেশিরভাগই ‘বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী’ দলীয় ভাড়াটে। যাদের অ্যাসাইনমেন্টে শত শত সাংবাদিক হুমড়ি খান সবিচালয়ে। মফস্বল নিয়ে এদের কোনো প্ল্যান নেই। কারণ তারা জনগণ বলতে স্বদলীয় নেতাকর্মীদেরই বুঝে থাকেন। স্মার্ট মফস্বল সম্পাদক খোঁজার সময় নেই এদের।
বাংলামেইলে কাজ করার সময় অপেশাদার (মূল সম্পাদক বিতাড়িত হওয়ার পর বিনিয়োগকারী কোম্পানির দায়িত্ব পাওয়া এজিএম) সম্পাদককে দেখেছি, মফস্বলকে সবচে বেশি গুরুত্ব দিতে। বলতেন, ঢাকার চেয়েও বেশি সাংবাদিক তো জেলা-বিভাগে। তিনিই সবার আগে মফস্বলে বেতন দিতে বলতেন। ঢাকায় তাদের আসা-যাওয়া, থাকা-খাওয়া ফ্রি করে দিয়েছিলেন। অথচ পেশাদার সম্পাদকেরা মফস্বল প্রতিনিধিদের ঠকান, চাঁদা দাবি করেন।
আমার সাবেক মফস্বল সম্পাদক বললেন, ‘ভাই, অনলাইন বা প্রিন্ট যা-ই বলেন, বেশিরভাগই মফস্বল প্রতিনিধিদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করে। কখনও মফস্বলে সাংবাদিকতা করেননি, বোঝেনও না- এমন অনেকে মফস্বল ডেস্কের চিফ হয়ে গেছেন। যাদের সঙ্গে প্রতিনিধিদের দূরত্ব বেশি। ফলে অপার সম্ভাবনার মফস্বল সাংবাদিকতার মৃত্যু ঘটছে। সেই সঙ্গে ভালো মফস্বল সম্পাদকেরাও হারিয়ে যাচ্ছেন।
হিসাবে দেখা যায়, দেশের সব সংবাদমাধ্যমের ফোকাস ঢাকায় বাস করা ১২ শতাংশ মানুষের দিকে। অথচ জেলা-উপজেলার ৮৮ শতাংশ মানুষের জন্য তাদের কোনো ফোকাস নেই।গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষেরা যে রাতদিন পরিশ্রম করে দেশের ভাগ্য বদলাচ্ছে, তার পুরো ক্রেডিট দলীয় সরকারকে দিয়ে পুলকিত বোধ করে বেশিরভাগ সংবাদমাধ্যম।
সাম্প্রতিক ঘটনাবলী নিয়ে সামাজিকমাধ্যমে তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করা সুমিত রায় বলছেন, “মিডিয়া যখন প্রান্তিক মানুষের সংগ্রামকে উপেক্ষা করে, যখন তাদের দাবিকে গুরুত্বহীন করে তোলে, তখন প্রকারান্তরে শাসক শ্রেণির আধিপত্যকেই আরও শক্তিশালী করা হয়।” এই ভাষ্যের প্রতিনিয়ত প্রমাণ মেলে প্রান্তিক মানুষের সংগ্রাম তথা মফস্বলকে উপেক্ষা করা সংবাদমাধ্যমের চরিত্র বিশ্লেষণে।
ঢাকাই সংবাদমাধ্যমের আসল লক্ষ্যই মনে হয়, শুধু দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়ন। সেই সঙ্গে দলান্ধ, ধর্মান্ধ, যৌক্তিকবোধহীন জাতি তৈরি করা। যারা রাজনীতির ন্যারিটিভের আফিমে বুঁদ হয়ে থাকবে। গণতন্ত্র, সুশাসন এমনকি দেশের চেয়েও যাদের কাছে বড় হয়ে উঠবে পছন্দের রাজনৈতিক দল আর নেতারা?মূলত, এমন সাংবাদিকতাই দলীয় সরকারকে কর্তৃত্ববাদী করে তুলতে সহায়তা করে। সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে।
কিংবদন্তি অনেক সম্পাদক যে প্রতিনিধিদের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে, চাঁদাবাজি করে তাদের ঠকিয়ে মফস্বল সাংবাদিকতাকে নষ্ট করেছেন তার পেছনের কারণ মনে হয় অনেক গভীর। মফস্বল সাংবাদিকতা ভালো হলে, স্মার্ট হলে ক্ষমতাসীন দল অনবরত প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে, জনসমর্থন হারাতে পারে- এমন আশঙ্কা থেকেই হয়তো উপেক্ষার প্রবণতা তৈরি হয়েছে। যে কারণে বড় বড় ‘হিপোক্রেট’ সম্পাদকেরাই আজকের মফস্বল সাংবাদিকতা উপেক্ষা প্রকল্পের উদ্যোক্তা।