
ঠিকানা টিভি ডট প্রেস: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তিস্তার পানি বণ্টন নয় মহাপরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশের বিশ্বস্ত বন্ধু ও আঞ্চলিক অংশীদার ভারত। দেশটি বাংলাদেশের সঙ্গে আরও গভীরভাবে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। আমরা বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সম্পৃক্ততার পথ এবং কার্যপন্থা নিয়ে আলোচনা করেছি। আমরা আমাদের দুই দেশের এবং জনগণের কল্যাণের জন্য আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করার বিষয়ে সম্মত হয়েছি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিস্তা প্রকল্পে ভারত-চীন দুই দেশই প্রস্তাব দিয়েছে, দেশের স্বার্থ বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নেবে সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর সাম্প্রতিক ভারত সফর নিয়ে আজ মঙ্গলবার (২৫ জুন’) গণভবনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেছেন।
বাংলাদেশ অংশে তিস্তা নদীর সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার মহাপরিকল্পনায় চীনের অর্থায়ন প্রস্তাব ঝুলে থাকার মধ্যে তাতে যুক্ত হওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছে ভারত সরকার।
এর অংশ হিসাবে একটি কারিগরি দল শিগগিরই বাংলাদেশ সফর করবে বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ভারতের কারিগরি দলের সফরকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ‘ইতিবাচক’ হিসাবে বর্ণনা করলেও চীনের অর্থায়নের ক্ষেত্রে এটা বাধা হতে পারে বলে মনে করছেন কোনো কোনো বিশ্লেষক।
শনিবার (২২ জুন) দিল্লিতে ওই যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেন,’বাংলাদেশে তিস্তা নদীর সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার বিষয়ে আলোচনার জন্য একটি কারিগরি দল শিগগিরই বাংলাদেশ সফর করবে।”
৮-১১ জুলাইয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেইজিং সফরে তিস্তা প্রকল্পে চীনের অর্থায়নের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসার ‘সম্ভাবনার’ মধ্যে এমন ঘোষণার খবর বেশ গুরুত্ব দিয়ে ছেপেছে ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো। ভারতের এ ঘোষণার ফলে ওই প্রকল্পের বিষয়ে চীনের ‘চাপকে’ ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করা আগামী মাসের বেইজিং সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য ‘সহায়ক’ হবে বলে মন্তব্য করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
তিস্তা মহাপরিকল্পনা
২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের আগে দুই দেশের পানি সম্পদ মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে তিস্তার পানিবণটন চুক্তির বিষয়ে দুইপক্ষ একমত হয়েছিল। মনমোহন সিংয়ের সফরেই বহু প্রতীক্ষিত তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি হওয়ার কথা থাকলেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতায় তা আটকে যায়।
নরেন্দ্র মোদির বিজেপি সরকার ভারতের ক্ষমতায় আসার পর তিস্তা চুক্তি নিয়ে আশার কথা শোনা গেলেও মমতার মত বদলায়নি। এমনকি চলতি বছরের ২২ জুনে দিল্লিতে শেখ হাসিনা-নরেন্দ্র মোদির বৈঠকের পরে সোমবার (২৪ জুন’) গঙ্গা, তিস্তাসহ পানিবন্টন চুক্তির বিরোধীতা করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে একটি দীর্ঘ চিঠি লিখেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়।
তৎকালে ভারতের সঙ্গে তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি আটকে থাকার মধ্যে ‘তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন প্রজেক্ট’ হাতে নেয় সরকার।২০১৯ সালের জুলাইয়ে বেইজিং সফরে এটিসহ আরো কয়েকটি প্রকল্পে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন সরকারের সহায়তা চেয়েছেন বলে গণমাধ্যমে খবর আসে। তিস্তা প্রকল্পে নদীটির উপকূল ব্যবস্থাপনায় অবকাঠামো নির্মাণ ছাড়াও বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং গ্রীষ্মকালে পানি সংকট দূর করতে বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো গড়ে তোলা হবে বলে সেসময় এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল বিবিসি।’
