
নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশের বাজারে বিক্রি হওয়া জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের টি–ব্যাগে সিসা, ক্যাডমিয়াম, পারদ, আর্সেনিক ও ক্রোমিয়ামের মতো ভারী ধাতু নিরাপদ সীমার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে পাওয়া গেছে। এসব ধাতু শরীরে জমে দীর্ঘমেয়াদে হৃদরোগ, কিডনি, লিভার ও স্নায়ুর ক্ষতি, উচ্চ রক্তচাপ, বন্ধ্যত্ব এবং শিশুদের শারীরিক বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে।
বেসরকারি সংস্থা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এসডো) পরিচালিত গবেষণা ‘ব্রিউইং টক্সিনস : এক্সপোসিং দ্য হেভি মেটাল হ্যাজার্ড ইন টি–ব্যাগস অ্যান্ড ড্রাইড লুজ টি’–তে এসব তথ্য উঠে এসেছে। বৃহস্পতিবার রাজধানীর লালমাটিয়ায় এসডোর কার্যালয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হয়।
গবেষণায় স্থানীয় বাজার থেকে ১৩টি নমুনা—১২টি টি–ব্যাগ ও একটি খোলা চা–পাতা—সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষায় দেখা যায়, টি–ব্যাগের প্যাকেজিংয়ে ক্রোমিয়াম সর্বোচ্চ ১,৬৯০ পিপিএম (নিরাপদ সীমা ৫ পিপিএম), সিসা ৫১ পিপিএম (সীমা ৫ পিপিএম), পারদ ১০৮ পিপিএম (সীমা ০.৩ পিপিএম) এবং আর্সেনিক ১৪ পিপিএম (সীমা ২ পিপিএম) পর্যন্ত পাওয়া গেছে। গবেষকরা জানান, টি–ব্যাগের উপাদানে থাকা এসব ধাতু গরম পানির সংস্পর্শে সহজেই চায়ের সঙ্গে মিশে শরীরে প্রবেশ করে।
গবেষণায় আরও উল্লেখ করা হয়, টি–ব্যাগ থেকে আলাদা করা চা–পাতায় অ্যান্টিমনি ধাতুর উপস্থিতি (সর্বোচ্চ ১৫৪ পিপিএম) এবং অতি স্বল্প পরিমাণে ইউরেনিয়াম ও থোরিয়াম শনাক্ত হয়েছে। তবে চা–পাতায় আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ, কপার, জিঙ্ক ও কোবাল্টের মতো পুষ্টিগুণও পাওয়া গেছে।
জরিপে দেখা যায়, দেশের ৯৬ শতাংশের বেশি মানুষ প্রতিদিন চা পান করে, কিন্তু ৯৯ শতাংশ মানুষ জানে না টি–ব্যাগে ভারী ধাতু থাকতে পারে। ৯০ শতাংশ ভোক্তা কখনও লেবেল বা সার্টিফিকেশন পরীক্ষা করেন না।
অনুষ্ঠানে এসডোর চেয়ারম্যান সৈয়দ মার্গুব মোরশেদ বলেন, “টি–ব্যাগে ভারী ধাতুর উপস্থিতি ভোক্তা অধিকারের গুরুতর লঙ্ঘন। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।”
বাংলাদেশ চা বোর্ডের গবেষণা কর্মকর্তা নাজমুল আলম বলেন, “টি–ব্যাগের প্যাকেজিংয়ের এমন ঝুঁকি আমরা আগে জানতাম না। ভবিষ্যতে সরকারি সংস্থার অংশগ্রহণে যৌথ গবেষণা প্রয়োজন।”
বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই)-এর সহকারী পরিচালক ইসমাত জাহান বলেন, “এমন গবেষণাকে আমরা স্বাগত জানাই। দ্রুততম সময়ে বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে।”
বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মারূফ মোহায়মেন জানান, “এই গবেষণা ভবিষ্যতে আরও বিস্তৃত অনুসন্ধানের পথ খুলে দিয়েছে।” খাদ্য নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষের সদস্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শোয়েব বলেন, “আরও সূক্ষ্ম ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পরীক্ষা করা জরুরি।”
এসডোর নির্বাহী পরিচালক সিদ্দীকা সুলতানা বলেন, “চায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে এটি মানুষের জন্য শারীরিক ও মানসিক উভয় ঝুঁকি তৈরি করবে।”
এসডোর সিনিয়র টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার ড. শাহরিয়ার হোসেন জানান, “এই গবেষণার উদ্দেশ্য দোষারোপ নয়; বরং খাদ্যশৃঙ্খলে বিষাক্ত ধাতুর প্রবেশ রোধের উদ্যোগ নেওয়া।”
গবেষণা প্রতিবেদনে কয়েকটি সুপারিশ করা হয়েছে—
চা বাগান, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিক্রয় পর্যায়ে নিয়মিত পরীক্ষা চালিয়ে ফলাফল প্রকাশ করা
কৃষিতে ভারী ধাতু আনতে পারে এমন রাসায়নিকের ব্যবহার কমানো
সব চা–জাত পণ্যে নিরাপত্তা লেবেল ও সার্টিফিকেশন বাধ্যতামূলক করা
প্লাস্টিক ও পিইটি টি–ব্যাগ নিষিদ্ধ করে নিরাপদ বিকল্প চালু করা
গবেষকরা মনে করেন, দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে দেশের কোটি চা–পানকারী দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়বে।