
নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশের কৃষিনির্ভর অর্থনীতি ও খাদ্য নিরাপত্তা আজ এক নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে—তামাক চাষের বিস্তার। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দ্রুতগতিতে তামাক চাষ বাড়ছে, যা মাটির উর্বরতা হ্রাস, পরিবেশ দূষণ এবং টেকসই কৃষি ব্যবস্থার জন্য হুমকি হিসেবে দেখা দিচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, তামাক একটি বহিরাগত ও আক্রমণাত্মক ফসল। এতে মাটি শক্ত হয়ে পড়ে এবং পরবর্তী মৌসুমে অন্য কোনো খাদ্য ফসল ফলানো কঠিন হয়ে পড়ে। কৃষকরা বেশি লাভের আশায় এই চাষে ঝুঁকছেন। বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রায় ৯০ শতাংশ কৃষক এখন তামাক চাষের ওপর নির্ভরশীল বলে কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য জানিয়েছে।
তামাক চাষে অতিরিক্ত ইউরিয়া, টিএসপি এবং কীটনাশক ব্যবহারে মাটির অণুজীব ধ্বংস হচ্ছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি হেক্টর জমিতে গড়ে ৫৭৫ কেজি ইউরিয়া, ৪৬৬ কেজি টিএসপি এবং ১৬ বার কীটনাশক প্রয়োগ করা হয়। জমির স্বাভাবিক জীবনীশক্তি হারিয়ে প্রায় মৃত হয়ে পড়ে। একই সঙ্গে, এসব রাসায়নিক ভূগর্ভস্থ পানির স্তরে মিশে জনস্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ হুমকি তৈরি করছে।
বিশ্বে তামাক চাষে ব্যবহার হচ্ছে চাষযোগ্য জমির মাত্র ০.৩ শতাংশ, কিন্তু পরিবেশগত ক্ষতি তুলনামূলক অনেক বেশি। বিশ্বব্যাপী যেখানে তামাক চাষ হ্রাস পাচ্ছে, বাংলাদেশে তার বিপরীত প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০০১ সালে দেশে ৭৩ হাজার ৮৭০ একর জমিতে তামাক চাষ হতো; ২০১১-১২ মৌসুমে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ২৬ হাজার একরে।
চাষিদের তামাক চাষে উৎসাহিত করছে দেশি-বিদেশি তামাক কোম্পানিগুলো। তারা বীজ, সার, অগ্রিম অর্থ ও অন্যান্য উপকরণ সরবরাহ করে কৃষকদের আকৃষ্ট করছে। ফলে কৃষকরা অল্প বিনিয়োগে অধিক লাভের আশায় তামাক চাষে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছেন। বর্তমানে ‘জাতি তালিম’ তামাক প্রতিমণ ২,৪০০–২,৫০০ টাকা এবং ‘বিলাতি মতিহারি’ ২,১০০–২,২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
তামাক চাষ একাধিক মৌসুমের জমি দখল করে নেয়। একটি মাত্র ফসলের জন্য খরিফ-২ মৌসুমের শেষাংশ, রবি মৌসুম এবং খরিফ-১ মৌসুমের শুরু পর্যন্ত জমি ব্যবহৃত হয়, ফলে শাকসবজি, ডাল, পাটসহ বিভিন্ন খাদ্য ফসলের আবাদ মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
চট্টগ্রামের এক উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জানান, “তামাক কোম্পানিগুলো নানা লোভনীয় সুবিধা দিয়ে কৃষকদের প্রলুব্ধ করছে। এতে মাটি, পানি ও জীববৈচিত্র্য ক্ষতির মুখে পড়ছে। তাদের নিরুৎসাহিত করতে নিয়মিত সভা-সেমিনার করা হচ্ছে।”
কৃষি বিজ্ঞানী ড. এম. এ. সোবাহান বলেন, “তামাক চাষ যেন মাটির জন্য বিষের ফোঁড়া। অতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহার ও মাটির অতিরিক্ত শোষণের কারণে এটি দেশের কৃষি ব্যবস্থায় ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে।”
প্রজ্ঞার নির্বাহী পরিচালক এবিএস জুবায়ের বলেন, “তামাক চাষ বন্ধে প্রয়োজন হলে কঠোর আইন প্রণয়ন করতে হবে। এটি শুধু জমির উর্বরতা নষ্ট করছে না, বরং ভবিষ্যৎ খাদ্য নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে।”
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সরকার, নাগরিক সমাজ এবং কৃষি সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সমন্বিত পদক্ষেপ না নিলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা, পরিবেশ ও কৃষি ব্যবস্থা এক গভীর সংকটে পড়বে। এখনই সময় তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ এবং পর্যায়ক্রমে বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের।