টাঙ্গাইল পাসপোর্ট অফিসে চ্যানেল ফি’র যাতাকলে গ্রাহকে হয়রানি, দালাল চক্র সক্রিয় 

জহুরুল ইসলাম, স্টাফ রিপোর্টার: আশোভগ হৃদয়ে একটি ফাইল হাতে টাঙ্গাইল জেলা পরিষদের মাঠে বসে আছে এক তোগড়া যুবক। ছব্দনাম আবুল হাসেম দুলাল। বয়স ২৭ বছর। কাছে যেতেই জানা গেল তিনি পাসপোর্ট করতে শহরে এসেছেন। বাড়ি টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলায়। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা জমা দিয়ে যথাযথভাবে অনলাইনে পাসপোর্টের আবেদন ফরম পুরণ করেছেন। এসেছেন আবেদন ফরম জমা দিতে। ছল ছল অশ্রুশিক্ত চোখে তিনি জানালেন- ‘বিয়ে করেনি’ মর্মে চেয়ারম্যানের কাছ থেকে সার্টিফিকেট না আনায় তার ফাইল পাসপোর্ট অফিসের অফিস সহকারী কাম মূদ্রাক্ষরিক জোবায়ের আহমেদ জমা না নিয়ে ফেরত দিয়েছেন। এক আনসার সদস্য তাকে একটি মোবাইল ফোন নম্বর দিয়ে যোগাযোগ করতে বলেছেন। তিনি যোগাযোগ করায় এক দালালের কাছ থেকে জানতে পেরেছেন- এভাবে সরাসরি ফরম জমা নিবেনা, ১৫শ’ টাকা তাকে দিলে তিনি ফরম জমা নেওয়ার ব্যবস্থা করবেন। তার কাছে নিজের যাতায়াতের খরচ ব্যতিত টাকা নেই। তাই বসে আছেন। কেন পাসপোর্ট দরকার জানতে চাইলে বললেন- তেমন লেখাপড়া করেননি, তাই বিদেশে যাবেন ভাগ্য পরিবর্তন করতে। এ অবস্থা শুধুমাত্র দুলালেরই নয়- টাঙ্গাইল আঞ্চলিক পাসপার্ট অফিসে আবেদন ফরম জমা দিতে আসা প্রায় সবার।

খোজ নিয়ে জানা যায়, টাঙ্গাইল অঞ্চলিক পাসপোর্ট কার্যালয়ে অবৈধ চ্যানেল ফি ও দালালদের দাপটে গ্রাহক হয়রানি চরমো পৌছেছে। গড়ে ওঠেছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেটের বাইরে কারও আবেদন ফরম জমা নেওয়া, ভেরিফিকেশন (তদন্ত) দেওয়া, পাসপোর্ট ডেলিভারী দেওয়া ইত্যাদি কোন কাজই হয়না। কার্যালয়ের অফিস সহকারী কাম মূদ্রাক্ষরিক জোবায়ের আহমেদ ও মাষ্টাররোলে কর্মরত পরিছন্ন কর্মী মাসুম হরিজন পাসপোর্ট অফিসের সিন্ডিকেটের মূল হোতা। তাদের সঙ্গে কয়েকজন আনসার সদস্য এবং বহিরাগত ১৫-২০জন দালাল জড়িত রয়েছে। প্রতি পাসপোর্টের বিপরীতে সরকারি ফি’র বাইরে ১১শ’ টাকা উৎকোচ নেওয়া হয়। নিয়ম না থাকলেও প্রতিদিন দুপুর ১টার পরে আবেদন ফরম জমা নেওয়া হয়না- কিন্তু দ্বিগুণ টাকা উৎকোচ দিলেই আবেদন ফরম জমা নেওয়া হয়। উৎকোচ নেওয়ার এ পদ্ধতির নাম চ্যানেল ফি। দালালরা চ্যানেল ফি’র নামে প্রতি পাসপোর্টে দেড় হাজার থেকে দুই হাজার টাকা নিয়ে আবেদন ফরম জমা নেওয়ার ব্যবস্থা করেন। এক্ষেত্রে ১১শ’ টাকা অফিসে জমা দিয়ে বাকি টাকা তারা পকেটস্থ করেন। চ্যানেল ফি’র টাকা পাসপোর্ট অফিসের সবাই ভাগবাটোয়ারা করে নিয়ে থাকেন। এ চ্যানেল ফি’র নামে পাসপোর্ট করতে আসা গ্রাম-গঞ্জের গ্রাহকদের কাছ থেকে নির্ধারিত ফি’র দ্বিগুণ টাকাও নেওয়া হয়ে থাকে।

সরজমিন পাসপোর্ট অফিসের ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখা যায়, আবেদনের ফরম জমা দেওয়ার লম্বা লাইন। এ সময় সখীপুর উপজেলা থেকে আসা আসাদুজ্জামান (ছব্দনাম) জানান, তিনি প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। অথচ যারা দালাল ধরে এসেছে তারা অনেকেই কাজ শেষ করে চলে গেছে। আরও ভেতরে যেতেই দেখা যায় পাসপোর্ট অফিসের ডেলিভারী কক্ষের সামনে শ’ শ’ মানুষের ভিড়।

কক্ষের দরজার সামনে রাশিদুল (ছব্দনাম) নামে এক যুবক পাসপোর্ট নেওয়ার জন্য অসুস্থ্য শরীরে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি জানান, প্রায় দেড় ঘণ্টা যাবৎ অসুস্থ্য শরীরে দাঁড়িয়ে থাকতে খুব কষ্ট হচ্ছে। তার সামনে দিয়ে অনেকেই পাসপোর্ট নিচ্ছে। কিন্তু তারটা ভাগ্য জুটছে না। তিনি জানান, শুনেছিলেন সরকারি অফিসে অসুস্থ্যদের জন্য আলাদা সেবা দেওয়া হয়। এখানে এসে সেবার পরিবর্তে ভোগান্তির শিকার হয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন।

স্থানীয়রা জানায়, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর বেশিরভাগ অফিসে দালালমুক্ত হলেও পাসপোর্ট অফিস দালালমুক্ত হয়নি। বরং অন্য অফিসের দালালরা পাসপোর্ট অফিসে কর্মসংস্থান করে নিয়েছে। দালালেরা স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা বা ব্যক্তিগৃত প্রভাব খাটিয়ে দালালি করছে। এতে বিভিন্ন উপজেলার দূর-দূরান্ত থেকে পাসপোর্ট করতে আসা লোকজন হয়রানির পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

পাসপোর্ট আবেদনকারীরা এ বিষয়ে ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষের জরুরি হস্তক্ষেপ কামনা করছে। তারা জানায়, পাসপোর্ট অফিসের সিন্ডিকেটের থাবায় গ্রাহক ভাগান্তি ও দুর্নীতির অক্টোপাস প্রাতিষ্ঠানিক রৃপ পেয়েছে। অতিরিক্ত টাকা ছাড়া পাসপোর্ট করা খুবই কষ্টকর হয়ে পড়েছে। অফিসের প্রায় সব কর্মকর্তা ও পিয়ন উৎকোচ গ্রহণের সঙ্গে জড়িত। এটা এক প্রকার ‘ওপেন সিক্রেট’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাসপোর্ট করে দেওয়ার জন্য দালালরা ওৎ পেতে বসে থাকে। অফিসে দালাল ছাড়া কোনো পাসপোর্টের আবেদন ফরম গ্রহণ করা হয় না। দালাল ও অফিসের কর্মচারীদের কারণে পাসপোর্ট করতে আসা সাধারণ মানুষ চরম হয়রানির শিকার হচ্ছে।

স্থানীয় দালালদের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, টাঙ্গাইল আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস দুই ধরনের পাসপোর্ট ফি রয়েছে। এরমধ্যে সরকারি ফি ৭ হাজার টাকা আর ভিআইপি ফি সাড়ে ৮ হাজার টাকা। কয়েকজন দালাল জানায়, পাসপোর্ট অফিস সরকারি হলেও মূলত তারাই নিয়ন্ত্রণ করেন। অফিসের আশে-পাশে তাদের নিজেদের বা পরিচিতজনদের কম্পিউটারের দোকান আছে। দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে বিকালে ফরম জমা দিতে গলেও অফিস থেকে নানা ভুল-ত্রুটি দেখিয়ে বিদায় করে দেয়। আর চ্যানেল ফি হিসেবে ১২শ’-১৫শ’ টাকা নগদ দিলে ৪০০-৫০০ মানুষের সিরিয়াল থাকলেও মুহূর্তের মধ্যে পাসপোর্ট ফরম জমা দেওয়া যায়।

পাসপোর্ট অফিসের পাশের একটি সরকারি দপ্তরের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে জানান, ৫ আগস্টের পর সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে পাসপোর্ট অফিসে অভিযান চালানো হলেও এখনও দালাল নির্মূল হয়নি। মাঝেমধ্যেই তিনি দালালদের সঙ্গে অনেকের ঝগড়া হতেও দেখেন। এতে তাদেরও ভাগান্তি হয়।

পাসপোর্ট অফিসে মাষ্টাররোলে কর্মরত মাসুম হরিজন জানান, তিনি মূলত গ্রাহকদের মাঝে পাসপোর্ট ডেলিভারী দিয়ে থাকেন। অফিস সহকারী জোবায়ের আহমেদের নির্দেশে অফিসের অন্য স্টাফ ও আনসার সদস্যরা ফরম জমা নেন। চ্যানেল ফি’র বিষয়ে তিনি জানান, এরকম ব্যবস্থা আগে ছিল- এখন নেই। তবে ভিআইপিদের পাসপোর্টের ক্ষেত্রে ফুট-ফরমায়েস করে দিলে তারা বখশিস দেন- এটাতে তিনি দোষের কিছু দেখেন না।

অফিস সহকারী কাম মূদ্রাক্ষরিক জোবায়ের আহমেদ জানান, অফিসের উপ-পরিচালক বা ঊর্ধতন কর্মকর্তারা যেভাবে অফিস চালাতে বলেন তিনি সেভাবেই চালান। চ্যানেল ফি’র বিষয়ে তিনি কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।

টাঙ্গাইল জেলা সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সভাপতি বাদল মাহমুদ জানান, বাংলাদেশের দুর্নীতি অনেক গভীর প্রোথিত। এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে দুর্নীতি নেই। এখনও অনেক জায়গার দুর্নীতি ভাঙা যায়নি। কোনো কোনো জায়গায় দুর্নীতিবাজেরা প্রকাশ্য আসতে ভয় পায়। কিন্ত গোপনে ঠিকই দুর্নীতি করছে।

তিনি আরও জানান, পাসপোর্টের চার্জ আগের চেয়ে বাড়িয়ে দিয়েছে। এটা খুবই দুঃখজনক। দেশের ঊর্ধতন কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদদের ভাবতে হবে কীভাবে দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা যায়। কোনো নির্দিষ্ট নামে উৎকোচ গ্রহণ করা হলে সেটা অনেকটা প্রকাশ্য ও প্রাতিষ্ঠানিকতার পর্যায়ে পড়ে।

এ বিষয়ে টাঙ্গাইল আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের উপ-পরিচালকের দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী পরিচালক জেবুনাহার পারভীন জানান, প্রতিদিন ৪৫০ থেকে ৫০০জন পাসপোর্টের আবেদন নিয়ে আসেন। এজন্য অফিসের নিচে অস্থায়ী ছাতার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যুবকের বিয়ের ‘সনদে’র বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, এ ধরনের কোন সনদের কথা তার জানা নেই।

তিনি জানান, দালালদের কারণে সেবা দিতে তারাও হিমশিম খাচ্ছেন। তার অফিসের কেউ দালালদের বিরুদ্ধে কথা বললে পরবর্তীতে দালালরা তাদেরকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেয়। তারপরও তিনি খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।’

Facebook
Twitter
WhatsApp
Pinterest
Telegram

এই খবরও একই রকমের

শিবির নেতার ওপর হামলা, প্রতিবাদ জানাল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন

নিজস্ব প্রতিবেদক: গাজীপুরের টঙ্গীতে তামিরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসা শাখা ছাত্রশিবিরের ওয়ার্ড সভাপতি ফজলে রাব্বি সিফাতের ওপর ছাত্রদলের হামলা ও থানায় আটকে রেখে আইনি অধিকার থেকে বঞ্চিত

মুকুন্দগাঁতী বাজার বনিক সমিতির নির্বাচনে প্রার্থীতা ফিরে পেলেন সভাপতি প্রার্থী তোফাজ্জল 

জহুরুল ইসলাম, স্টাফ রিপোর্টার: সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার মুকুন্দগাঁতী বাজার বনিক সমবায় সমিতি লিমিটেডের আসন্ন নির্বাচনে সভাপতি পদপ্রার্থী হাজী তোফাজ্জল হোসেন হাই কোর্টে প্রার্থীতা ফিরে পেলেন।

শেখ হাসিনাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা

নিজস্ব প্রতিবেদক: আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে গুমের ঘটনায় শেখ হাসিনাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। আজ সোমবার প্রসিকিউশনের আবেদনের

জঙ্গি সংগঠন ইস্কনের বিরুদ্ধে তাড়াশে মুসুল্লিদের বিক্ষোভ সমাবেশ

লুৎফর রহমান তাড়াশ: বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘকে (ইস্কন) নিষিদ্ধের দাবিতে সিরাজগঞ্জের তাড়াশে  বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে সাধারণ ছাত্র-জনতাসহ বিভিন্ন মসজিদের মুসল্লিরা। এ সময় অ্যাডভোকেট

জাতীয় সংগীতে পরিবর্তন এনেছে যেসব দেশ

ঠিকানা টিভি ডট প্রেস: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ঘিরে পতন হয়েছে সরকারের। এরপর থেকে শুরু হয়েছে রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরে সংস্কার। এবার নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে জাতীয়

চৌহালীতে জামায়াতের গণসংযোগ 

নিজস্ব প্রতিবেদক: বৈষম্য বিরোধী, ন্যায় ও ইনসাফ ভিত্তিক কল্যাণমুখী রাষ্ট্র কায়েম ও সকল শহীদ ও আহতদের স্মরণে আগামী ১১ ফেব্রুয়ারি সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলা জামায়াতের উদ্যোগে