পরে এ প্রকল্পে চীনের সম্পৃক্ত হওয়ার খবরের মধ্যে ২০২২ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি রংপুরে এক অনুষ্ঠানে তখনকার বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছিলেন,তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হবে। এ জন্য প্রধানমন্ত্রী খুব সিরিয়াস। আন্তর্জাতিক একটা ছোট ঝামেলা আছে, এ কারণে বিলম্ব হচ্ছে। তবে এটা হলে নদীর দুই পাড়ে বিশাল অর্থনৈতিক জোন গড়ে তোলা সম্ভব হবে।’
প্রকল্পের কাজ আটকে থাকলেও গত ডিসেম্বরে এক অনুষ্ঠানে চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেছিলেন, দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন তারা। নির্বাচনের পর তা শুরুর আশা প্রকাশ করেন তিনি। এরপর জানুয়ারিতে নতুন সরকার গঠনের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের সঙ্গে বৈঠক করে ঢাকায় চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “তিস্তা নদী প্রকল্পের বিষয়ে চীন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
এরপর গত মাসে ঢাকা সফরে এসে তিস্তা প্রকল্পে অর্থায়নে ভারতের আগ্রহের কথা জানান দেশটির পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কোয়াত্রা। মে মাসের ৯ তারিখে তার সঙ্গে বৈঠকের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, “তিস্তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তিস্তায় আমরা একটা বৃহৎ প্রকল্প নিয়েছি। ভারত সেখানে অর্থায়ন করতে চায়। আমি বলেছি, তিস্তায় যে প্রকল্পটি হবে, সেটা আমাদের প্রয়োজন অনুযায়ী হবে। আমাদের প্রয়োজন যেন পূরণ হয়।”
ভারতের এমন আগ্রহের মধ্যেও ১২ জুন জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে চীনের কাছে ঋণ চেয়েছে সরকার।
তিনি বলেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ করছে সরকার। এর পরিপ্রেক্ষিতে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) বৈদেশিক সাহায্য অনুসন্ধান কমিটির ৫১তম সভায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নের স্বার্থে সহজ শর্তের ঋণ পেতে চীন সরকারকে অনুরোধ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এরপর চীন সরকার প্রকল্পটি পর্যায়ভিত্তিক বাস্তবায়নের নিমিত্তে আরও বিশদ সমীক্ষার বিষয়ে পরামর্শ দেওয়ার কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন,’পাওয়ার চায়না কর্তৃপক্ষ চীন সরকারের নির্দেশনা মোতাবেক গত বছরের ২৭ অগাস্ট ফিজিবিলিটি স্টাডি রিপোর্ট সংশোধনের প্রস্তাব বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডে পাঠিয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।”
কী করবে ভারতের কারিগরি দল
হিন্দুস্তান টাইমসের খবরে বলা হয়, পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কোয়াত্রা গণমাধ্যমের ব্রিফিংয়ে বলেছেন, অভিন্ন পানি সম্পদের ব্যবস্থাপনা ‘অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল বিষয়’।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী তিস্তা সংরক্ষণ নিয়ে আলোচনা করেছেন। যেখানে “ভালো রকমের কারিগরি ব্যবস্থাপনা দরকার। এটা সেভাবে পানিবণ্টনের বিষয় নয়, বরং তিস্তা নদীতে পানির প্রবাহ ব্যবস্থাপনার বিষয়।’
২২ জুন দিল্লিতে দুই প্রধানমন্ত্রীর শীর্ষ বৈঠকের পর যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, আমাদের উন্নয়ন সহযোগিতার অংশ হিসাবে, ভারতের সহযোগিতায় পারস্পরিকভাবে সম্মত সময়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে তিস্তা নদীর সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা করব আমরা।
অন্যদিকে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “বাংলাদেশে তিস্তা নদীর সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা সহযোগিতার আগ্রহ প্রকাশ করেছে ভারত। তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি দ্রুত শেষ করার বিষয়টি পুনর্ব্যক্ত করেছে বাংলাদেশ।’
চীনে বাংলাদেশের সাবেক এই রাষ্ট্রদূত বলেন,এই রকম আগেও ঘটেছে, আমাদের দুয়েকটা প্রস্তাব, প্রকল্প আমারা চীনের সাথে করতে গিয়েও করতে পারিনি। যেমন-মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর। সেটাতে ভারতের উদ্বেগের কথা বলা হয়, কিন্তু আমরা দিলাম জাপানকে। সুতরাং এগুলো ছোটখাটো সমস্যা হতেই পারে। কিন্তু নিজেদের স্বার্থে আমাদের বুঝেশুনে করতে হবে।”