
নিজস্ব প্রতিবেদক: সরকার পতনের পর সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলা বিএনপির সভাপতি স.ম আফসার আলী, সাধারণ সম্পাদক আমিনুর রহমান টুটুল ও সাংগঠনিক সম্পাদক সাইদুর রহমানের বিরুদ্ধে একাধিক সরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন পুকুর দখলের অভিযোগ উঠেছে।
সম্প্রতি উপজেলার দেশীগ্রাম ইউনিয়নের পশ্চিম পাইকড়া গ্রামের রাশিদা সুলতানার ৪০ বিঘার (১৩ দশমিক ১৪ একর) ১০টি পুকুর দখল করায় গত রোববার (৬ অক্টোবর) বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার (এসপি) ও জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা (এনএসআই) সংস্থাসহ বিএনপির যুগ্ন মহাসচিব ও রাজশাহী বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বরাবর লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন তিনি।
বিষয়টি নিশ্চিত করে সিরাজগঞ্জ পুলিশ সুপার (এসপি) ফারুক হোসেন বলেন, পুকুর দখলের একটি অভিযোগ পেয়েছি। এটি খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
লিখিত অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন। পরেরদিন ৭ আগস্ট সন্ধ্যায় ওই তিন নেতার নির্দেশে দেশীগ্রাম ইউনিয়ন বিএনপির যুগ্ন-সাধারণ সম্পাদক শাহীন আলম ও তার লোকজন ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। এই চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে ৮ থেকে ১০ আগস্ট টানা তিনদিন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের ইন্ধনে স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীরা প্রায় ২০ লাখ টাকার মাছ লুট করে ১০টি পুকুর দখলে নেয়। এতে বাঁধা দিলে তাদের ভয়ভীতি ও প্রাণনাশের হুমকি দেন বলে বিএনপির মহাসচিবসহ বিভিন্ন দফতরে অভিযোগ করেছেন রাশিদা সুলতানা নামের এক ভুক্তভোগী নারী।
অভিযোগে বলা হয়- সরকার পতনের পর উপজেলা বিএনপির সভাপতি আফসার আলী, সাধারণ সম্পাদক টুটুল ও সাংগঠনিক সম্পাদক সাইদুর রহমানের নির্দেশে স্থানীয় ইউনিয়ন বিএনপি নেতা শাহীন আলম, সোহেল রানা ও ছোরহাব হোসেনসহ ৩০ থেকে ৩৫ জন নেতা কর্মী রাশিদা সুলতানার কাছে গিয়ে তাদের ১০টি পুকুর বাবদ ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। এ চাঁদা দিতে হবে কেন? এমন জবাবে বিএনপি নেতা শাহীন আলম রাশিদা সুলতানাকে বলেন উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও সম্পাদক তাদের পাঠিয়েছে। যদি এ চাঁদা না দেন, তাহলে পুকুরের সব মাছ তুলে নেওয়া হবে। এরপর ৮ থেকে ১০ আগস্ট স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীরা পুকুর পাড়ে দেশীয় অস্ত্রের মহড়া দিয়ে দিনভর ১০টি পুকুরে জাল ফেলে প্রায় ২০ লাখ টাকার মাছ লুট করে নেন। এ মাছ ধরতে নিষেধ করলে পুকুর মালিকদের উল্টো অকথ্য ভাষায় গালাগালি ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করে প্রাণনাশের হুমকি ও ১০ আগস্ট সকাল ১০ টার দিকে তাদের পৈত্রিক বাড়ি থেকে বের করে দেয় তারা। পরে চাপের মুখে নিরুপায় হয়ে তারা বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নেয়। এরপর থানায় গিয়ে একটি অভিযোগ করেন। পরবর্তীতে এই অভিযোগ তুলে নিলে ন্যায় বিচার দেওয়া হবে বলে আশ্বাস দেন উপজেলা বিএনপির তিন নেতা। এরই এক পর্যায়ে ওই তিন নেতার চাপের মুখে ভুক্তভোগী রাশিদা সুলতানা থানায় দেওয়া অভিযোগ তুলে নেয়। এরপর দুই মাস পেরিয়ে গেলেও বিচার দেওয়ার কথা বলে পুকুর ১০ টি দখলে রেখেছেন তারা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পশ্চিম পাইকড়া গ্রামের বড় বড় রুই কাতলা মাছে পরিপূর্ণ ১০টি পুকুর মাছ শূন্য। অবাধে মাছ মেরে নিয়েছে স্থানীয় বিএনপির নেতা কর্মীরা। ভিটেবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন ভুক্তভোগী পরিবার। অভিযুক্ত ওই তিন নেতার বিরুদ্ধে উপজেলার সরকারি একাধিক পুকুর দখলেরও সত্যতা পাওয়া যায়।
ভুক্তভোগীদের কাগজপত্র সূত্রে জানা যায়, পশ্চিম পাইকড়া মৌজার সিএস ১, ২, ৩, ৬, ৫৪ ও ৫৮ নং খতিয়ানের বিভিন্ন দাগে ৪০ বিঘা এ ভূমির মালিক ছিলেন জমিদার সৈয়দ আলতাফ আলী চৌধুরী ও প্রসন্ন নাথ চক্রবর্তী। এসব ভূমি তারা পত্তন দেয়ার ঘোষণা দেন। পরবর্তী বাংলা ১৩৪২ সনের ৯ ফাল্গুন ও ৮ চৈত্র তারিখে মনিরুজ্জামান খন্দকার তার মেয়ে কেএম সাইদা আক্তারের নামে পত্তন নেন। এ পত্তন নেয়ার পর মনিরুজ্জামান তার মেয়ের নামে জমিদারের সেরেস্তায় সনে সনে খাজনা প্রদান করে ভোগ দখল করেন। কিন্তু এ ভূমি এসএ জরিপ আমলে পত্তন নেয়া মালিকের নামে রেকর্ড না হয়ে ১নং খাস খতিয়ানে রেকর্ড হয়। এরপর ১৯৭৮ সালে পত্তন নেয়া কেএম সাইদা আক্তার আদালতে মামলা দায়ের করলে দোতরফা সূত্রে ডিক্রি পান। পরবর্তী আরএস জরিপ আমলেও ১নং খাস খতিয়ানে রেকর্ড হয়। এরপর ২০১৪ সালের ১৫ জুন ভুল রেকর্ড সংশোধনে সাইদা আক্তার আবারও আদালতে মামলা দায়ের করেন। এ মামলার দীর্ঘ শুনানির পর ২০১৭ সালের ২৭ এপ্রিল তারিখে পূনরায় দোতরফা সূত্রে রায় পান। এ রায়ে আদালত আরএস ১নং খাস খতিয়ান হতে কর্তন করে কেএম সাইদা আক্তারের নামে পৃথক খতিয়ান খুলে রেকর্ড সংশোধন করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেন। কেএম সাইদা আক্তার ২০২৩ সালে মৃত্যুবরণ করায় উক্ত সম্পতির ওয়ারিশ সূত্রে মালিক হন তার মেয়ে দিলারা বেগম। তবে দিলার বেগম অসুস্থ্য থাকায় তার তিন মেয়ে রাশিদা সুলতানা, রেবেকা সুলতানা, রেহেনা সুলতানা ও ছেলে রাশিদুল হাসান এ ১০ টি পুকুরে মাছ চাষ করে আসছিলেন।
প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় কৃষক হাফিজুর রহমান বলেন, দিনে দুপুরে আমাদের চোখের সামনে পুকুরে জাল ফেলে অবৈধ ভাবে বিএনপি নেতারা এই মাছ গুলো মেরে নিলো। কিন্তু আমরা কিছুই করতে পারলাম না। এটি চরম অন্যায়। আমরা ছোটবেলা থেকেই এই পুকুর গুলো রাশিদা সুলতানাদের পরিবারকে চাষ করতে দেখে আসছি। এগুলো তাদের সম্পূর্ণ বৈধ মালিকানাধীন পুকুর। মালিকানা পুকুর কেউ এইভাবে দখল করে? আমি আগে কখনও দেখিনি।
তবে অভিযুক্ত চাঁদা দাবি ও পুকুর দখলের অভিযোগ অস্বীকার করে উপজেলা বিএনপির সভাপতি স.ম আফসার আলী মুঠোফোনে বলেন, দলের সম্পাদক ও সাংগঠনিকসহ আমরা ঢাকায় রয়েছি। ওই ১০টি পুকুরের বিষয়ে কাগজপত্র নিয়ে বসা হয়েছিল। এতোদিন পুকুর গুলো যারা চাষ করেছেন তাদের পক্ষে আদালতের নির্দেশ থাকলেও ওই সম্পত্তির কোন খাজনা খারিজ নেই। এরপর ব্যস্তার কারণে বিষয়টি আর সমাধান করা হয়নি। তিনি উপজেলা বিএনপির বিরুদ্ধে বিভিন্ন সরকারি পুকুর দখলের অভিযোগের বিষয়ে বলেন, বিগত ১৬টি বছর পুকুর গুলো আওয়ামী লীগের লোকজন খেয়েছে। এখন কিছুটা এদিক সেদিক তো হবেই।
এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক (রাজশাহী বিভাগ) শাহিন শওকত বলেন, দলের চেয়ারম্যান বরাবর লিখিত অভিযোগ দিলে তদন্ত সাপেক্ষে জড়িতদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।